প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
আমার মা আমার প্রথম শিক্ষক। মা আমাকে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ শিখিয়েছেন পরম মমতায়। কথা বলা শিখিয়েছেন মাতৃভাষায়। মা আমাকে সীতানাথ বসাক রচিত আদর্শলিপি পড়াতেন। এ বইটিতে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয় ছাড়াও কতগুলো নীতিকথা ছিলো। সেসব নীতিকথা মা সুরে সুরে পড়াতেন। এই নীতিকথাগুলো ছিলো জীবনঘনিষ্ঠ ও শিক্ষণীয়। মা পড়াতেন : ‘অসৎসঙ্গ ত্যাগ করো, ‘আলস্য দোষের আকর’, ‘উগ্রভাব ভালো নয়’, ‘ঊর্ধ্বমুখে মুখে পথ চলিও না’, ‘ওষধি ফল পাকিলে মরে’, ‘থপথপ করিয়া পথ চলিও না’, ‘ঋণ করা ভালো নয়’- আরো কতো কী! মা পড়াতেন আর প্রতিটি লাইনের নানা ব্যাখ্যা দিতেন। সবকিছুতে ছিলো একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার কথা।
মনে পড়ে সেদিনের কথা। মা ফাঁকে ফাঁকে গল্প বলতেন। জীবনের গল্প। পরণ কথা, পুরানো দিনের স্মৃতি কথা। মা শিল্পী আব্দুল আলিম ও আব্বাসউদ্দীনের গান শোনাতেন। বিভিন্ন লোকাচার, খনার বচন বলতেন। রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেকশিয়ালের বিয়া হচ্ছে। জোসনা রাতে মা আমাদের দুই ভাই বোনকে তার দুই পাশে শুয়ে তার শৈশবের নানা গল্প বলতেন, তার বান্ধবীদের কথা, তার বাবার বাড়ির স্মৃতি, রান্নাবান্নার কথা, ভূত-পেত্নীর গল্প বলতেন। অধীর আগ্রহে তা আমরা শুনতাম। মা জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারতেন। এই মাছ ধরার কৌশল মূলত তার বাবার বাড়িতেই আয়ত্ত করেছিলেন। আমাদের ঘরের আশপাশে জোয়ারে পানি আসতো। মা সন্ধ্যায় জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। মা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। মা শোলক বলতেন। সুন্দর সুন্দর শোলক বলতেন। মাকে প্রায় কাঁদতে দেখতাম।
মায়ের বাবা-মা তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে থাকতেন। পাঁচবছর, দশবছর পরপর তাদের সাথে দেখা হতো। আমার বাবাও থাকতেন দূরে। তাই মায়ের মনে বিরহ ও কষ্ট ছিলো। মা বিরহ বিচ্ছেদের গান গেতেন। শত কষ্ট, দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্যেও তার নিজের প্রতি অবিচল আস্থা ছিলো। আমাদের প্রতি দায়িত্ব ছিলো। আমরা দুই ভাই-বোন ছিলাম তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। একজন গৃহবধূর বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেকে আমরা শিখেছি কীভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, কীভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আমার যখন থেকে স্মৃতি মনে আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে মা-ই ছিল আমার শিক্ষক। আমি যখন প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে মাধ্যমিকে ভর্তি হই তখন মা আমাকে আর পড়াতেন না। তিনি ছায়ার মতো আমার পাশে বসে থাকতেন। আমাকে সময় দিতেন। আমার কিছু প্রয়োজন হলে সাথে সাথে এনে দিতেন। আমি যতোক্ষণ পড়াশোনা করতাম ততোক্ষণ মা আমার পাশে বসেই থাকতেন। বাবা এক মাস দুই মাস পরপর বাড়ি আসতেন। সাংসারিক জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন। আমাদের অনেক আনন্দ হতো। আমার মা চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করতেন। অর্থনৈতিক কষ্ট ছিলো তবুও তাকে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি। তিনি আমাদের ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দিতেন অন্যের জিনিস ধরা যাবে না, অন্যের সম্পদ খাওয়া যাবে না। শত কষ্ট ও বঞ্চনার মধ্যেও মা আমাদের নিয়ে সুখে দিন কাটাতেন। আমাদের বাড়ির অনেকেই স্বচ্ছল ছিলো, তবুও তিনি কারও কাছে কোনোকিছু জন্য হাত পাততেন না। তাকে কখনো রাগ হতে দেখিনি। সবসময় হাসি খুশি থাকতেন। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ ছিলো না। কথা কম বলতেন। সবসময় শান্তশিষ্ট থাকতেন। মায়ের সংসারজীবন প্রায় চল্লিশ বছর। এ চল্লিশ বছরে তার জীবনে অনেক ছন্দপতন হয়েছে। কিছু দুঃখের কিছু সুখের স্মৃতি মোড়ানো তার সংসারজীবন। তিনি আরো দুটি সন্তান লাভ করেন। তিনি সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছেন। আজ আমরা সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। পাশাপাশি পেয়েছি প্রকৃত শিক্ষা। মায়ের চল্লিশ বছর সংসারজীবনে আমি তার একনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছি ষোল বছর। মায়ের স্মৃতিবাহী সেই ঘরটি আজ খালি। সেখানে এখন কেউ থাকে না। মা এখন থাকেন শহরের কোনো উপকণ্ঠে। আমরা থাকি যে যার কর্মস্থলে। মায়ের সাথে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়। যখন মায়ের থেকে দূরে থাকি তখন হারানো দিনের স্মৃতি মনে করে বেদনায় ভারাক্রান্ত হই। দু চোখ জলে ভিজে যায়। চোখের সামনে ভেসে আসে অগণিত স্মৃতি। হারানো দিনের স্মৃতি। মায়ের রান্নাঘর। তার দিনযাপন। তার সংসারের টুকরো টুকরো স্মৃতি বারবার মনে আসে। মা আমাকে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সামাজিক মানুষে করে গড়ে তুলেছেন। তাই মা-ই আমার প্রথম শিক্ষক, আমার শিক্ষাগুরু।