প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষকের একটি লেখা পড়ছিলাম। প্রকাশিত নিবন্ধে উক্ত শিক্ষক বলেন, ১২-১৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে একজন শিক্ষককে যে কত কষ্টে চলতে হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। বেতনের এই টাকা থেকে একদিকে যেমন তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য পাঠাতে হয়, অন্যদিকে তার নিজের খরচের জন্যও রাখতে হয়। সার্বক্ষণিক আর্থিক টানাপোড়নের মধ্যে থেকে শরীর-মনে শান্তি ও আনন্দের সঙ্গে তিনি যে ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াবেন, সেই অবস্থা আর থাকে না।
দৃশ্যত হিসাব-নিকাশের অঙ্কে কথাটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ একই যোগ্যতা নিয়ে সমান কারিকুলামে পাঠদান করে যদি সরকারি স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে আয়বৈষম্যের কারণে একজন বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকের জীবনমানের পার্থক্য থাকে, তাহলে এই শ্রেণির শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বস্তির সঙ্গে মানসম্মত পাঠদান প্রত্যাশা করা যায় না। দেশের ৯০ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষককে সরকার থেকে পাওয়া এই অর্থে দিন গুজরান করতে হয়। আধপেটা থেকে একজন শিক্ষক কীভাবে নিজেকে আদর্শ শিক্ষকরূপে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে প্রমাণ করবেন?
সরকারি স্কুলশিক্ষকদের সঙ্গে আয় ও জীবনমানের বৈষম্য নিরসনের জন্যে শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি নিয়ে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকগণ আন্দোলন করেছেন। তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক। সমাজে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের মধ্যে ভোগবিলাস, চাওয়া-পাওয়ার যে রেইস চলছে, সীমাহীন চাহিদা মেটানোর যে প্রতিযোগিতা, শিক্ষকগণও সামাজিক জীব হিসেবে এই বৃত্তের বাইরে নন। অতএব, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। ঢাকাসহ দেশের যে কোনো জায়গায় কোচিং বাণিজ্য খুব রমরমা। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষকদের মনোযোগী হয়ে শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে সরকার অবশ্য কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আইন প্রণয়ন করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষকগণের সরকারি পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেতনবৈষম্যের কথা খুব একটা শোনা যায় না। প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষকদের বেতন-ভাতা তো অনেক বেশি। পাবলিক-প্রাইভেট শিক্ষকদের যে বেতনের বৈষম্য, তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নির্ধারিত ক্লাস সেরে প্রাইভেট ভার্সিটিতে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে পুষিয়ে নেন বলে শোনা যায়। তাছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় ফি, বিভিন্ন পরীক্ষায় পরিদর্শন ও পরীক্ষক হিসেবে শিক্ষকগণ সম্মানী ভাতা হিসেবে যে উপার্জন করেন, তা দিয়ে ভালো জীবনমান বজায় রাখা কঠিন নয়। অতিরিক্ত কাজে সময় ব্যয় হওয়ায় আমাদের মেধাবী শিক্ষকগগণ গবেষণার কাজে খুব একটা সময় দিতে পারছেন না বলে অনেকে মনে করেন। পক্ষান্তরে পালটা যুক্তি হচ্ছে, গবেষণা খাতে সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত না থাকায় শিক্ষকগণ গবেষণা করতে পারছেন না। বিতর্ক যা-ই থাক, মোদ্দা কথা হচ্ছে, উচ্চ শিক্ষায়তনে চলমান এই অবস্থা দেশের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেসন ওয়ার্ল্ড ইউনিভারসিটি এবং কিউ এস র্যাংকিং সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে। ২০২৪ সালার জন্য প্রকাশিত এই তালিকায় বিশ্বের ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান পায়নি বলে সংবাদ সূত্রে প্রকাশ। আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে মানসম্মত গবেষণাপত্রের গুণগত মানের ভিত্তিতে এই র্যাংকিং করা হয়।
শিক্ষা তো বাণিজ্য নয়। অন্য সব পেশার সঙ্গে শিক্ষকতাকে গুলিয়ে ফেললে জাতি গঠনের মূল চালিকাশক্তিকেই লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হবে। শিক্ষকগণ জাতি গঠনের কারিগর, জাতির বিবেক, পথপ্রদর্শক, সভ্যতার অভিভাবক- এই কথাগুলো সক্রেটিসের আমলে যে রকম সত্য ছিল, এই যুগেও একইভাবে সত্য। আমাদের এ দেশেও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা শিক্ষকগণই দিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১-এর রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমি মহান শিক্ষকগণই রচনা করেছেন। আবার সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে দুর্যোগকালে প্রেরণা, সাহস ও বুদ্ধি দিয়ে জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন।
উল্লেখ্য, সেকালের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেননি। নিয়েছিলেন জীবনের মহান ব্রত হিসেবে। অর্থ-বিত্ত, অধিক সম্পদ অর্জন তাদের কাছে প্রত্যাশার বিষয় ছিল না। বেতন বাড়ানোর দাবিতে কোনো দিন শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে তাদের রাস্তায় নেমে আসার কথা শোনা যায়নি। একদিকে নিজেদের নিরন্তর জ্ঞানচর্চায় নিযুক্ত রাখা, অন্যদিকে ছাত্রদের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল শিক্ষকের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ও স্বপ্ন। ছাত্রের লেখাপড়ার অগ্রগতি ও তাদের নৈতিকতা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে সেকালের অনেক শিক্ষককে স্কুলের পর ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নিতে শোনা যায় এবং অমনোযোগী ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে পাঠদান করাকেই তারা দায়িত্ব মনে করতেন। সত্তরের দশক পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদানের বিষয়ে খুব একটা শোনা যায় না। শিক্ষকগণ ছিলেন সমাজের একেবারে নিম্ন আয়ভুক্ত মানুষ। আর্থিক অসচ্ছলতা নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও সমাজের মানুষের শেষ বিশ্বাস ও ভরসার স্থল ছিল এই হতদরিদ্র শিক্ষক সম্প্রদায়। ত্যাগ, তিতিক্ষা, সেবা ইত্যাদি দিয়ে সেকালের একেক জন শিক্ষক মিথ তৈরি করে গেছেন।
কালপ্রবাহে মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। একালে অর্থই সাফল্যের মাপকাঠি। যার কাছে অর্থ আছে, সমাজে তার কদরই বেশি। যার অর্থ নেই, সমাজে সে দয়ার পাত্র। অর্থের কাছে আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থহীন, ফাঁকা বুলি। এ জন্যই চলছে অর্থ-সম্পদ অর্জনের দুর্নিবার প্রতিযোগিতা। শিক্ষকগণও এই প্রতিযোগিতার বাইরে নন। তবে আগেই বলেছি, একালেও ব্যতিক্রমী শিক্ষক আছেন। তবে তারা বড় কোণঠাসা, স্রোতের বাইরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে নিরাশ্রয়ে সন্তর্পণে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলতে হয়। তাই জাতির বিবেক, সভ্যতার অভিভাবক হিসেবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষকদেরই কালের কালো ছায়া দূর করে সমাজকে আলোর পথে নিয়ে যেতে হবে।