বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

চাঁদপুরের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

দ্বিতীয় পর্ব

জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি কেবল দেশের প্রথম নজরুল গবেষকই নন, একই সাথে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। কয়েক দশক ধরে তিনি বাংলা সাহিত্যে গবেষণায় অর্থবহ অবদান রাখছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১২), একুশে পদক (২০০১), বাংলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করে।

ড. রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি। তাঁর পৈত্রিক নিবাস মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের চিকিৎসক। তাঁর চাকুরির সুবাধে বিভিন্ন জেলায় রফিকুল ইসলামের শৈশব কাটে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে লালমনিরহাটে ছিলেন। সেখানে দেখেছেন শরণার্থী জীবন। ১৯৪১ সালে রফিকুল ইসলাম তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে তাঁর স্কুল থেকে শোক শোভাযাত্রা বের হয়। রফিকুল ইসলাম এতে অংশ নেন। এ ঘটনাটি তাঁর মনে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৪৩ সালে রফিকুল ইসলামের বাবা ঢাকায় বদলি হন। তখন তাঁরা রমনায় রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে থাকতেন। ঢাকায় এসে প্রথমে ভর্তি হন সেন্ট গ্রেগোরিজ স্কুলে। পরে আরমানিটোলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মুহম্মদণ্ডএর মতো বরেণ্য মানুষ। রফিকুল ইসলাম আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি, মিনেসোটা ইউনিভার্সিটি, মিশিগান-অ্যান আরবর ইউনিভার্সিটি ও হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন এবং গবেষণা করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছাত্রী।

বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলন ও সংগ্রামে ড. রফিকুল ইসলাম যুক্ত ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন ভাষা আন্দোলনে। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বায়ান্নের ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে সকল ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রফিকুল ইসলামও ছিলেন। তিনি সেই অগ্নিদিনের স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের সময় ৫২ সাল থেকে ৫৫ সাল পর্যন্ত। আমি ভাষা আন্দোলনের সব ছবি তুলেছি, নাটক করেছি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হইনি। সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, ছবি তুলেছি, আর লেখালেখি করেছি।’ আমরা এখন ভাষা আন্দোলনের যে সকল ছবি পাচ্ছি, তার অনেক রফিকুল ইসলাম তুলেছেন।

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। হানাদারদের বন্দি শিবিরে তিনি ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন এবং অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে যান। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস প্রবর্তনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের পর রফিকুল ইসলামসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। তাঁকে বলেন, পাকিস্তানী হানাদাররা দেশের শিক্ষক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসকসহ অনেককে হত্যা করেছে। এমনকি মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেকের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু সেদিন কেঁদেছিলেন। পরে মিরপুরে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ এবং ১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ’-এর উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রফিকুল ইসলাম বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর নজরুল বিষয়ক গ্রন্থগুলো হলো : নজরুল নির্দেশিকা, নজরুল জীবনী, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও কবিতা, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য, কাজী নজরুল ইসলামের গীতি সাহিত্য, নজরুল প্রসঙ্গে, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি এবং কিশোর কবি নজরুল। নজরুল রচনাবলির প্রধান সম্পাদক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন।

ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। যেমন, বীরের এই রক্ত¯্রােত মাতার এ অশ্রুধারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার, শহীদ মিনার, বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, অমর একুশে ও শহীদ মিনার। এছাড়াও ভাষাতত্ত্ব, ঢাকার কথা, আবদুল কাদির, ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী, আবুল মনসুর আহমেদ রচনাবলী, বাংলা ব্যাকরণ সমীক্ষা, An Introduction to Colloquial Bengali, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থ। তাঁর অন্যতম আলোচিত গ্রন্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর। ২০০৩ সালে এটি প্রকাশিত হয়। গবেষক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে।

রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মনোনীত করা হয়। তিনি ২০২২ সালে প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র :

১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর, রফিকুল ইসলাম, অনন্যা প্রকাশনী।

২. ঢাকার কথা, রফিকুল ইসলাম, আগামী প্রকাশনী।

৩. বাংলা ভাষা আন্দোলন, রফিকুল ইসলাম, ময়ূরপঙ্খি প্রকাশনী।

৪. মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয় : ড. রফিকুল ইসলাম; সাক্ষাৎকার গ্রহণে শেখ মেহেদী হাসান, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ মে ২০১৬।

সিভাসু উপাচার্য ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ

চাঁদপুরের সন্তানরা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর তাঁকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।

