প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
সঠিক জীবনবোধই সফলতার সোপান
আপনি কেমন জীবন চান? স্রষ্টা যদি আপনাকে এই প্রশ্নটা করতেন এবং আপনাকে চারটি অপশন দিতেন, যার প্রত্যেকটি অপশনই কষ্টের। তাহলে আপনি কোন অপশনটি বেছে নিতেন? গভীরভাবে চিন্তা করুন, একটি বাচ্চা যখন স্কুলে যাচ্ছে, তখন সে স্কুলে যেতে চায় না। যিনি চাকরি করছেন, তার অফিসে যেতে ভালো লাগে না। কিন্তু বেকার থাকাটা আরও অনেক বেশি কষ্টকর। একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য গর্ভকালীন সময়টা খুবই কষ্টকর। অন্য একজন মহিলা যার কোনো সন্তান নেই, কিন্তু সন্তান চাচ্ছেন। সেটা তার জন্য আরও বেশি কষ্টকর। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখুন, দেখবেন আমাদের জীবনের অপশনগুলো সব সময় কষ্টের। তাহলে জীবনের কোন কষ্টটা নেব? বা আদৌ কষ্টটা নেব কেন? আমি কষ্টটা নেব, কারণ এ ছাড়া আমার কোনো বিকল্প নেই। আমি সেই কষ্টটাই নেব, যেটা আমার জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
তরুণ বয়সে অনেকেরই মনে হয়, পড়ালেখাটা অনেক কষ্টকর। কিন্তু এই কষ্টটা একজন মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। তাই এই কষ্ট করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। পড়া, লেখা, বই-জীবনের এই তিনটি অনুষঙ্গ শ্বাস, প্রশ্বাস ও অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনীয়। পড়া হচ্ছে শ্বাস নেয়া, লেখা হচ্ছে প্রশ্বাস, আর বই হচ্ছে অক্সিজেন। জীবকোষে অক্সিজেনের ঘাটতি হলে যেমন কোষে পচন ধরে, তেমনি বই পড়া কমিয়ে দিলে আত্মার পরিশুদ্ধতার পরিসমাপ্তি ঘটে। একজন শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের মধ্যে পার্থক্য হলো শিক্ষিত ব্যক্তি তার জ্ঞান, চিন্তাভাবনা, অভিব্যক্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করে যেতে পারেন; কিন্তু অশিক্ষিত ব্যক্তিরা তা পারেন না।
বই জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম কেন? একটি ভালো মানের বই লেখা নিরন্তর সাধনার বিষয়। এ কাজে লেখকের মাস, বছর, এমনকি যুগ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। বই অনুরাগী হলে সে বইটি আমরা দুই দিন থেকে ১ সপ্তাহের মধ্যে পড়ে শেষ করতে পারি। শেষ করার অর্থ হলো একজন জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ মানুষের বহুদিনের নিরবচ্ছিন্ন ভাবনার সংকলনকে আমরা নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলাম। শিক্ষকতা পেশায় আমি দীর্ঘদিন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ‘কোর্থ’-এর লেখা ‘ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বইটি পড়িয়েছি। বইটি লেখকের অনেক বছরের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক গবেষণার প্রতিফলন। অথচ মাত্র এক অ্যাকাডেমিক সেমিস্টারে লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ এই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদানের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। এর ফলে লেখকের বহু বছর ধরে গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীর মানসিক বয়সকে বাড়িয়ে দেয়। সে জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়।
শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিতে গিয়ে আমি শিক্ষার্থীদের প্রায়ই বলতাম, বই যত মোটা বা স্বাস্থ্যবান হোক না কেন তার মধ্যে মূল বিষয় বা চুম্বক অংশ থাকে ৩০ শতাংশ। আর ওই চুম্বক অংশ ফুটিয়ে তোলার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয় বাকি ৭০ শতাংশ। সুতরাং তোমাদের মনে রাখতে হবে ৩০ শতাংশ। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মন ওইভাবে ভাবতে শুরু করত। ফলে বই পড়াটা তাদের কাছে আনন্দঘন হয়ে উঠত। আমার মতে পাঠ্যবইকে পড়ে এর সারাংশ বের করতে পারাটাই সৃজনশীলতা।
