প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
বাবুরহাট হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সারদাচরণ দত্ত
চাঁদপুরের বাবুরহাট হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন সারদাচরণ দত্ত (১৮৬৯-১৯৬৫)। শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো ভারতবর্ষ জুড়ে। ছিলেন রবীন্দ্র-অনুরাগী। গোপাল হালদার তাঁর বিখ্যাত রূপনারায়ণের কূলে গ্রন্থে লিখেছেন-
‘চাঁদপুরের বাবুরহাট স্কুলের হেড মাস্টার পুণ্যশ্লোক সারদাচরণ দত্ত মহাশয় এবং তৎকালীন চাঁদপুরের কালীমোহন ঘোষ মহাশয়- পূর্ববাংলার চাঁদপুরের ঐ অঞ্চলটিতে রবীন্দ্র প্রতিভার আলোক শতাব্দীর প্রথম দশকেই বিকিরিত হয়েছিল ঐ দুজন রবীন্দ্র প্রতিভামুগ্ধ মানুষের দ্বারা।’
গোপাল হালদার আরো বলেছেন, সে সময় দূরের জেলাগুলোতে সারদাচরণ দত্তের মতো খুব অল্পকজনই মানুষই রবীন্দ্রভাবনা বুঝতে পেরেছিলেন। তারা ‘রবীন্দ্রনাথের সলতে জ্বালিয়ে আঙ্গিনার আঁধার’ দূর করতে চেয়েছেন।
সারদাচরণ দত্তের সন্তান লেখক ও অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর বাবা বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও গ্রামবাসীদের নিয়ে সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। ১৮৯০-এর দশকে কলেজের পড়াকালীন থেকে তিনি রবীন্দ্র কাব্যসাহিত্যের গভীর অনুরাগী হয়ে উঠেন।
সারদাচরণ দত্ত কেবল নিজে নন, তাঁর সন্তান, ছাত্রদেরও রবীন্দ্র-আলোয় আলোকিত করেছেন। তাঁর সন্তান লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রকাব্য সাহিত্য পাঠে ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে যে নতুন জীবনের বার্তা এনে দিয়েছেন সেই বার্তাটি প্রচার করাই তাঁর শিক্ষক জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিলো। তাঁকে লেখা কবির অন্তত ৫টি চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়। কবি তাঁকে প্রথম চিঠি লিখেন ১৯১০ সালের ২২ আগস্ট। এ চিঠির একস্থানে কবি লিখেছেন- ‘কালীমোহনের কাছে অনেকবার আপনার কথা শুনিয়াছি- আপনি আমার অপরিচিত নহেন- আশা করিতেছি কোনো না কোনো সুযোগে আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়া এই পরিচয় সম্পূর্ণ হইতে পারিবে।’
রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় পত্রটি পাঠান একই বছরের ৮ অক্টোবর বোলপুর থেকে। তৃতীয়টি পাঠান ১৪ নভেম্বর, শিলাইদা থেকে। চতুর্থ চিঠি পাঠিয়েছেন ১৯১১ সালের ৭ জানুয়ারি। পঞ্চম চিঠি পাঠান ১৯১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর, রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ক্ষিতিমোহন সেন, রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সারদাচরণ দত্তের বাবুরহাট স্কুলে এসেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষকতা ও জ্ঞানের উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন।
সারদাচরণ দত্ত নিজে লেখক ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ জীবন সন্ধ্যা (১৯৪৫)। এছাড়া রয়েছে সংকলন বাংলার বাণী (১৯৪৮)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাবুরহাট হাইস্কুল আজ সমহিমায় উজ্জ্বল। বাংলাদেশের পুলিশ প্রধানসহ বহু গুণী ছাত্রকে ধারণ করে আছে এ প্রতিষ্ঠান।
তথ্যসূত্র
১. গোপাল হালদার, রূপনারনের কূলে (দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা : পুঁথিপত্র, পৃ. ১১৮-১১৯
২. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ফিরে ফিরে চাই, কলকাতা : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, বৈশাখ ১৩৬৭, পৃ. ২১০।
৩. পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কবি ও কর্মী : রবীন্দ্রনাথ ও কালীমোহন ঘোষ, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, মাঘ ১৩৬৭, পৃ. ৩৪
৪. হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শান্তিনিকেতনে এক যুগ, কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, আশ্বিন ১৩৮৭, পৃ. ৮৫।
৫. হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শেষ পারানির কড়ি, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৪, পৃ. ১২৩-১২৯।
শিক্ষা ও রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ সরকার
