রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

উন্নয়নের বাতি ও আমাদের গবেষণা

অধ্যাপক ড. মোঃ নাছিম আখতার
উন্নয়নের বাতি ও আমাদের গবেষণা

চীনা তরুণ গবেষকদের একটি দল এমন এক ধরনের কাপড় আবিষ্কার করেছে, যা মানুষকে ক্যামেরার চোখে অদৃশ্য করে তোলে। ইনভিস ডিফেন্স নামের এই কাপড় দেখতে খুবই সাধারণ এবং দামেও সস্তা। গবেষকদের দাবি, এই কাপড় খালি চোখে দেখা গেলেও কোনো ক্যামেরা দিয়ে এটিকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। পোশাকটিতে এমন এক ধরনের ক্যামো ফ্ল্যাশ প্যাটার্ন আছে, যা ক্যামেরার অ্যালগরিদমকে বিভ্রান্ত করে দেয়। ফলে এটি পরিহিত কাউকে ক্যামেরা শনাক্ত করতে পারে না। আবার রাতের বেলায় ক্যামেরা মানুষের দেহের তাপমাত্রা শনাক্ত করার মাধ্যমে মানুষের দেহ শনাক্ত করে। কিন্তু ইনভিস ডিফেন্সের অনিয়মিত আকারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক মডিউলগুলো একধরনের অস্বাভাবিক তাপমাত্রার প্যাটার্ন তৈরি করে, যা ইনফ্রারেড ক্যামেরাকেও বিভ্রান্ত করে তোলে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো, পোশাকে ক্যামো ফ্ল্যাশ প্যাটার্ন ও তাপমাত্রার অস্বাভাবিক প্যাটার্ন- দুটি বৈশিষ্ট্যই পোশাকের অভ্যন্তরীণ গাণিতিক ভৌত মডেলের পরিবর্তন।

শুধু কি তাই? কোনো বাণিজ্যিক পণ্যের প্রতি বছরে যে নতুন মডেল তৈরি হয়, সেটিও কিন্তু ঐ পণ্যের গাণিতিক মডেলের পরিবর্তন। কোনো গাড়ির মডেল পরিবর্তন করলে গাড়িটি চলার পথে বাতাসে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তার জ্বালানি খরচ বাড়বে কি না, গাড়িটির ভরকেন্দ্রের স্থান পরিবর্তন হয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হবে কি না, পরিবর্তিত মডেল বাতাসের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে কি না, সবকিছুই গাণিতিক সূত্রের সূক্ষ্ম হিসাব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল বিষয়গুলো হলো প্রোগ্রামিং, সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম, ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রভৃতি। এগুলোর উৎকর্ষ ও পরিবর্তন সাধনেও গণিতের জ্ঞান অপরিহার্য। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রসৈনিক হতে গণিতের উৎকর্ষ সাধনের কোনো বিকল্প নেই।

সেই গণিতেই আমরা দিনে দিনে সামগ্রিকভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছি। ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১০টি বোর্ডে মোট ফেল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৬২৭ জন। ফেল করা শিক্ষার্থীদের ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০২ জন, অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী গণিতে অকৃতকার্য হয়েছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণিতে দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফলের পেছনে মুখ্য কারণ।

একটি পরিসংখ্যান বলছে, মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় গণিত শিক্ষকের মোট সংখ্যা ৬৪ হাজার ১৪৭। তাদের মধ্যে গণিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৩৬, যা মোট শিক্ষকের ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৪ হাজার ৬৪০ জন, যা মোট শিক্ষকের ৭.২৪ শতাংশ। সে অনুযায়ী গণিতের শিক্ষকদের মধ্যে বিষয়টিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন মাত্র ১৩.২২ শতাংশ, অর্থাৎ গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বিষয়টি শেখাচ্ছেন ৮৬.৭৮ শতাংশ শিক্ষক। আমার মতে, কোনো একটি বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই শিক্ষকদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করার সুযোগ দেওয়া উচিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এতে মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত শিখনের মান বাড়বে।

বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণিতে এ প্লাস পাওয়ার পরেও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের মানবিক গ্রুপে চলে যাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে, যা গণিতের প্রতি শিক্ষার্থীদের ভীতিকে প্রকাশ করে। কোনো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় এ ইউনিটে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৯৯ জন। উপস্থিতির সংখ্যা ১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯১ । সবাই বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েও গণিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে ৬৮ হাজার ২৬৪ জন। শতকরা হিসাবে যা ৪৫ ভাগ। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে গণিতে মোট নম্বর ছিল ২৫। পরীক্ষায় ২০ বা ২০-এর বেশি নম্বর পেয়েছে মাত্র ১৬ জন পরীক্ষার্থী। ১৫ বা ১৫-এর বেশি পেয়েছে ৮০৬ জন। ১০ বা ১০-এর বেশি পেয়েছে ৭ হাজার ১২ জন। ৫ বা ৫-এর বেশি পেয়েছে ২৭৫৭১ জন। শূন্য বা শূন্যের বেশি পেয়েছে ৬২ হাজার ১৬ জন। ঋণাত্মক নম্বর পেয়েছে অনেকেই। কারণ এখানে প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য দশমিক ২৫ মাইনাস নম্বর রয়েছে। এখান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো শতকরা ৫৫ ভাগ এইচএসসি বিজ্ঞান শিক্ষার্থী অঙ্ক বিষয় নিয়ে প্রত্যয়ী নয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বইপ্রেমী জাতি সৃষ্টি করতে হবে। সম্প্রতি ‘সিইও ওয়ার্ল্ড’ ম্যাগাজিনের জরিপে বছরে গড়ে ১৬টি বই পড়ে ভারতীয়রা পড়ুয়া জাতি হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে অবস্থান করছে। তালিকাটিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৭তম। ম্যাগাজিনটির তথ্যমতে একজন বাংলাদেশি প্রতি বছর গড়ে বই পড়ে ২.৭৫টি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার যে সৃজনশীল পদ্ধতি ছিল, তা আমাদের শিক্ষার্থীদের ভীষণভাবে বইবিমুখ করেছিল। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি না হয়ে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল গাইড বা নোট বইয়ের সঙ্গে।

শিক্ষার অনুকরণে ক্ষয়িষ্ণু ঢেউয়ের দর্শন অনুসরণীয়। রিপল ওয়েভ বা ক্ষয়িষ্ণু ঢেউ। এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ছেলেবেলায়। খেলার ছলে পুকুরে ঢিল ছুড়ে ঢেউ সৃষ্টি করেনি এমন ছেলেবেলা কমই আছে। পুকুরের মধ্যে যখন ঢিল ছুড়ে ঢেউ সৃষ্টি করা হয়, ঐ ঢেউ বৃত্তাকার আকৃতিতে পুকুরের ধারে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। এ ধরনের ঢেউকে ক্ষয়িষ্ণু ঢেউ বলে। ঢেউ সৃষ্টি ও নিঃশেষ হওয়ার মধ্যে একটি সময় অতিবাহিত হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরেই ঢেউটা নিঃশেষ হয়ে যায়। তেমনি কোনো দেশের বর্তমান সমৃদ্ধি কিন্তু অন্তত ২০ বছর আগে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ার ফল। কোনো দেশের শিক্ষাকে অনুসরণ করতে গেলে অন্তত ১৮ থেকে ২০ বছর আগের সিস্টেমকে অনুসরণ করা উচিত। কারণ আজকে আমরা যাদের ঐ দেশের স্মার্ট, প্রজ্ঞাবান গ্র্যাজুয়েট হিসেবে দেখছি, তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল ১৬ বছর আগে।

বিশ্ব গণিত অলিম্পিয়াডে চীন ২৩ বার, রাশিয়া ১৬ বার ও আমেরিকা ৮ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমরা আমাদের গণিত শিক্ষার উন্নয়নে আউটসোর্সিং করতে পারি। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, সর্বত্রই তৈরি করতে হবে বই পড়ার সংস্কৃতি। তবেই জাতি হিসেবে বিশ্বজয়ের মূলমন্ত্র সত্যিকার অর্থেই কার্যকর হবে।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়