রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

স্কুল-কলেজ কার্যকর সামাজিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুযোগ আছে

সরকার আবদুল মান্নান
স্কুল-কলেজ কার্যকর সামাজিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুযোগ আছে

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস সুপ্রাচীন। সেই আদিকাল থেকে কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা জরুরি হয়ে উঠেছিল? শুধু কিছু মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য, নাকি এর সঙ্গে অন্য কোনো উদ্দেশ্য, অন্য কোনো লক্ষ্য, অন্য কোনো আদর্শ নিহিত ছিল? ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা লক্ষ করি, যে সমাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেই সমাজ নানাভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে, সেই সমাজ আলোকিত সমাজ হয়ে ওঠে। তার মানে সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভীর সংযোগ আছে। নিক্তিতে মেপে মেপে এই সংযোগের বা সমৃদ্ধির পরিমাপ নির্ধারণ করা না গেলেও আমরা স্পষ্টতই অনুভব করি যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ সংগঠন বিনি সুতোর মালায় গাঁথা।

ষাট ও সত্তরের দশকের কথা। তখন ছোট-বড় খালের উপর বাঁশের অথবা কাঠের সাঁকো বা পুলের ব্যবস্থা থাকত। অনেক সময় দেখা যেত, বাঁশ বা কাঠ সরে গেছে। কিংবা পুলের পাটাতন খসে পড়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে অঞ্চলের লোকজনের চলাচলের জন্য এইসব সাঁকো বা পুল খুবই জরুরি ছিল। আর তখনই দেখা যেত, সাঁকো বা পুলগুলো ঠিকঠাক নেই।

তখনো এলাকায় চেয়ারম্যান ছিলেন, মেম্বার ছিলেন। কিন্তু এইসব বিষয় নিয়ে তারা খুব ভাবিত থাকতেন, এমনটা মনে হয়নি। কোথাও কোনো খাল বা নালার উপর সাঁকো স্থাপন বা পুল নির্মাণের বিষয়ে চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের তেমন কোনো কার্যক্রম মনে করতে পারছি না। এ সব করতেন সমাজের লোকজন। বিশেষ করে স্কুল ও কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা উদ্যোগী হয়ে নানাজনের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে, পাটের রশি বা গুনা সংগ্রহ করে সাঁকো মেরামত করত কিংবা পুলের পাটাতন ঠিকঠাক করত। এদের সঙ্গে যুক্ত হতেন এলাকার অনেক লোক। সেই সময় কিংবা তারও আগে থেকে এলাকার স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসা এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতেন এলাকার মানুষ। বিশেষ করে অবস্থাসম্পন্ন মানুষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতো স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, গীর্জা ইত্যাদি। অনেক পরে বুঝেছি, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব সমাজের মানুষের। স্কুল, মাদরাসা বা মক্তবের শিক্ষক কিংবা মসজিদের ইমামের সঙ্গে তখন সমাজের বন্ধন ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কেউই মনে করতেন না যে, এরা আলাদা মানুষ, এদের সুবিধা-অসুবিধা সবই আলাদা। এর জন্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এমনটা শৈশবে কখনোই লক্ষ করিনি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা স্কুল শিক্ষক বা মসজিদণ্ডমাদরাসার ঈমাম ও শিক্ষকগণের থাকাণ্ডখাওয়ার ব্যবস্থা তখন সমাজের লোকজনই করতেন। মসজিদের ইমামের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা এখনো গ্রামে আছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তখন সমাজের মানুষের যে সম্পর্ক স্থাপিত ছিল, তার কোনো তুলনা চলে না। স্কুলে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং অন্য কোনো অনুষ্ঠানের দিনগুলোতেও দেখা যেত সমাজের অনেক মানুষ অংশগ্রহণ করছেন।

পরবর্তীতে যখন সরকারের অর্থায়নে ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত হতে থাকল, তখন আস্তে আস্তে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ছাড়া সমাজের আধিকাংশ মানুষ দূরে সরে যেতে থাকল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তৈরি হতে থাকল তাদের দূরত্ব। এখন এই দূরত্ব দূরপনেয়। এখন অধিকাংশ মানুষ মনে করে না যে, বিদ্যালয়গুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান, এগুলোর ভালো-মন্দের সঙ্গে সমাজের মানুষের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কিত। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকও এখন তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর সামাজিক প্রতিষ্ঠান মনে করেন না। তারা মনে করেন, এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারেরই দায়-দায়িত্ব হলো এগুলোর ভালো-মন্দ দেখা, সুবিধা-অসুবিধা দেখা। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও যে সামাজিক দায়দায়িত্ব অছে তার তেমন কোনো নজির এখন আর দেখা যায় না।