আবদুল্লাহ সরকারের জন্ম ১৯৪২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, হাইমচরের সরকার বাড়িতে। বাবা পিয়ার আলী সরকার, মা ছৈয়দুন্নেসা। তের ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। আবদুল্লাহ সরকার কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক ও চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
আবদুল্লাহ সরকারের রাজনৈতিক জীবন ঘটনাবহুল। তিনি আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন করেছেন। পুঁজিবাদী নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা পেতে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছেন নিরলস। তাঁর জন্মভূমি হাইমচরকে নদীভাঙন থেকে রক্ষা, জেলের অধিকার আদায়, সামাজিক সমস্যা রোধসহ বহু কাজে তিনি ছিলেন সক্রিয়। আবদুল্লাহ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তিনি আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে চাঁদপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধা-সংগ্রহের কাজ করতেন। এক সময় তিনি পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়তে গিয়েও অল্পের জন্যে বেঁচে যান। হাইমচরে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ স্মৃতি পাঠাগার।
হাইমচরের নদীভাঙন রোধ ও শিক্ষার মানউন্নয়নে আবদুল্লাহ সরকার জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। হাইমচর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় এবং হাইমচর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়- তাঁর প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তিনি এ প্রতিষ্ঠানে অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি কখনো কখনো নিজের জমি বিক্রি করে শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ সরকার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা তাহেরা বেগম জলিকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই মেয়ে রয়েছে। বরেণ্য এই রাজনীতিবিদ ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহাজাদপুরস্থ বাসায় ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নামে হাইমচরে কমরেড আবদুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদ রয়েছে। এছাড়াও তাঁকে নিয়ে তাহেরা বেগম জলি সম্পাদিত ‘৭৩-এর সংসদ ও একজন আবদুল্লাহ সরকার’ শীর্ষক গ্রন্থ রয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. কমরেড আবদুল্লাহ সরকার : সততার প্রশ্নে আপসহীন একজন আত্মোৎসর্গী জননেতা, কমরেড আবদুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদের প্রকাশনা।
২. কমরেড আবদুল্লাহ সরকার : প্রকৃত জননেতার এক প্রতিকৃতি, কমরেড আবদুল্লাহ সরকার স্মরণ জাতীয় কমিটির প্রচারপত্র।
৩. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদন
জেলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট আশেক আলী খান
চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট আশেক আলী খান। তিনি শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। আমৃত্যু তিনি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।
আশেক আলী খানের জন্ম ১৮৯১ সালের ১ জুলাই, কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। বাবা আইনউদ্দিন খান, মা আলেকজান বিবি। আশেক আলী খান যে সময়ে জন্মেছেন সে সময়টি অগ্রসর ছিল না। শিক্ষা-দীক্ষা-বিজ্ঞানে সমাজের মানুষজন ছিল অসচেতন। এ চিত্র কেবল চাঁদপুরের নয়, বরং সারাদেশেরই ছিল। ১৯১০ সালে ভারতে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রচলন- এ পশ্চাৎপদতার সাক্ষ্য দেয়। তখন চাঁদপুরের বাবুরহাট হাইস্কুল ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আশেক আলী খান এ স্কুলে পড়তেন। তাঁর ক্লাসে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্র। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন, ক্লাসে প্রথম হতেন। ১৯১১ সালে এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। এখান থেকে ১৯১৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু অনটনের কারণে পড়াশোনা থমকে যায়। আশেক আলী খান দমে যাননি। পরবর্তীকালে ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। সেসময়ে এ ভূখণ্ডে বিএ পাস করা ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর বিএ পাসের পর দেশের গণ্যমান্য বহু মানুষ তাঁকে অভিনন্দিত করেছে। