প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
নতুন কারিকুলাম : স্বপ্নের প্রজন্ম গড়ার রূপরেখা
একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার হলো শিক্ষাব্যবস্থার যুগোপযোগী রূপান্তর। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। চলতি বছরে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে সমগ্র বাংলাদেশে একযোগে নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম চলমান এবং আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মধ্য কার্যক্রমের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। এটি ২০২২ সাল থেকে পাইলটিং শুরু হয়ে ২০২৭ সালে গিয়ে পূর্ণ বাস্তবায়নের পর্যায়ে যাবে।
একটি দেশের কালচার, কাস্টম, বোধগম্যতা, বিশ্বাস, বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে সে দেশের শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। সেই লক্ষ্যকে স্থির করে এই কারিকুলামের উদ্দেশ্যে হলো : মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ড. লুৎফর রহমান বলেছিলেন, ‘যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত’। এখানে শিক্ষিত বলতে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যোগ্যতা। আর সেই যোগ্যতার চারটি উপাদান হলো : জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ।
যোগ্যতার প্রথম উপাদান হলো জ্ঞান। জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করে যে বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে তা হলো বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, আন্তঃবিষয়ক জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক বিশেষ জ্ঞান এবং পদ্ধতিগত জ্ঞান। দক্ষতার সাথে যেই গুণাবলি সম্পৃক্ত সেগুলো হলো শিখতে শেখার দক্ষতা, ব্যবহারিক ও সামাজিক দক্ষতা, ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের দক্ষতা এবং মৌলিক দক্ষতা। উক্ত বিষয়গুলো সাথে অন্তর্নিহিত হলো সূক্ষ্ম চিন্তন ও সৃজনশীল প্রতিভার সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হওয়া। আর দৃষ্টিভঙ্গি হলো নিজের এবং ইতিবাচক সামাজিক রীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণায়নের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস রাখা। মূল্যবোধ হলো লেইটেস্ট সংযোজিত যোগ্যতার সর্বশেষ উপাদান। দেশপ্রেম, শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, সংহতি, শুদ্ধাচার এবং বৈচিত্রের প্রতি সহমর্মিতা এগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় আমাদের মূল্যবোধের ভিত্তিপ্রস্তর। এই গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে দেশের মানুষ হবে স্মার্ট সিটিজেন আর স্মার্ট সিটিজেনের হাত ধরে তৈরি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।
এই শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে থাকছে না কোনো প্রতিযোগিতামূলক নম্বর বা জিপিএভিত্তিক শিখন যাচাইপ্রক্রিয়া। পরীক্ষাকেন্দ্রিক সনদের পরিবর্তে পারদর্শিতা সনদের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের পরিমাপ নিশ্চিত করা যাবে। পুরো মূল্যায়নে ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপস নামক টেকনোলজির ব্যবহার করা হচ্ছে। সামষ্টিক মূল্যায়নগুলো ও গতানুগতিক লিখিত পরীক্ষার বদলে অভিজ্ঞতাভিত্তিকই হবে। আর এই মূল্যয়ন প্রক্রিয়াকে ফলপ্রসূ করতে হলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা অত্যাবশ্যক।
নতুন কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তকের কন্টেন্টগুলো এতো চমৎকারভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে, যা দেখে সত্যি আমি অভিভূত। আমি যখন নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তখন আমার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হলো যদি আমি এই কারিকুলামের একজন শিক্ষার্থী হতে পারতাম! তাহলে জীবনকে আরো রাঙিয়ে তুলতে পারতাম।
শিক্ষার পাঁচটি স্তরের মধ্যে সেকেন্ডারি স্তরে যেই বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের জানা অপরিহার্য ছিল এক্সজেক্টলি সেই বিষয়গুলোকেই পাঠ্যপুস্তকের কন্টেন্টে তুলে ধরা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের ২০২৪ সালের ৮ম শ্রেণির ইংরেজি বই। যে বইয়ে পুরো সাহিত্য পড়ার কলাকৌশল, কীভাবে উচ্চতর একাডেমিক রাইটিং লিখতে হয়, প্যারাফ্রেইজিং, ডেসক্রিপটিভ রাইটিং, সামারাইজিংসহ সব ধরনের লেখার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এমনকি ভাষা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাজ ভাষাবিজ্ঞান অর্থাৎ ক্ষমতার সাথে ভাষা কীভাবে সম্পর্কযুক্ত সেই বিষয়গুলোও রয়েছে।
কোভিড-১৯ পেনডামিক এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লের প্রভাবে পৃথিবীতে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িছে এবং মানুষের অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়ছে। এই অনিশ্চয়তার পৃথিবীতে নতুন প্রজন্মকে তাল মিলিয়ে চলার জন্যে আমাদের আগের শিক্ষাব্যবস্থা কিছুতেই কার্যকরী নয়। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন করা হয়েছে।
কারিকুলাম বাস্তবায়নের সাথে শিক্ষকরা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। এই কারিকুলামে শিক্ষক একজন ফ্যাসিলিটেইটর ভূমিকা অবলম্বন করবে। তাই শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব তৈরি করা এবং দেশের মেধাবীদেরকে এই পেশায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলে নতুন শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের পথ একধাপ এগিয়ে যাবে।
এই সিলেবাস বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমার দৃঢ়প্রত্যয় এদেশের বাংলা মিডিয়াম আর ইংলিশ মিডিয়ামের পার্থক্য কমে আসবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েক বছরের সেরা বই হিসেবে মার্কিং করলে কম হয়ে যাবে, নবম শ্রেণিরটা আরো সুন্দর সুচারুভাবে সাজানো হয়েছে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা তাদের ম্যাডথ, টেকনিক ও অ্যাপ্রোচ প্রয়োগ করে পারদর্শিতাসম্পন্ন একটি প্রজন্ম উপহার দিবে। আর সেই প্রজন্মের হাত ধরেই ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ হবে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ।
মোঃ কামাল হোসেন : সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।