প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
সম্প্রতি ফরচুন ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, এক ব্যক্তি দিনে এক ঘণ্টা কাজ করেন। সপ্তাহে পাঁচ দিনের এই কাজে বছর শেষে তাঁর বেতন দাঁড়ায় এক লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এই ব্যক্তির নাম ডেভন। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
বয়স ২০ বছরের কাছাকাছি। কাজ করেন বিশ্ববিখ্যাত তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থা গুগলে। ডেভন জানিয়েছেন, দিনে বড়জোর এক ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। বোনাসসহ সংস্থার কর্মী হিসেবে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তিনি পান।
তরুণ এই প্রযুক্তিবিদ গুগলের জন্য প্রগ্রামিংয়ের কোড লেখার কাজ করেন। গুগল থেকে বার্তা পেলে ল্যাপটপ খুলে কাজে বসে যান তিনি। তরুণ এই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জানান, গুগলে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ইন্টার্ন করার সময়ও খুব দ্রুত কোড লিখে কাজ শেষে হাওয়াই দ্বীপে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি কাটাতে চলে যেতেন।
তখনই তিনি বুঝেছিলেন এখানে চাকরি পেলে তাঁকে বেশি সময় ধরে কাজ করতে হবে না। তাঁর মতে, গুগলের কর্মীরা এ কারণেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে এখানে কাজ করতে পছন্দ করেন, যেন চাকরি ও পরিবার দুই-ই সামলানো যায়। তাঁর ভাষ্য মতে, গুগলে চাকরি পেতে গণিত ও কোড লেখার দক্ষতা জরুরি। গণিত ও কোড এই দুটি দক্ষতা চাকরিপ্রার্থীদের জন্য বাড়তি সুবিধা করে দিতে পারে। খবরটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোডিং দক্ষতার অমিত সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রগ্রামারদের জন্য পৃথিবীব্যাপী সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রাশিয়া, বেলারুশ প্রভৃতি দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারছে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনেক সফটওয়্যার কম্পানি এই সুযোগগুলো বড় আকারে কাজে লাগাতে পেরেছে। এ জন্য দেশের অভ্যন্তরে এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দরকার। কিন্তু সাম্প্রতিককালের একটি জরিপ বলছে, প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের চাকরির বাজারে সাড়ে সাত থেকে আট হাজার দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ চাকরিপ্রার্থী কম্পিউটার প্রগ্রামিং এবং গণিত বিষয়ে খুবই দুর্বল।
বাস্তবিক অর্থে প্রাত্যহিক জীবনের যেকোনো সমস্যা সমাধানের গাণিতিক মডেল তৈরি করা সম্ভব। প্রগ্রামিং হলো সমস্যা সমাধানের গাণিতিক মডেলের সফট ভার্সন। বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি প্রসারিত করলে গণিত এবং প্রগ্রামিং দক্ষতার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবীতে প্রগ্রামিংয়ে পারদর্শী ১ থেকে ১০ অবস্থানে থাকা দেশগুলো হলো চীন, রাশিয়া, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জাপান, তাইওয়ান, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক ও ইতালি। দেশগুলোর গণিতে পারদর্শিতার বৈশ্বিক অনুক্রম ১ থেকে ৩০-এর মধ্যে।
কোডিংয়ে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির জন্য আমাদের চারটি স্তরে আন্তরিক, মনোযোগী ও সজাগ হতে হবে। প্রথমত, প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণিত শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং গণিত শিখনে আগ্রহী জনগোষ্ঠী তৈরি করা। ১৮ জুন ২০২৩ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বিনিয়োগ বেশি সুফল কম’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে প্রকাশ, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় গত কয়েক বছরে বিপুল বিনিয়োগ করেছে সরকার। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা। এর পরও বিভিন্ন জরিপে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ শিখন মানে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘নাগরিক কর্তৃক মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি জরিপ করা হয়। কোনো না কোনো সময় বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৭৫১ ছেলে ও ৭৮২ মেয়ে শিশুর ওপর জরিপটি করা হয়েছে। তবে এটি বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার্থীদের জরিপ নয়। পাঁচ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রান্তিক শিশুদের বাড়িতে গিয়ে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়। জরিপে দেখা যায়, গণিতে একক অঙ্ক শনাক্ত করতে পারেনি ১৪.১৯ শতাংশ ছেলে এবং ১৩ শতাংশ মেয়ে। আর ভাগ করতে পারেনি প্রায় ৯৬ শতাংশ ছেলে এবং ৯৭ শতাংশের বেশি মেয়ে।
দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সম্যক ও প্রত্যয়ী জ্ঞানের গণিত শিক্ষার্থী তৈরি। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় কোনো একটি বছরে ৮৫ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ হাজার পরীক্ষার্থী গণিত বিষয়ে উত্তরই দেয়নি। ৫০ হাজার পরীক্ষার্থী গণিত বিষয়ে উত্তর দিলেও ২৫ নম্বরের মধ্যে ৭ বা ৭-এর বেশি পেয়েছে প্রায় ১৩ হাজার জন। ১০ বা ১০-এর বেশি পেয়েছে প্রায় চার হাজার জন। ১৫ বা ১৫-এর বেশি পেয়েছে ২৫০ জন। আর ২০ বা ২০-এর ওপরে নম্বর পেয়েছে ১০ জন। অনুরূপ পরীক্ষায় অন্য একটি বছরে বিকল্প বিষয়ে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না থাকায় প্রায় ৭৬ হাজার জন অঙ্ক বিষয়ে উত্তর দিয়েছে। এই পরীক্ষায় প্রায় ১৫ হাজার জন ২৫ নম্বরের মধ্যে ৭ বা ৭-এর বেশি পেয়েছে। ১০ বা ১০-এর বেশি প্রায় পাঁচ হাজার জন। ১৫ বা ১৫-এর বেশি পেয়েছে প্রায় ৯০০ জন। ২০ বা ২০-এর বেশি নম্বর পেয়েছে প্রায় ৯০ জন। মেধাবীদের এমন হতাশাব্যঞ্জক গণিতের ফলাফল গবেষণাপ্রেমী ও কোডিংয়ে দক্ষ আগামীর স্মার্ট নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা।
তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যায়ে কোডিং দক্ষতার ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা ও যত্ন দরকার। সম্প্রতি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সের সিলেবাস পরিমার্জনে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। সিলেবাসে ‘স্ট্রাকচার প্রগ্রামিং’ কোর্সের ব্যাবহারিক ক্লাসের জন্য পুরো সেমিস্টারে মোট ২৮ ঘণ্টা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে প্রত্যয়ী প্রগ্রামার তৈরির জন্য অপ্রতুল। স্ট্রাকচার প্রগ্রামিংয়ের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম এ জন্য যে কোডিং দক্ষতা ও প্রগ্রামিং লজিক তৈরির জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।
সাইবার সিকিউরিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিকস, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, অগমেন্টেড রিয়ালিটি, ই-কমার্স, যেখানেই উন্নতি করতে চাই না কেন, দরকার প্রত্যয়ী প্রগ্রামার। তাই চতুর্থ স্তরের করণীয় হলো স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পরও যাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে না, তাদের জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে কোর কোডিং দক্ষতা ও লজিক বৃদ্ধির জন্য ১২ সপ্তাহের শিক্ষানবিশ ট্রেনিং চালু করা যেতে পারে। এভাবেই স্তরভিত্তিক পরিচর্যা ও যত্নের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব বর্তমান ও আগামীর দক্ষ প্রজন্ম।
ড. মোঃ নাছিম আখতার : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।