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে মাদ্রাজ, দেরাগাজীখান, পাঞ্জাব, চন্দনপুর, আসাম, পাবনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৫০টি চিঠি পাঠানো হয়। বিএ পাসের পর আশেক আলী খান ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএবিটি পাস করেন। এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। সেকালে চাঁদপুরে কেউ ভালোভাবে ইংরেজি জানতো না। আশেক আলী খানকে বলা হতো ইংরেজি জানা বাঙালি সাহেব। তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষ গর্ব করতো। বিভিন্ন স্থান থেকে বহু মানুষ তাঁকে দেখতে আসতো। জানা যায়, হাজীগঞ্জে সেসময় দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ ছিল। জুমার নামাজ শেষে আশেক আলী খানকে মসজিদের মিম্বারে দাঁড় করানো হতো। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ তাঁকে দেখতো।
শিক্ষকতার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল তাঁর। মনেপ্রাণে তিনি এ পেশাকে ভালোবাসতেন। তিনি চাইলে ডেপুটি ম্যাসিট্রেটের চাকুরি করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। বিএ পাসের পর যোগ দিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। তাঁর প্রথম কর্মস্থল চাঁদপুরের গণি উচ্চ বিদ্যালয়। তাঁর চেষ্টায় এ স্কুলটি সেসময় সরকারি মঞ্জুরী লাভ করে। পরে তিনি স্কুল পরিদর্শক পদে চাকুরিতে যোগ দেন। এ কাজের সুবাধে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখার সুযোগ পান। বুঝতে পারেন শিক্ষা ও সমাজজীবনের নানা চিত্র। স্কুল পরিদর্শকের চাকুরিটিও তিনি বেশিদিন করেননি। ১৯১৯ সালে আশেক আলী খান শিক্ষক হিসেবে সরকারি স্কুলে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এসময় তিনি ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলাস্কুল এবং ঝালকাঠি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিলেও শিক্ষকতা ও শিক্ষা-উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা থেকে অবসর নেননি আশেক আলী খান। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৫ বছর চৌদ্দগ্রামের হাজী জালাল হাইস্কুল, মতলবের নারায়ণপুর হাইস্কুল, হাজীগঞ্জের দরবেশগঞ্জ হাইস্কুল, কচুয়ার রঘুনাথপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। আশেক আলী খান কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজে আলো জ্বালাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে তাঁর গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নিজ-নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আশেক আলী খান হাইস্কুল’। প্রথমদিকে এ পথচলা সুখকর ছিল না। এজন্যে আশেক আলী খানকে অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয়েছে। তাঁর মেয়ে সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব ও লেখক নীলুফার বেগম বাবার কণ্টকময় পথচলা সম্পর্কে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনে তিনি বহু আত্মত্যাগ করে স্থানীয় লোকজনকে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কাজটি ছিল ভীষণ কষ্টকর ও দীর্ঘস্থায়ী। আশেক আলী খান হাইস্কুল হতে তাঁর জীবিতাবস্থায় বহু ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় লোকদের উদ্বুদ্ধ করে যে শিক্ষার আলো তিনি জ্বালিয়েছিলেন তা সত্যিই শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। তৎকালীন এই বিষয়ে তাঁকে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবুও তিনি থেমে থাকেননি।’ ১৯৬৫ সালে আশেক আলী খান হাইস্কুল সরকারি হয়। বর্তমানে এটি কলেজ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যদিকে তাঁর চেষ্টায় কচুয়া থানায় মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। কচুয়ায় পরীক্ষাকেন্দ্র না থাকায় শিক্ষার্থীদের দূরদূরান্তে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হত। এতে ভোগান্তি পোহাতে হত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শিক্ষকতার প্রথম পর্বে আশেক আলী খান নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পারিপাশির্^ক বাধায় তাঁর চেষ্টা সফল হয়নি। উল্টো তাঁর পদোন্নতি আটকে দেয়া হয়েছিল।
