রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

চাঁদপুর কলেজের ছাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
চাঁদপুর কলেজের ছাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিজানুর রহমান চৌধুরী উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দায়িত্বকাল ১৯৮৬ সালের ৯ জুলাই থেকে ১৯৮৮ সালের ২৭ মার্চ। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মিজানুর রহমান চৌধুরীর জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। তিনি টানা আটবার সংসদ নির্বাচিত সদস্য হন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী পুরাণবাজারের পূর্ব শ্রীরামদী গ্রামের সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ১৯ অক্টোবর। বাবা হাফিজ চৌধুরী, মা মাহমুদা বেগম। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। তিনি নুরিয়া হাই মাদ্রাসা ও চাঁদপুর সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে ফেনী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে এ কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। পড়ার পাঠ চুকিয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রথমে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বামনী জুনিয়র হাইস্কুল। এখানে তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নির্বাচিত হন এবং সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন। এ চাকুরিটিও তিনি বেশিদিন করেননি। সরকারি চাকুরি ছেড়ে তিনি নুরিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু এজন্যে কোনো বেতন বা সম্মানী নিতেন না।

মিজানুর রহমান চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য। ১৯৪৪ সালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৪৫ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের কুমিল্লা জেলা কমিটি গঠিত হয়। তিনি এ কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছর তাঁকে মুসলিম লীগ ভলান্টিয়ার কোরের ক্যাপ্টেন-এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালে চাঁদপুর মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতা করেন এবং নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে ফেনী কলেজে পড়াকালে তিনি ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী রাজপথের সৈনিক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অংশগ্রহণ করেছেন বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সামনের সারির সংগঠক ছিলেন তিনি। পাকিস্তান আমলে তাঁকে দুবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে জননিরাপত্তা আইনে তিনি প্রথমবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান পরিষদ নির্বাচনের পূর্বে তিনি মুক্তি পান। ১৯৬৬ সাল ছিল মিজানুর রহমান চৌধুরীর জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। এসময় ছয়দফা আন্দোলন স্তীমিত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। তখন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মিজানুর রহমান চৌধুরী দায়িত্ব পালন করেন। ৭ জুন ছয় দফার দাবিতে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। তিনি ছিলেন ধর্মঘটের প্রধান সাংগঠনিক আহ্বায়ক। ২২ জুন প্রতিরক্ষা আইনে তাঁকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, “মিজানুর রহমান চৌধুরী এম. এন. এ-কে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক ছিল। মনে হতেছে কাহাকেও বাইরে রাখবে না। এখন সমস্ত পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান তো একটা বড় ‘কারাগার’।”

প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে তিনি মুক্তি পান। ১৯৬৮ সালে তাঁকে সংযুক্ত বিরোধীদলের আহ্বায়ক করা হয়। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মিজানুর রহমান চৌধুরী যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি চাঁদপুরে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত করতে কাজ করেন। ৩১ মার্চ আগরতলায় যান। এসময় তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগ সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

মিজানুর রহমান চৌধুরী বিপুল জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, জিতেছেন। ১৯৫৯ সালে চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। দিন যতই পার হচ্ছিল, সাফল্য ধরা দিয়েছিল তাঁর হাতে। তিনি আপাদমস্তক জনসেবক ছিলেন। ফলে দিন দিন তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সাংবাদিক নঈম নিজাম তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নেতা-কর্মী, সমর্থক, সাংবাদিক সবার অবাধ যাতায়াত ছিল তার বেডরুমে। সেখানে লুঙ্গি পরে আরাম করে তিনি বসতেন। কথা বলতেন সবার সঙ্গে। ভোরে দেখা যেত পাশে স্ত্রী শুয়ে আছেন এর মধ্যে তিনি কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন। গণমানুুষের নেতার চরিত্র ছিল তার মাঝে।’

মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মিজানুর রহমান চৌধুরী চাঁদপুর সদর-হাইমচর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁকে পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। পঁচাত্তরের পর মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৭৯ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী দলবদল করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে জনদল প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। পরের বছর তিনি দলটির মহাসচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে তাঁকে ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। তিনি এরশাদের সামরিক সরকারকে সমর্থন করে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদণ্ডসদস্য নির্বাচিত হন। তাঁকে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয়। ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৯১ সালের উপনির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ’৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হয় এবং হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে যান। মিজানুর রহমান চৌধুরী তখন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি জাতীয় পার্টিতে শেষ পর্যন্ত থাকেননি। তিনি ২০০১ সালের ২৭ আগস্ট পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি আমৃত্যু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী বাগ্মী মানুষ ছিলেন। তাঁর বক্তব্যে মানুষ মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ হতো। তিনি সাহিত্যমনস্কও ছিলেন। তাঁর লেখা রাজনীতির তিনকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। কবিতার লেখারও অভ্যেস ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে জানা যায়, জেলে থাকতে কবিতা লিখে তিনি বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বরেণ্য এ রাজনীতিবিদ পরপারে পাড়ি জমান।

সূত্র :

১. কারাগারের রোজনামচা,শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ২০১৭, পৃ. ১১৭ ও ২২৩

২. রাজনীতির তিনকাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, অনন্যা প্রকাশনী, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৫

৩. কেলেঙ্কারির গুজবেই পদত্যাগ মিজান চৌধুরী, নঈম নিজাম, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ জুলাই ২০১৫

৪. জননন্দিত নেতা মিজান চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহান, দৈনিক সংবাদ, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

৫. মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাপিডিয়া

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়