গৌতম বুদ্ধ দাশ-এর জন্ম ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই, চাঁদপুরে। বাবা স্বদেশ রঞ্জন দাশ, মা সাবিত্রি রানী দাশ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি বিষয়ে স্নাতক (১৯৮৫), পোল্ট্রি নিউট্রিশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর (১৯৮৬) ডিগ্রি লাভ করেন। পরে হিউম্যান রিসোর্চ ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (২০০৮) এবং পোল্ট্রি নিউট্রিশন বিষয়ে পিএইচডি (২০১২) ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ডেনমার্ক, লন্ডন, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে অ্যানিম্যাল সাইন্স ও পোল্ট্রি নিউট্রিশনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

পেশাগত জীবনে গৌতম বুদ্ধ দাশ বাংলাদেশ ফিশারিজ রিচার্স ইন্সটিটিউট, সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে কাজ করেছেন। তিনি ২০০০ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের অ্যানিম্যাল সাইন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দু মেয়াদে এ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গৌতম বুদ্ধ দাশ নিয়মিত লেখালেখি করেন। এ পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে তাঁর ২৫টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘পোল্ট্রি উৎপাদন’ (২০০৫) প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।

সূত্র :

১. চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।

২. বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস

শিক্ষাবিদ ও গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুসের জন্ম নাসিরকোটে, ১৯০৬ সালের ১ জানুয়ারি। বাবা আফসার উদ্দিন আহমেদ, মা মানিকজান। তিনি রূপসা আহমদিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক (১৯২৫), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (১৯২৭) ও বিএ (১৯২৯), ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.টি (১৯৩৩), ময়মনসিংহ প্রাইমারি ট্রেনিং কলেজ থেকে এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পল্লী উন্নয়ন ও বয়স্ক শিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

পেশাগত জীবনে তিনি হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক, স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এবং ঢাকা জুনিয়র কলেজের অধ্যক্ষ, পূর্বপাকিস্তান শিক্ষা কমিশনের সহকারী সচিব, বয়স্ক শিক্ষা শাখার এডিপিআই হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস আজীবন শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। কুমিল্লা মডার্ন স্কুল, শিশু সংগঠন সবুজ সংঘ, কুমিল্লা শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা- তাঁরই উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তিনি বয়স্কদের জন্যে সহজ ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন। নব্যশিক্ষিতদের জন্যে তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা ২৪টি। তিনি শিক্ষকদের পত্রিকা পাক্ষিক আলোর সম্পাদক এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সট বুক বোর্ডের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন।

গবেষক ও সম্পাদক হিসেবে মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষত আঞ্চলিক ইতিহাস প্রণয়ন ও নজরুল-সাহিত্য মূল্যায়নে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : নজরুল কাব্যে ইসলামী ভাবধারা (১৯৭০), কুমিল্লায় নজরুল (১৯৭৬), শহর কুমিল্লা (১৯৭৮), কুমিল্লা জেলায় ইসলাম প্রচার (১৯৮৩), শিশুসাহিত্যে নজরুল (১৯৮৩), কুমিল্লার স্মরণীয়-বরণীয় (১৯৮৭) ইত্যাদি। শিশুতোষ গ্রন্থ ১৫টি। তিনি কুমিল্লা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া বয়স্ক শিক্ষা, প্রাথমিক ও মক্তব শিক্ষা এবং সাক্ষরতা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

দীর্ঘ কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুসকে তঘমা-ই-কায়েদে আজম পুরস্কার প্রদান করে। সাহিত্যচর্চার জন্যে তিনি সাহিতরত্ন উপাধি লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্যে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

বরেণ্য এ শিক্ষাবিদ ও গবেষক ১৯৮৮ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র :

১. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১।

২. চাঁদপুর পরিক্রমা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রিয়তোষ সাহা; আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬।

৩. কৃতজ্ঞতা : গবেষক মামুন সিদ্দিকী।

পণ্ডিত রাসমোহন চক্রবর্তী

পণ্ডিত রাসমোহন চক্রবর্তী চাঁদপুরের আরেকজন কৃতীসন্তান। তাঁর জন্ম চাঁদপুরের বেরাচাকি গ্রামে, ১৮৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর। বাবা তিলকচন্দ্র চক্রবর্তী, মা বামাসুন্দরী দেবী। তাঁর শৈশব সুখের ছিল না। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা মারা যান। অন্যদিকে আশ্রয়স্থল মা যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র দেড় বছর। বাবা-মা হারানো রাসমোহন চক্রবর্তী লালিত-পালিত হয়েছেন তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে, নরসিংহপুরে।

শৈশব থেকেই মেধাবী ছিলেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন চাঁদপুরের নরসিংহপুর এম.ই স্কুলে। পরবর্তীতে তিনি চাঁদপুরের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ হাসান আলী জুবলী হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে এ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পেয়েছিলেন বৃত্তিও। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার জন্যে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো। রাজনীতি সচেতন রাসমোহন চক্রবর্তী আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ঢাকা কলেজ ত্যাগ করেন। ভর্তি হন চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজে। ১৯২১ সালে এখান থেকে আইএ এবং ১৯২৩ সালে বিএ পাস করেন। দর্শন ও ইতিহাস বিভাগে এমএ ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি এমএ সম্পন্ন করেন।

