প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিং উন্নয়নে করণীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বা উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক আনুক্রমিক মানের উন্নয়ন জ্ঞাননির্ভর জাতি গড়ার জন্য অপরিহার্য। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এর উন্নয়নের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা ও সম্যক জ্ঞান অপরিহার্য। আমরা প্রায়ই বলি, ‘অমুক দেশের অমুক বিশ্ববিদ্যালয় গ্লোবাল র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে আছে, আমরা নেই- এ দুঃখ রাখি কোথায়?’ কেন নেই এর বিশ্লেষণ যেমন দরকার, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ের মানোন্নয়নে কাজ করা দরকার। এর জন্য সর্বপ্রথম দরকার র্যাংকিং সূচকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নির্ধারণের জন্য পৃথিবীতে তিন ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি আছে- কিউএস র্যাংকিং, টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিং, একাডেমিক র্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস।
কিউএস র্যাংকিং মূলত ছয়টি সূচক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে করা হয়। প্রথম সূচকটি হলো একাডেমিক রেপুটেশন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এক লাখ ৩০ হাজারের মতো বিশেষজ্ঞ এই সূচকটির ওপর নম্বর দিয়ে থাকেন।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কেমন, তা ওই বিশেষজ্ঞরা সমন্বিত মূল্যায়নের ভিত্তিতে করে থাকেন। একাডেমিক রেপুটেশনের জন্য শতকরা ৪০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে। দ্বিতীয় সূচকটি হলো এমপ্লয়ার রেপুটেশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগকৃত কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টির পরিমাপক সূচকটি হলো এমপ্লয়ার রেপুটেশন।
র্যাংকিং কর্তৃপক্ষ সার্ভে বা তাদের নিজস্ব কোনো পদ্ধতিতে নিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমপ্লয়ার রেপুটেশন সূচকের নম্বর সংগ্রহ করে। তৃতীয় সূচকটি হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত। একজন শিক্ষকের বিপরীতে কতজন শিক্ষার্থী রয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মানদ-ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হওয়া উচিত ১ঃ২০। এর নিচে হলে আরো ভালো।
গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষায় একজন শিক্ষকের বিপরীতে যত কমসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকবে, সেটি তত ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এই সূচকের জন্য শতকরা ২০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে। পরের সূচকটি হলো প্রতি শিক্ষকের ‘সাইটেশন’। সাইটেশন কী? শিক্ষক ও গবেষকদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান সাধারণত গবেষণা নিবন্ধ হিসেবে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত নিবন্ধ যদি অন্য কোনো গবেষক বা একই গবেষক তাঁদের পরবর্তী গবেষণায় রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেন, তবে তাকে সাইটেশন বলে। এই সূচকে বরাদ্দ করা নম্বর শতকরা ২০ ভাগ। গবেষকদের সাইটেশন যত বেশি, গবেষক তত ভালো মানের বলে বিবেচিত হন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ সূচক দুটি যথাক্রমে বিদেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যা। এর প্রতিটির জন্য শতকরা ৫ ভাগ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে।
‘টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিং’ কর্তৃপক্ষ কিউএস র্যাংকিংয়ের সঙ্গে কাজ করত। ২০১০ সাল থেকে এরা আলাদাভাবে র্যাংকিং প্রকাশ করছে। এখানে শিক্ষাদানসংক্রান্ত সূচকে শতকরা ৩০ নম্বর, গবেষণাসংক্রান্ত সূচকে শতকরা ৩০ নম্বর, সাইটেশনের জন্য শতকরা ৩০ নম্বর এবং বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য শতকরা ১০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে। শিক্ষাদান সূচকের ৩০ নম্বরকে আবার সুষম মূল্যায়নের জন্য কতগুলো উপসূচকে ভাগ করা হয়েছে।
‘একাডেমিক র্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস’-এ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এর কারণ এখানে শতকরা ২০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে বিশবিদ্যালয়ের নোবেল বিজয়ী অথবা ফিল্ডস মেডেল প্রাপ্ত গবেষকদের জন্য। আর শতকরা ২০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে নেচার ও সায়েন্স জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিং উন্নয়নে করণীয়কি না তার ওপর। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এখনো কোনো নোবেল বা ফিল্ডস মেডেল পাননি। তা ছাড়া নেচার ও সায়েন্স জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের ঘটনাও কদাচিৎ। তাই এই পদ্ধতির র্যাংকিংয়ে আমাদের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেরই নাম নেই।
এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিংয়ের বিভিন্ন প্রকারভেদ ও সূচক সম্পর্কে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং উন্নয়নে আমাদের করণীয় দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিং উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁরা বিদেশে পিএইচডি করতে যাচ্ছেন, তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কারণ পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা নিজেদের গবেষণার অভিজ্ঞতা দিয়ে গবেষণাপ্রেমী শিক্ষার্থীদের গবেষণার পথ দেখাতে পারেন। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ামক হলো শিক্ষার্থী, গবেষণাগার, সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ও পূর্ববর্তী কোনো গবেষণার আদ্যোপান্ত অনুধাবনের মাধ্যমে নতুন গবেষণার সুযোগ খুঁজে বের করা। পূর্ববর্তী গবেষকদের কাজগুলোকে পর্যালোচনা করার পর্যায়কে ‘লিটারেচার রিভিউ’ বলে। লিটারেচার রিভিউয়ের জন্য দরকার হালনাগাদ গবেষণা নিবন্ধের সহজপ্রাপ্তি। বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালের সহজলভ্যতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার গতি আনবে।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্ততপক্ষে মাস্টার্স কোর্স চালু করা উচিত এবং মাস্টার ডিগ্রি দেওয়ার জন্য অন্তত একটি কনফারেন্স অথবা জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ আবশ্যক করা উচিত। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিংয়ে উন্নয়ন ঘটবে। আমাদের দেশে হাল আমলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোতেই সন্ধ্যাকালীন বা এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স নামে মাস্টার ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। এই ডিগ্রিগুলোতে থিসিস বা প্রজেক্ট বিষয়ে খুবই কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটু গুরুত্ব দিয়ে যদি শিক্ষার্থীদের গবেষণা নিবন্ধের বিষয়টি অপরিহার্য করে দেয়, তাহলে সন্ধ্যাকালীন বা এক্সিকিউটিভ মাস্টার্সের মানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্লোবাল র্যাংকিংয়েরও দ্রুত উন্নয়ন ঘটবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগই স্নাতক ডিগ্রি কেন্দ্রিক। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়েই যদি শিক্ষার্থীরা গ্রুপ থিসিসকে বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ করতে পারে, তাহলে গবেষণার মান বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে থিসিস সুপারভাইজার লিটারেচার রিভিউয়ের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিলে তাদের অনেকেই গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতে সক্ষম হবে বলে মনে করি।
দেশে এখন ৫৮টি সরকারি ও ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ হাজার ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। এই বিপুলসংখ্যক মেধাবী জনগোষ্ঠীকে যদি গবেষণায় আকৃষ্ট করা যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল র্যাংকিং উন্নয়নের বিষয়টি সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এ জন্য যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে তা নয়, বিদ্যমান অবকাঠামোতেই গবেষণা সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে সবাইকে হতে হবে আন্তরিক। মনে রাখতে হবে, ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে। হবেই হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।’
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।