শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

উচ্চশিক্ষার সুষম উন্নয়নে করণীয়

অধ্যাপক ড. মোঃ নাছিম আখতার
উচ্চশিক্ষার সুষম উন্নয়নে করণীয়

জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির ওপর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই নির্ভরশীল। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে নির্ভর করে পৃথিবীতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ্বের অন্য দেশগুলোর নিরন্তর চেষ্টা চোখে পড়ার মতো। উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নিতে ভারত ৫ হাজার ২৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। ৩ হাজার ২১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় অবস্থানে, ২ হাজার ৫৯৫টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে ইন্দোনেশিয়া তৃতীয় অবস্থানে, ২ হাজার ৫৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চীন চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। একইভাবে ব্রাজিল ১ হাজার ২৯৭টি, মেক্সিকো ১ হাজার ১৭৩টি, জাপান ১ হাজার ৬৩টি, রাশিয়া ১ হাজার ৫৪টি, ইরান ৭০৪টি ও ফ্রান্স ৬১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যথাক্রমে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম এবং দশম অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংখ্যিক পরিসংখ্যান থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সরকার শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশে মোট ৫৮টি পাবলিক ও ১১৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে, যা উচ্চশিক্ষার প্রসারে বর্তমান সরকারের দূরদর্শিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে দেশের জেলায় জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের আরও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

তারপরও সমালোচকরা প্রায়ই বলেন, উচ্চশিক্ষার মান একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কি তাই? ২ এপ্রিল ২০২৩, জাতীয় একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনামণ্ড ‘বাংলাদেশের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রাইস ইউনিভার্সিটিতে বিশেষ সুযোগ’। খবরে প্রকাশ ভিনদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সাধারণত ইংরেজিতে ভাষা দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইইএলটিএস, স্যাট বা টোয়েফলের মতো পরীক্ষা দিয়ে নির্ধারিত স্কোর অর্জনকারী বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে; কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের রাইস ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিধারীরা কোনো ইংরেজি টেস্টের স্কোর ছাড়াই আবেদন করতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খবরটি ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের গ্র্যাজুয়েটদের মান সম্পর্কে রাইস বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের পাঁচটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৪৭তম অবস্থানে থাকা রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়।

আমাদের দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে মোট ১৭২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষক হিসেবে আমি আশা করতেই পারি যে, ১৭২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটির শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে ভাষা দক্ষতার পরীক্ষা ছাড়াই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য আবেদন করতে যোগ্য বিবেচিত হবে। এমন ইতিবাচক ইচ্ছা পূরণের বিষয়টির প্রায় সবটুকুই নির্ভর করে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ওপর।

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট গ্রহণ করে তখন তার গবেষণা করার সক্ষমতা তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি মানেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানের বৈশ্বিক স্বীকৃতির মাধ্যমে কোনো জ্ঞানার্জন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কাজ নিয়ে সাধারণত গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়ে থাকে। গবেষণা হলো জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য করা সৃজনশীল এবং পদ্ধতিগত কাজ। গবেষণায় একটি বিষয়কে বোঝানোর জন্য প্রমাণ সংগ্রহ, সংগঠন ও বিশ্লেষণ করা হয়। এতে পক্ষপাত এবং ত্রুটির উৎস নিয়ন্ত্রণ করার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো বাস্তবিক কোনো সমস্যার সমাধান করা। গবেষণা একটি ধারাবাহিক কার্যপ্রক্রিয়া, যা নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। একটি গবেষণা প্রকল্প অতীতে সম্পন্ন কোনো কাজের সম্প্রসারণ হতে পারে। গবেষণায় কোনো যন্ত্র, পদ্ধতি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈধতা যাচাই করার জন্য পূর্বের প্রকল্পের উপাদান বা সমগ্র প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি করা যায়।

গবেষণার জন্য প্রস্তুত প্রত্যয়ী স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী তৈরিতে অনার্স কোর্স চলাকালীন চার বছরের সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চার বছর কোর্সের বিষয়ভিত্তিক প্রতিটি সিলেবাসের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানে কোনো দুর্বলতা না রাখা প্রত্যয়ী স্নাতক ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েট তৈরির পূর্বশর্ত। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে সেখানে কীভাবে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া হয় সে বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল। কোনো বিভাগের প্রতিটি বিষয়ের তত্ত্বীয় পাঠ্যক্রমকে সমান দুভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি ভাগ পাঠদানের জন্য একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়ভিত্তিক ব্যবহারিক ক্লাসও ওই দুই শিক্ষকই পরিচালনা করেন। ফলে একজন কোনো কারণে ছুটি নিলে বা অসুস্থ হলে উনার সময়ে অন্য শিক্ষক ক্লাসটি চালিয়ে নিতে পারেন। আবার ছুটিতে থাকা শিক্ষক ফিরে এসে অন্য শিক্ষকের শ্লটগুলোতে ক্লাস নিয়ে পুষিয়ে দিতে পারেন। এতে শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এবং বিষয়ভিত্তিক তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানে ঘাটতি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। সেখানে বছরে দুই সেমিস্টারের পদ্ধতিতে ১৪ সপ্তাহে একটি সেমিস্টারের পাঠদান শেষ হয়। এমন আঁটসাঁট রুটিনে যদি প্রত্যেক বিষয়ে দুই শিক্ষক পাঠদানের দায়িত্বে নিয়োজিত না থাকেন তাহলে শিক্ষকের ছুটিজনিত বা অসুস্থতাজনিত কারণে ক্লাসে অনুপস্থিতির পর মেকআপ ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করা বাস্তবে সম্ভব নয়। আমার মতে, বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যক্রমের পাঠদান এভাবে এগিয়ে নেওয়া হলে পাবলিক, প্রাইভেট প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটবে।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে; কিন্তু বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান ও শিক্ষার মানোন্নয়নে সন্তোষজনক অবস্থানে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। অনেক জায়গায়ই শিক্ষকগণকে পাঠদান ও পরীক্ষার মূল্যায়নে নমনীয় হতে হয়। ফলে উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন সার্বিকভাবে ব্যাহত হয়।

নতুনভাবে স্থাপিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদের শিক্ষক বিজ্ঞপ্তি দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অধ্যাপনায় আগ্রহী অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের একটি তালিকা রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। সেখান থেকে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনমতো চুক্তিভিত্তিক অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রাখা যেতে পারে। এতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমৃদ্ধ হবে এবং দেশের মেধাবী প্রবীণ অধ্যাপকদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। উচ্চশিক্ষার সুষম উন্নয়নকল্পে ইতোমধ্যে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি। সংখ্যার বিচারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দ্বিগুণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তাই উচ্চশিক্ষার সুষম উন্নয়নে পাবলিক, প্রাইভেট উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণার উন্নয়ন সাধন একান্ত জরুরি।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়