প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
কিউ এম হাসান শাহারিয়ারপেশা? এটা আবার কী? আমার পেশা কী হবে? এমন চিন্তা ছাত্রজীবনে যে মনে আসেনি তা নয়। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ভালো করার পর আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব অনেকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? কোন সদুত্তর তখন দিতে পারিনি। তখন শুনতাম, সফল তারাই যারা ডাক্তার, উকিল, প্রকৌশলী, ব্যারিস্টার হয়। আমার আশা ছিল আমি এর যে কোনটি বেছে নেব। কিন্তু কীভাবে যে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়লাম তা নিজেও জানি না। তা-ও আবার ব্যবস্থাপনা বিষয়ের মতো গুরুগম্ভীর ও তাত্ত্বিক বিষয়ে। এই তাত্ত্বিক বিষয় কি একটি পেশা?
পেশা বলতে এমন বৃত্তিমূলক সেবাকর্মকেই বুঝায়, যা থেকেই ব্যক্তি তার জীবিকা নির্বাহ করে। এটা করার জন্যে ব্যক্তির বিশেষায়িত জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি তার সেবাকর্মের সামাজিক স্বীকৃতিরও প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এতো বৃদ্ধি পেয়েছে এখন এটা পেশা হিসেবে গণ্য করা হবে কি না সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্নের মীমাংসায় আসার আগে আমাদের দেখা দরকার পেশা কী। Professor Dalton Mc Farland পেশার নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেছেন-
১. পেশার একটি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানভাণ্ডার ও পদ্ধতি থাকে।
২. পেশার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রথাগত ও নিয়মমাফিক একটি পদ্ধতি থাকে।
৩. এতে পেশাদারীকরণের উদ্দেশ্যে গঠিত একটি প্রতিনিধিমূলক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠাতা থাকে।
৪. প্রত্যেক পেশার একটি সুসংগঠিত আচরণবিধি থাকে।
৫. প্রত্যেক পেশার পারিশ্রমিক ধার্য করার রীতি থাকে।
৬. পেশাদারী প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ গ্রহণ করা ও পেশাগত বৃত্তি বা ব্যবসায়ের জন্যে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা পেশার অন্যতম শর্ত।
প্রখ্যাত ব্যবস্থাপনাবিদ Kenneth R. Andrews -এ অভিমত দেন যে কোন বৃত্তি (occupation) পেশা কি না তা নির্ধারণে পাঁচটি মানদণ্ড রয়েছে। এগুলো হলো জ্ঞান, জ্ঞানের সুদক্ষ প্রয়োগ, সামাজিক দায়িত্ব পালন, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক সমর্থন। তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ উপাদানগুলোর পূর্ণমাত্রায় উপস্থিতি সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও ব্যবস্থাপনা ক্রমান্বয়ে পেশায় পরিণত হতে চলেছে। ব্যবস্থাপনার পেশাকরণের ক্ষেত্রে তিনি নিচের পাঁচটি গতিধারার উল্লেখ করেন-
১. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমস্যাবলি সমাধানে গতানুগতিক পদ্ধতি ও রীতিনীতির পরিবর্তে বিশ্লেষণমূলক ও পর্যালোচনামূলক পদ্ধতির প্রয়োগ।
২. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে অধিক পরিবর্তনসাধন ও নতুনত্ব উদ্ভাবন ও গ্রহণ।
৩. সরকারের সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কার্যকারী সম্পর্ক স্থাপন।
৪. সামাজিক সমস্যাবলি সমাধানে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদের উত্তরোত্তর ব্যবহার।
৫. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিকীকরণ।
যদিও আইন ব্যবসায়, চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য চার্টাড একাউন্টস ইত্যাদি পেশার ন্যায় ব্যবস্থাপনা একটি পরিপূর্ণ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি তবুও বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির ব্যাপক প্রসারে ব্যবস্থাপনার ওপর এত গুরুত্বআরোপ করা হচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। ব্যবস্থাপনাকরা এখন স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছেন, অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন এবং পেশাগত দক্ষতা দেখাচ্ছেন। তাদের উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলন ঘটছে। এ কারণেই জর্জ এস.ক্লড (George S.Claude) যথার্থই অভিমত ব্যক্ত করেন, “ব্যবস্থাপনা এখনো সরাসরি পেশায় পর্যায়ভুক্ত নয়। তবে এটা খুব দ্রুত এবং দীর্ঘ পদক্ষেপ পেশার পথে অগ্রসর হতে চলেছে”
বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা পেশাদারীকরণ এখনো সুদূঢ় পরাহত। এর কারণগুলো নিচে দেওয়া হল-
১. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যে শিক্ষা দিচ্ছে তাতে যে জনশক্তি তৈরি হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। এ শিক্ষার একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে শিক্ষাপাঠ্যক্রম পশ্চিমা ধাঁচে তৈরি যা বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট থেকে অনেক দূরে।
২. বাংলাদেশের অধিকাংশ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা মূলত বংশানুক্রমিক এবং এদের ব্যবস্থাপনার পরিবারের কায়েমী স্বার্থের প্রভাব যথেষ্ট। এ সকল প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিবারের সদস্যরাই পরিচালক পদে মনোনীত হন। তারা দৃষ্টিভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় (management by inheritance) ধারা এখানে এখনও বর্তমান। এদের অনেকেরই পেশাগত ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা ও যোগ্যতা থাকে না এবং ব্যবস্থাপনার নীতি, দর্শন, মূল্যবোধ ও আচরণবিধি প্রয়োগে আগ্রহী নয়।
