প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষাক্রমে কগনিটিভ স্কিলস চর্চা
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো, কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে এর অন্তর্নিহিত মর্ম অনুধাবন করা এবং বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ করে জীবনের চাহিদা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করা, বায়োলজিক্যাল ভাষায় এগুলোকে বলা হয় কগনিটিভ স্কিলস বা জ্ঞানীয় দক্ষতা, যা কোনো সমস্যা বিশ্লেষণ করে সমস্যার সমাধান করার সক্ষমতা শেখায়
যে শিক্ষার্থীটি ক্লাসে প্রথম কিংবা ফলাফল আরো ভালো করার জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে, সেই ছেলেটির প্রতি সবার সুদৃষ্টি থাকে; বিপরীতে যেই ছেলেটি নিয়মিত ক্লাসে আসে না, ভালো রেজাল্ট করতে পারে না, ক্লাসে চুপচাপ পেছনের বেঞ্চে বসে থাকে, তাকে কেউ ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু কেন একজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করে, আরেকজন অমনোযোগী, কেন এমনটি ঘটে, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? যে ছেলেটি ক্লাসে প্রথম কিংবা অঙ্কে-ইংরেজিতে পটু, সে কি ভালো দৌড়? কিংবা ক্রিকেট খেলতে পারে? যে বায়োলজি কিছুই বোঝে না, সে কি ভালো বক্তৃতা দিতে পারে? যে ক্লাসের শেষের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকে, সে কি ভালো অভিনয় করতে পারে, গান গাইতে পারে? আবার যে শিক্ষার্থীটি গণিত ও জ্যামিতি বোঝে না, সে হয়তো বক্তৃতায় পটু কিংবা সাংগঠনিক দক্ষতায় পারদর্শী, এর বিপরীতে পেছনের বেঞ্চে বসা ছাত্রটিকে কী ব্যবস্থা নিলে সামনের বেঞ্চে বসা ছেলেটির মতো তৎপর হবে কিংবা তার অঙ্কে দুর্বলতা কাটানোর পন্থা বাতলিয়ে দেওয়া কিংবা ড্রয়িংয়ে অনাগ্রহ ছাত্রটিকে অঙ্কনে সহায়তা করা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনিময়ের প্রবণতা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় খুব একটা কার্যকর ছিল না, পয়সার বিনিময়ে শিক্ষকের কাছে কোচিং করে গলাধঃকরণ করা, পয়সা না থাকলে স্কুল থেকে ছিটকে পড়া, মেধা না থাকা সত্ত্বেও ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাধ্য করা, কোনো রকমে লেখাপড়া শেষ করে বাবার অফিসে উচ্চ বেতনে এমডি হওয়া, আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া ইত্যাদি অসংগতি আমাদের সমাজে খুবই বিদ্যমান। আসলে এই প্রত্যেকটি বিষয়ই মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলো অর্জনে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কগনিটিভ স্কিলস বা জ্ঞানীয় দক্ষতা অপরিহার্য।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো, কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে এর অন্তর্নিহিত মর্ম অনুধাবন করা এবং বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ করে জীবনের চাহিদা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করা, বায়োলজিক্যাল ভাষায় এগুলোকে বলা হয় কগনিটিভ স্কিলস বা জ্ঞানীয় দক্ষতা, যা কোনো সমস্যা বিশ্লেষণ করে সমস্যার সমাধান করার সক্ষমতা শেখায়, জ্ঞানীয় ক্ষমতাকে কখনো কখনো সমষ্টিগতভাবে জ্ঞানীয় বুদ্ধিমত্তা বা জ্ঞানীয় চিন্তা বলা হয়, এই ক্ষমতার বলেই মানুষ বিশ্বের ঘটনাবলি উপলব্ধি করতে পারে, ঘটনাপ্রবাহ মনে রাখতে ও ফোকাস করতে পারে এবং পরবর্তীকালে স্থান-কাল-পাত্র বুঝে ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। প্রত্যেকটি মানুষের এরকম বেশ কয়েকটি জ্ঞানীয় ক্ষমতা থাকতে পারে, যেমন :মনোযোগ, স্মৃতি, যুক্তি, শ্রবণ এবং ভিজ্যুয়াল প্রক্রিয়াকরণ। মনোযোগ হলো একটি নির্দিষ্ট কাজে মনোনিবেশ করার জ্ঞানীয় ক্ষমতা। এটি একটি প্রকল্প, সিদ্ধান্ত, বা সমস্যার ওপর একজন ব্যক্তির নির্বাচিত ঘনত্বকে বোঝায়। এটি বাহ্যিক উদ্দীপনা দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে একই সঙ্গে একাধিক কাজের ওপর ফোকাস করার ক্ষমতাকেও বোঝায়, যা টেকসই সময়ের জন্য মনোযোগে শৃঙ্খলা, ফোকাস এবং সচেতনতার পরিপূরক। এটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি মূল্যবান জ্ঞানীয় ক্ষমতা, যা তাদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অর্জনে সহায়তা করে।
স্মৃতি (মেমরি) হলো তথ্য শনাক্তকরণ, সংরক্ষণ এবং ধরে রাখার প্রক্রিয়া। এটি স্পষ্টভাবে ও সঠিকভাবে তথ্য স্মরণ করার জ্ঞানীয় ক্ষমতা। শক্তিশালী স্মৃতিসহ শিক্ষার্থীরা দ্রুত তারিখ, সংখ্যা এবং পূর্বে শেখা তথ্য উল্লেখ করতে পারে। উপরন্তু, তারা মনে রাখতে পারে, কীভাবে নির্দিষ্ট কাজগুলি সম্পন্ন করতে হয় এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে জানানোর জন্য পরিস্থিতি নেভিগেট করতে হয়। আর যুক্তি হলো, কোনো সমস্যার মাধ্যমে চিন্তা করার এবং তার সমাধান করার জন্য কৌশল ব্যবহার করার ক্ষমতা। শিক্ষার্থী তার বিশ্লেষণ, সাধারণ জ্ঞান এবং সংযোগ তৈরির মাধ্যমে অন্য এমন একটি নতুন তথ্যের সেট তৈরি করতে সক্ষম হয়, যা পরবর্তীকালে অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে। শ্রবণ ও ভিজ্যুয়াল প্রক্রিয়াকরণ হলো একজন ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ও শব্দের মাধ্যমে তথ্য ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা। অন্য কথায়, আমরা যা দেখি ও শুনি, তা বোঝার ক্ষমতা। একজন শিক্ষার্থীর ভিজ্যুয়াল প্রসেসিং ক্ষমতা প্রভাবিত করে যে, তারা ছবি, শব্দ ও চিহ্নগুলিকে কতটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, এগুলো পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করার জন্য নতুন কারিকুলামে সংযুক্ত করা হয়েছে, পোস্টার প্রেজেন্টেশন। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রেজেন্টেশনের সঙ্গে পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গিয়ে। তাই শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে প্রেজেন্টেশন দিয়ে অভ্যাস না থাকায়, অনেকেরই প্রেজেন্টেশনে ভীতি কাজ করে। নতুন শিক্ষাক্রমে পোস্টার প্রেজেন্টেশন যুক্ত করার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পাবলিক স্পিকিং বা সবার সামনে কথা বলার জড়তা দূর করা। ফলে এই পোস্টার প্রেজেন্টেশনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
শিক্ষাক্রমের আরেকটি প্রধান উপকরণ হচ্ছে, দলগত ব্যাবহারিক কাজ, দলগত ব্যাবহারিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আরো কার্যকরভাবে শিখতে সাহায্য করে। কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে একজন মানুষ কোনো কিছু পড়া বা শোনার চেয়ে কাজের মাধ্যমে আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য মনে রাখতে পারে। এইসব কগনিটিভ স্কিলস বা জ্ঞানীয় দক্ষতা জীবনের প্রাথমিক স্তরে বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে, পড়তে, শিখতে, যুক্তি দিতে, মনোযোগ দিতে ও মনে রাখতে সহায়তা করে। এই দক্ষতাগুলো আগত তথ্য প্রক্রিয়া করতে এবং মস্তিষ্কের উপযুক্ত এলাকায় বিতরণ করতে সহায়তা করে। এগুলোর উন্নতি ও আয়ত্ত করার ফলে সমস্যা সফলভাবে বুঝতে ও সমাধান করতে সক্ষম করে, যা পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে কাজে লাগাতে পারে; তবে এগুলোর কোনোটা কারো জন্য প্রবল, আবার কোনোটা দুর্বল। প্রবলগুলোর জন্য তার পারফরম্যান্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভালো হয়, দুর্বলগুলো পরিচর্যা ও সাধনা করে প্রবল করতে হয়। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এইগুলোর শিমুলেশন বা প্রক্রিয়াকরণ দেখানো হয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে অভিনয়, অডিও-ভিডিও ও মালটিমিডিয়ার মাধ্যমে। এ ধরনের পারিপার্শ্বিক ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার সব সুযোগ রাখা হয়েছে বর্তমান শিক্ষাক্রমের প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ পর্যায়ে কগনেটিভ চর্চার মাধ্যমে; তাই নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে বদলে গেছে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, পাঠ্যবই, পরীক্ষা ও মূল্যায়নপদ্ধতিসহ আরো অনেক কিছু। কগনিটিভ স্কিলসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে নতুন কারিকুলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের প্রতি। তারা যেন ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করতে পারে, বাড়ির কাজেরও যেন অতিরিক্ত চাপ না থাকে, সারা দিন কোচিংয়ের পেছনে দৌড়ে সময় নষ্ট না করতে হয় এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে পারে, ইত্যাদি মজাদার ও আকর্ষণীয় বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে; তাই আশা করা যাচ্ছে, নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু জানার, শেখার এবং নতুন চিন্তাধারার পথ দেখাবে।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।