সমাজউন্নয়নে আশেক আলী খান প্রাগ্রসর ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর গ্রামে ডাকঘর প্রতিষ্ঠা, মসজিদ নির্মাণ, স্বাস্থ্য, কৃষি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উত্তরণ হয়েছে। তিনি মানুষজনকে বৃক্ষরোপণ, মৎস্য চাষ, হাঁসমুরগি পালন ও কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে অর্থবহ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সবসময় সহযোগিতা করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে আশেক আলী খান ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ের জনক। তাঁর প্রত্যেক সন্তানই সুপ্রতিষ্ঠিত। সাবেক সংসদ সদস্য মেসবাহ উদ্দিন খান, বরেণ্য লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও রাজনীতিবিদ ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর তাঁর সন্তান। তাঁর দৌহিত্র বরেণ্য গবেষক মুনতাসীর মামুন। আশেক আলী খান ১৯৭৪ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়। তিনি কচুয়ায় যে শিক্ষার আলো জে¦লেছেন তাতে আলোকিত হয়েছে চাঁদপুরবাসী, উপকৃত হয়েছে সমাজ। তিনি তাঁর কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন সুদীর্ঘকাল।
তথ্যসূত্র
১. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১,
২. রত্নগর্ভা চাঁদপুর, মোহাম্মদ সফিউল আলম সম্পাদিত, আমাদের চাঁদপুর প্রকাশনী, প্রকাশ অক্টোবর, ২০০৭
৩. আশেক আলী খান : শিক্ষাসেবী ও গ্রামোন্নয়নের কর্ণধার, নীলুফার বেগম, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২ আগস্ট ২০১৫।
শিক্ষাবিদ ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী
শিক্ষাই শক্তি। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয় দেশ ও জাতি। তাই শিক্ষকরা হলেন আলোর ফেরিওয়ালা। চাঁদপুরের এমনি একজন আলোকিত মানুষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী। শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু তিনি শিক্ষার প্রসারে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্যে তাঁকে ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী ফরিদগঞ্জের পশ্চিম জয়শ্রী গ্রামের সন্তান। জন্ম ১৯০৫ সালের ১৫ মার্চ। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯১৯ সালে বাবুরহাট হাইস্কুলে ভর্তি হন। প্রথম বিভাগ পেয়ে তিনি ১৯২৪ সালে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে ১৯২৯ সালে বিএসসি পাসের পর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল মতলবগঞ্জ জেবিএইচই স্কুল। মাত্র ২৪ দিন তিনি তৃতীয় শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তাঁকে বিভাগীয় ইন্সপেক্টর স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত করেন। অল্পকদিনেই প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম চাঁদপুরের গণ্ডি পেরিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। খান বাহাদুর আবদুল হাকিম তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাটওয়ারী শিক্ষক রাজপুত্র। তাঁর জীবন ইতিহাস লিখে রাখার মত’।
ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী চারদশক শিক্ষকতা করেছেন। অসংখ্য ছাত্রের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীরাই ছিল তাঁর প্রাণ। মতলবের শিশুসংগঠক মাকসুদুল হক বাবলু তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন : ‘১৯৩১ সালে যখন তিনি মতলব হাইস্কুলের হাল ধরেন, তখন এটি ছিলো অখ্যাত। তাঁর নেতৃত্বের কারিশমায় শীঘ্রই এটি হয়ে গেল এক বিরাট ইতিহাস। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করে আনতেন। গরিব, মেধাবী ছাত্রদের আশপাশের গ্রামে জায়গীর করে নিতেন। প্রয়োজনে বিনা খরচে হোস্টেলে রেখে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতেন।’ ড. গাজী মোঃ আহসানুল কবীর লিখেছেন, আমরা শুনেছি খ্যাতিমান প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারী ‘সারা দিন স্কুল পরিচালনার পর সন্ধ্যায় হারিকেন হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তার ছাত্ররা, বিশেষ করে স্কলারশিপ ও ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীরা ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কি না তা দেখতে বেরোতেন। কাউকে কাউকে তখন পড়াও দেখিয়ে দিতেন।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ ড. আবদুল মতিন পাটোয়ারী তাঁরই ছাত্র। একই সঙ্গে প্রতিভাবান এবং সৎ মানুষ হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী ঈর্ষণীয় সুনাম অর্জন করেন। তৎকালীন বিভাগীয় ইন্সপেক্টর জ্যোতির্ময় লাহিড়ী তাঁর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ ছিলেন। তাঁর মতে, ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারীর মতো শিক্ষক তিনি কমই দেখেছেন।
ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। পাকিস্তান সরকারের ‘তঘমা-ই-খেদমত’ (১৯৬২), ইস্ট পাকিস্তান বেস্ট টিচার অ্যাওয়ার্ড (১৯৬৩), কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক স্বর্ণপদক (১৯৬৭), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন প্রদত্ত স্বর্ণপদক (১৯৮১) লাভ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করতেন। তাঁর রচিত ১৫টি গ্রন্থ রয়েছে।
বরেণ্য এ শিক্ষক ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মতলব জেবি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। তাঁর নামে ‘মরহুম ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী স্মৃতিসংসদ’ রয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, কুমিল্লা জেলা পরিষদ থেকে প্রকাশিত, পৃ. ৪২১-৪২২
২. রত্নগর্ভা চাঁদপুর, সম্পাদনা : মোহাম্মদ সফিউল আলম, আমাদের চাঁদপুর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০০৭, পৃ. ২৪-২৫
৩. নিবন্ধ : একজন শিক্ষক সমাজের ‘বাতিঘর’, ড. গাজী মোঃ আহসানুল কবীর
৪. শতবর্ষে মতলব হাইস্কুল ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারী, মোঃ মাকসুদুল হক বাবলু; দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ, ১১ জুন, ২০১৭
বুয়েটের উপাচার্য ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েট। এটি ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় ১৯৬২ সালে। খ্যাতনামা এ প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে দীর্ঘ আটবছর দায়িত্ব পালন করেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ। তাঁর কর্মকাল ২৫ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২৪ এপ্রিল ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি। মতলব উত্তরের পাঁচআনী গ্রামে। বাবা মততাজ উদ্দিন আহমেদ, মা রাহাতুননেছা। পড়াশোনা করেছেন নুনশিগঞ্জ হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালেফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫১ সালে ওয়াহিদউদ্দিন সহকারী অধ্যাপক পদে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যোগ দেন। তাঁর কর্মজীবন বর্ণাঢ্য। তিনি চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ, কারিগরি শিক্ষার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিআইটি কাউন্সিল বাংলাদেশের ভাইস-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি, মহাসচিব, প্রথম ন্যায়পাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ড. ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ ১৯৯০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মনোনীত হন।
কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় টিপিক অ্যাওয়ার্ড-১৯৬৭, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক-২০০১, আহসান উল্লাহ মিশন স্বর্ণপদক-২০০২ লাভ করেন। তিনি ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মতলবে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বুয়েটের এমোরিটাস অধ্যাপক ছিলেন।
তথ্যসূত্র
১. প্রয়াত প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ, জামিলুর রেজা চৌধুরী, রিচার্সগেট ডটকম
২. ড. ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ সংক্ষিপ্ত জীবনী, বুয়েট ওয়েবসাইট
৩. ড. ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ, দৈনিক যুগান্তর, ৪ নভেম্বর ২০১৮