ইতিহাস বলে, ইতিবাচক কর্মের দ্বারা সফল মানুষগুলো তাদের জীবদ্দশায় প্রচুর বই পড়তে পছন্দ করতেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বারো বছর বয়সে জীবনযুদ্ধে নামতে বাধ্য হন। পোর্ট হেরন থেকে ডেট্রয়েটের মধ্যে প্রতিদিন চলাচলকারী ট্রেনে তিনি খাবার ও পত্রিকা বিক্রি করতেন। ডেট্রয়েটে ট্রেনটি অনেকক্ষণ অবস্থান করত। সে সময় তিনি সেখানকার একটি লাইব্রেরিতে বসতেন এবং বই পড়তেন। এভাবে তিনি ওই লাইব্রেরির সমস্ত বই পড়ে শেষ করেছিলেন। তার প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূলে রয়েছে বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে আলো, বাতাস ও পানির প্রয়োজন। আর অন্তরকে বাঁচিয়ে রাখতে পড়াশোনার প্রয়োজন। অন্তরকে সজীব ও প্রসারিত রাখার মাধ্যম হলো শিক্ষা। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের মিলিওনিয়ার ও বিলিওনিয়ারদের শতকরা ৮৫ ভাগ প্রথম প্রজন্মের। শুধু ১৫ ভাগ উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী। প্রথম প্রজন্মের ধনীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘এত অল্প সময়ে কীভাবে আপনারা আর্থিক সফলতা অর্জন করেছেন’? তারা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা বই পড়ি’। ওয়ারেন বাফেট দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা বই পড়েন। বিল গেটস একজন ভালো পাঠক। ইলন মাস্ক রকেট সায়েন্সের বিদ্যা বই পড়ার মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। বই পড়া স্বল্প সময়ে অনন্য সাধারণ মানুষের ভাবনার সারাংশ আত্মস্থ করার মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ঘটায়। আলোকিত মন জীবন ধারণের জন্য যেকোনো ইতিবাচক সৃজনশীল কর্ম খুঁজে নিতে পারে।
আমরা বইয়ে যা পড়ছি, তা মূলত কারও বিশেষ জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। সেই জ্ঞান আমাদের সফলতাকে ত্বরান্বিত করবে। বইয়ে একটি সঠিক পথ অবলম্বন করার জন্য আমাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়। জীবনের ভুলগুলোকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন বইয়ে লেখক তার জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেন। আমরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে জানতে পারি কোন পথে গেলে ভুলের সম্ভাবনা কমে আসে। জীবন খুব ছোট, ভুলের পুনরাবৃত্তি করা সফলকাম হওয়ার অন্তরায়। সফলদের একজন হতে চাইলে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যও বই অপরিহার্য।
তরুণ প্রজন্মের যাকেই জিজ্ঞাসা করি, সেই-ই জানায় সে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করবে। পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেক বিষয় রয়েছে। নবপ্রজন্মের মধ্যে এই উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করতে হবে। যেকোনো বিষয়েই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে মাস্টার্স বা পিএইচডির মতো গবেষণা অন্য বিষয়েও করা সম্ভব। এ সম্পর্কে আমি নোবেল বিজয়ী ফরাসি অধ্যাপকের কথা বলছি। নাম তাঁর ড. জ্যঁ তিরল। তিনি সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তাঁর স্নাতক ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, কিন্তু তিনি পিএইচডি করেছেন অর্থনীতিতে। পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অর্থনীতিতে। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলে স্নাতক ডিগ্রি এক বিষয়ে হলেও অন্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ভূগোল বিষয়ে অধ্যয়ন করে পরবর্তী সময়ে নাসাতে গবেষণার সুযোগ পেয়েছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করেই জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। যদি থাকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি।
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে শিশুকাল থেকে। পাঠ্যবইসহ গল্প-উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞান ও গণিতভিত্তিক যেকোনো বই-ই মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি পরিবারে গড়ে তুলতে হবে সর্বোপরিসরে ছোট আকারের পাঠাগার। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুশীলন করতে হবে সফলতার সঠিক জীবনবোধ। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই মানুষকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। সে নিজেই হতে পারে জ্ঞানের বিশ্বকোষ। এভাবেই গড়ে উঠবে জাতি, সমৃদ্ধ হবে দেশ। সফলতার সুষমায় উদ্ভাসিত হবে প্রতিটি জীবন ও পরিবার।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।