৩. বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কর, শিল্পবিরোধ, অনিয়মিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, ঘুষ-দুর্নীতি প্রভৃতি সমস্যায় এত বেশি জর্জরিত যে ব্যবস্থাপনার পেশাদারীকরণে তারা আগ্রহ প্রকাশ করে না।
৪. বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগুলো মালিকানা এবং ব্যবস্থাপনা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং পরিবারভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানগুলো একমাত্র উদ্দেশ্য হল মুনাফার সর্বাধিকীরণ।
৫. পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের কর্তা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পেশাগত যোগ্যতা থাকে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণে আধুনিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষতা প্রতিফলিত হয় না।
৬. বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সংস্থা যেমন আইন ব্যবসা নিয়োজিত আইনজীবিদের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের, প্রকৌশলীদের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টদের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস প্রভৃত্তি সংস্থা রয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পেশা নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ধরনের কোন সংস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি।
৭. বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবস্থাপকই ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। তারা দ্রুত মুনাফা বৃদ্ধির জন্য চোরাকারবারীর ও অন্যান্য অসাধু পন্থায় লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করে না।
উপরে বর্ণিত হতাশাব্যঞ্জক চিত্রের বিপরীতে নিচে বর্ণিত কিছু ভাল নজিরও দেখা যায়
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইইঅ এবং গইঅ কোর্স পড়ানো হচ্ছে। এগুলোর মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এই ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওইঅ এই কথা উল্লেখ করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের পাস করা শিক্ষার্থীরা দেশে এবং বিদেশে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কাজে নিযুক্ত পেয়ে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। এছাড়া Bangladesh Institute of Bank management, Bangladesh Insurance Academy, Bangladesh Institute of administration & management, Bangladesh Institute of Management, Bangladesh Institute of personnel management দক্ষ ব্যবস্থাপক তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ২. বেশকিছু অগ্রসরমান দেশী প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশে ব্যবসায়রত বহুজাতিক কোম্পানি তাদের ব্যবস্থাপক স্তরের নিয়োগে গইঅ ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। ৩. উচ্চতর ব্যবস্থাপনা ও স্তরে পদোন্নতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকার অপেক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হচ্ছে। ৪. কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন ইসলাম গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, ব্র্যাক, আকিজ গ্রুপ সামাজিক দায়িত্বপালনে এগিয়ে এসেছে। এদের চিকিৎসাসেবা, শিক্ষাদান কর্মসূচি, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতাল স্থাপন, দুস্থ নারী ও শিশু সহায়তা কার্যক্রম সমাজে প্রশংসনীয় অবদান রাখছে। ৫. ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সংগঠন FBCCI এ নিয়মিত ব্যবসাসংক্রান্ত গবেষণা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের আচরণবিধিমালা তৈরি হচ্ছে। এ সংগঠন সরকারের সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর সম্পর্কস্থাপনে ভূমিকা রাখছে। বিদেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের ব্যবস্থাপনার ধরণ সম্পর্কে দেশীয় ব্যবসায়ীদেরকে অবহিত করছে। ৬. ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও MBA Association, Dhaka University Management Association, Association of diploma in personnel management গড়ে উঠেছে এবং এগুলোর এদের সদস্যদের জন্য code of conduct তৈরি করেছে।
সুতরাং আশা করা যায়, সকল সমস্যার মোকাবিলা করে বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিকাশ ঘটবে এবং ব্যবস্থাপনা দ্রুত পেশাদারিত্বের দিকে এগিয়ে যাবে।
ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবস্থাপনা
ব্যক্তি যখন জীবনব্যাপী অগ্রগতি লাভের উপায় হিসেবে কোন পেশা বা কাজকে গ্রহণ করে তখন তাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্যারিয়ের বলে আখ্যায়িত করা হয়। ক্যারিয়ার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনে সন্তুষ্টি, স্থায়িত্ব ও শৃঙ্খলা আসে। ব্যক্তি তার জীবনের স্বাদ অনুভব করে। সুতরাং বলা যায় যে, ক্যারিয়ার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রচেষ্টা চালায়? প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টার মাধ্যমে যে আর্থিক সচ্ছলতা লাভের পাশাপাশি তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা সম্মান ও কর্তৃত্ব অর্জন করে।
শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম যে, এমন একটি মজার ও বাস্তবসম্পন্ন বিষয়ের শিক্ষক আমি। আমি ধন্য, সৌভাগ্যবান, গর্বিত যে, আমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ের ছাত্র ও শিক্ষক। ভালো থাকুক এই বিষয়ের সংশ্লিষ্ট সকলে।
কিউ এম হাসান শাহারিয়ার : সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ।