প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
পৃথিবীতে মানুষকে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষা অর্জন করতে হয়। মানুষ ব্যতীত সকল প্রাণী নিজের প্রয়োজনে জীবন ধারণের জন্য প্রকৃতি থেকে শিক্ষা অর্জন করে। এ জন্য তাদের কৃত্রিম ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানুষকে কৃত্রিমভাবে শিক্ষা অর্জন করতে হয়। সেই কৃত্রিম ব্যবস্থা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। শিক্ষা ও নৈতিকতা পরস্পর নির্ভরশীল। শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়ের সমন্বয়েই সুশিক্ষা। একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তির দ্বারাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
শিক্ষা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ঊফঁপধঃরড়হ। ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ঊফঁপধৎব থেকে। যার অর্থ : প্রতিফলন করা, পরিচর্যা করা, অন্তর্নিহিত চেতনার বিকাশ সাধন করা। বাংলায় শিক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে। যার অর্থ : শাসন করা বা উপদেশ দান করা।
এবার শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন মনীষীরর মতামত লক্ষ করা যাক- শিক্ষা সম্পর্কে এরিস্টটল বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের দেহ ও মনের বিকাশ সাধন এবং তার মাধ্যমে জীবনের মাধুর্য ও সত্য উপলব্ধিকরণ’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে’। ফ্রেডারিক হার্বাটের মতে, ‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের বহুমুখী প্রতিভার ও অনুরাগের সুষম প্রকাশ এবং নৈতিক চরিত্র গঠন’।
শিক্ষার মূল লক্ষ হচ্ছে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা; একজন মানুষের ভিতরে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলে ভালো-মন্দের উপলব্ধি সৃষ্টি করা। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেই মূল্যবোধ তৈরিতে আসলেই ব্যর্থ। এখন শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হচ্ছে অর্থ উপার্জনের মেশিন হিসেবে। আর শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে- আমাকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে; আমাকে ডাক্তার, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে; কিংবা আমাকে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে হবে। যার কারণে তারা শিক্ষার মূল লক্ষ থেকে ছিটকে পড়ছে। সক্রেটিস বলেছেন, ‘শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য আত্মার বিকাশ, অর্থ উপার্জন নয়’।
হার্বাট স্পেনসার শিক্ষার গূঢ়ার্থ বিশ্লেষণে মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষা একটি শিশুকে কীভাবে প্রকৃত জীবনযাপন, প্রশিক্ষণ, শরীর প্রতিপালন, মনের উৎকর্ষ সাধন, দৈনন্দিন বিবিধ সমস্যাকে যুক্তি ও বুদ্ধির সহায়তায় সমাধান ও পরিবার রক্ষণাবেক্ষণসহ সর্বোপরি কীভাবে নিজেকে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে শিক্ষা দেয়’।
একজন আদর্শ শিক্ষিত মানুষের মাঝে তিন ধরনের মূল্যবোধ থাকতে হবে :-
১। মানবিক মূল্যবোধ; ২। সামাজিক মূল্যবোধ; ৩। নৈতিক মূল্যবোধ।
নৈতিক মূল্যবোধের মাঝেই উপরোল্লেখিত দুটি মূল্যবোধ নিহিত। সততা, সদাচার, সৌজন্যবোধমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব ও উন্নত চরিত্র- এ সবকিছুর সমন্বয়ই হলো নৈতিকতা। নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে গড়ৎধষরঃু। যার উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ গড়ৎধষরঃধং থেকে। এর আভিধানিক অর্থ- ধরন, ভালো আচরণ, চরিত্র ইত্যাদি।
শিক্ষা ও নৈতিকতা পরস্পর নির্ভরশীল। উভয়ের সমন্বয়েই একজন ব্যক্তি সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। সুশিক্ষিত ব্যক্তির দ্বারাই সমাজ ও দেশ উন্নতি-অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়ে থাকে। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার উপস্থিতি খুবই কম। নৈতিকতা বিবর্জিত এমন শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতিকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। দুর্নীতি, ধর্ষণ, হত্যাসহ বহু ধরনের অপরাধে অভ্যস্ত করে তোলে। নৈতিকতা বিবর্জিত এমন শিক্ষিত ব্যক্তিদের দ্বারা সমাজ, সমাজের মানুষ ও রাষ্ট্রের উন্নতি-অগ্রগতির পরিবর্তে বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান যর্থাথই বলেছেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ-সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়’।
পৃথিবীতে যত বড় বড় অপরাধ হয়েছে এবং হচ্ছে তার ৮৫% অপরাধই সংঘটিত হয়েছে শিক্ষিত মানুষের দ্বারা। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে- এরা তো শিক্ষিত, এরা ভালো-মন্দ সবই বুঝে, তাহলে এরা অপরাধ করছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই- এরা যে শিক্ষা অর্জন করেছে সে শিক্ষার সাথে নৈতিকতার সমন্বয় ঘটেনি। কবির চৌধুরী বলেছেন, ‘নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের চরিত্র বলতে কিছুই থাকে না’।
নীতিভ্রষ্ট শিক্ষিত মানুষ সমাজ ও দেশের বিপর্যয় ডেকে আনে। আর নৈতিকতা সমন্বিত শিক্ষা একটি জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। সুতরাং একটি সভ্য সমাজ, আত্মবিশ্বাসী ও চারিত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন জাতিগঠনে এবং সমাজ ও দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পর্কিত শিক্ষা এখন সময়ের দাবি। সাইয়্যেদ কুতুব শহিদ (র.)-এর একটি কথা দিয়ে আমার প্রবন্ধের ইতি টানছি। তিনি বলেছেন, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজ-ই সভ্য সমাজ’।