পৃথিবীর সব দেশেই সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আর সেই সীমাবদ্ধতা হলো প্রক্রিয়াগত, পদ্ধতিগত এবং নীতিনির্ধারণগত। সরকার কখনই চট করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না এবং বাস্তবায়নও করতে পারে না। কারণ কতগুলো বিধিবিধান, আইনকানুন ও পদ্ধতির ভেতর দিয়ে সরকারকে এগোতে হয়। কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি কর্মকর্তাগণকে পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে, অনেকগুলো ধাপ ও কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুতরাং তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠেনা।

এই জন্যই রাস্তাঘাট, পুল বা সাঁকো ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে সমাজের মানুষের সঙ্গে এইসব প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে এইসব প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা ও সমস্যাদির বিষয়ে সমাজ দায়িত্ব পালন করতে পারে। এবং বিপরীতক্রমে সমাজে এমন কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখতে পারে।

কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় এই যে, কাগজে-কলমে পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক একটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ফলে সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবিড় সংযোগের ভেতর দিয়ে পরস্পরের সমৃদ্ধির যে পরিবেশ তৈরি হতে পারত, তা হয়নি।

গত তিন-চার দশকে সমাজের বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সারা পৃথিবীতে। বিজ্ঞান ও পুঁজির প্রভাব গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছে। ফলে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন এসেছে শিক্ষাক্রমে ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায়। আমাদের দেশেও শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবর্তন আনা হয়েছে শিক্ষাক্রমে ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে।

পরিমার্জিত এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা গেলে শিখন-শেখানো কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সমাজের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার সুযোগ আছে। এই সুযোগ একদিকে বিদ্যায়তনিক এবং অন্যদিকে সামাজিক। ধারাবাহিক মূল্যায়নগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে যতনা পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রিক বা পাঠ্যপুস্তকের কন্টেন্ট ভিত্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি কন্ট্যাকচুয়াল। অর্থাৎ পাঠের সঙ্গে সম্পর্কিত বিচিত্র সমকালীন বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেমন সমাজের কিছু শিক্ষার্থী কেন উশৃঙ্খলা আচরণ করে, কেন তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, কেন তারা ইভটিজিং-এর আশ্রয়, সন্ত্রাশ ও জঙ্গীবাদের আশ্রয় নেয়- এইসব বিষয় থেকে শুরু করে সমাজের মানুষের সংস্কৃতি সচেতনতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবেশ সচেতনতা, দেশপ্রেম এবং বিষয়ভিত্তিক নানা বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের আয়োজন করা হয়েছে। এই মূল্যায়নগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে করতে গেলে শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্ট তৈরি করতে হবে, প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে, ছোটখাট গবেষণা করতে হবে, প্রবন্ধ লিখতে হবে, নাটিকা তৈরি করতে হবে, পোস্টার বানাতে হবে, বিতর্কের আয়োজন করতে হবে। এর জন্য পরিবার-পরিজনের কাছে, হাটবাজারে, কৃষক-শ্রমিকদের কাছে অর্থাৎ সমাজের মানুষের কাছে যেতে হবে তাদের। ফলে অনিবার্যভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমাজের একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে করে একদিকে উপকৃত হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীরা জীবনঘনিষ্ঠ মানুষ হওয়ার সুযোগ লাভ করবে, দেশের মানুষকে এবং দেশকে ভালোবাসতে শিখবে এবং অন্যদিকে সমাজের মানুষ নানাভাবে সচেতন হয়ে উঠবে। তারা স্বাস্থ্যসচেতন হবে, পরিবেশ সচেতন হবে, বিজ্ঞানমনস্ক হবে, সংস্কৃতি সচেতন হবে এবং আর্থিকভাবেও তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সুতরাং স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজ ও জীবনবিচ্ছিন্ন কোনো ইট-পাথরের ঘরবাড়ি নয়। বরং সমাজের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিবিড়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজকে আলোকিত করে, সমাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। পারস্পরিক এই মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জাতিগত উন্নয়নের টেকসই রোডম্যাপ তৈরি হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়