রাসমোহন চক্রবর্তীর প্রথমে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ঢাকা ন্যাশনাল কলেজ। কিন্তু শিক্ষকতা বেশিদিন করেননি। বিখ্যাত দানবীর ও সমাজসেবক মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য রাসমোহনকে জানতেন। তিনি ১৯২৬ সালে বিখ্যাত রামমালা গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসেবে রাসমোহন চক্রবর্তীকে যোগদানের অনুরোধ করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাসমোহন কুমিল্লায় চলে আসেন। তিনি প্রধান গ্রন্থাগারিক ছাড়াও রামমালা ছাত্রাবাসের প্রধান তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বও পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে বিখ্যাত রামমালা গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হয়। বাংলা একাডেমির চরিতাভিধানে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, রামমালা গ্রন্থাগারটি ‘আজ বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম গ্রন্থাগার হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তির পেছনে তাঁর অবদান অনেক। ...গ্রন্থাগারে মুদ্রিত গ্রন্থ, সাময়িকপত্র এবং হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির এক বিরাট ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়েছিল তাঁরই পরম যত্নে।’

রাসমোহন চক্রবর্তী ভালো পাঠক ও লেখক ছিলেন। গ্রন্থাগারিকতাকে তিনি যতটুকু না পেশা হিসেবে নিয়েছেন, এটিকে এর চেয়ে বহুগুণ ভালোবেসেছেন। তাই দিন-রাতের বহু সময় তাঁকে গ্রন্থাগারে নিবিষ্ট থাকতে দেখা যেত। তাঁর লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মহাপ্রাণ মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, বিবেকানন্দ বাণী সংগ্রহ, যুগ্মশঙ্খ, শ্রীসপ্তমতী রহস্যময়, দৈনিক প্রার্থনা উল্লেখযোগ্য।

১৯৮২ সালের ১৪ মে পণ্ডিত রাসমোহন চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর সমগ্রজীবন কুমিল্লাতেই কাটিয়েছেন।

সূত্র :

বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১।

শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ সরকার

আবদুল্লাহ সরকারের জন্ম ১৯৪২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, হাইমচরের সরকার বাড়িতে। বাবা পিয়ার আলী সরকার, মা ছৈয়দুন্নেসা। তের ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। আবদুল্লাহ সরকার কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক ও চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা করেন।

আবদুল্লাহ সরকারের রাজনৈতিক জীবন ঘটনাবহুল। তিনি আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন করেছেন। পুঁজিবাদী নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা পেতে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছেন নিরলস। তাঁর জন্মভূমি হাইমচরকে নদীভাঙন থেকে রক্ষা, জেলের অধিকার আদায়, সামাজিক সমস্যা রোধসহ বহু কাজে তিনি ছিলেন সক্রিয়। আবদুল্লাহ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তিনি আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে চাঁদপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধা-সংগ্রহের কাজ করতেন। এক সময় তিনি পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়তে গিয়েও অল্পের জন্যে বেঁচে যান। হাইমচরে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ স্মৃতি পাঠাগার।

হাইমচরের নদীভাঙন রোধ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে আবদুল্লাহ সরকার জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। হাইমচর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় এবং হাইমচর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়- তাঁর প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তিনি এ প্রতিষ্ঠানে অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি কখনো কখনো নিজের জমি বিক্রি করে শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন।

আবদুল্লাহ সরকার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা তাহেরা বেগম জলিকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই মেয়ে রয়েছে। বরেণ্য এই রাজনীতিবিদ ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহাজাদপুরস্থ বাসায় ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নামে হাইমচরে কমরেড আবদুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদ রয়েছে। এছাড়াও তাঁকে নিয়ে তাহেরা বেগম জলি সম্পাদিত ‘৭৩-এর সংসদ ও একজন আবদুল্লাহ সরকার’ শীর্ষক গ্রন্থ রয়েছে।

সূত্র :

১. কমরেড আবদুল্লাহ সরকার : সততার প্রশ্নে আপসহীন একজন আত্মোৎসর্গী জননেতা, কমরেড আবদুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদের প্রকাশনা।

২. কমরেড আবদুল্লাহ সরকার : প্রকৃত জননেতার এক প্রতিকৃতি, কমরেড আবদুল্লাহ সরকার স্মরণ জাতীয় কমিটির প্রচারপত্র।

৩. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়