বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

সরকার আবদুল মান্নানের কথা
আবদুল্লাহ আল মোহন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১০.

বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা, তার মেরুকরণ ও তার সার্বিক ফলাফল আমাদের মনে নানা অতৃপ্তি জন্ম দিচ্ছে; সে-কারণে শিক্ষা, বাচনকলা ইত্যাদি নিয়েও তাঁর চিন্তাশীলতা পাঠককে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত। ‘মানসম্মত শিক্ষা’ নিয়ে ভাবনা তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। যেমনটি পরিচয় পাই ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পঠন-পাঠন’ প্রবন্ধে। সরকার আবদুল মান্নান লিখছেন, ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই স্লোগানের দিন শেষ হয়েছে। এখন শ্লোগান হলো ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’। আর মানসম্মত শিক্ষার প্রশ্নটি যখন উত্থাপিত হয় তখনই বিবেচনায় নিতে হয় একটি দেশের সকল অধিবাসীকে, সকল নাগরিককে। আর এই অধিবাসীদের মধ্যে আছে সংস্কৃতিগত ভিন্নতা ও ভাষাগত ভিন্নতা। এই ভিন্নতাকে যদি মানসম্মত শিক্ষার বলয়ে নিয়ে আসা যায় তা হলেই মানসম্মত শিক্ষা একটি সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করবে। মানসম্মত শিক্ষার এই সার্বজনীনতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিশুকে তার মাতৃভাষায় শেখার অধিকার নিশ্চিত করা। কেননা, একজন শিশু যতটা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে এবং আনন্দের সঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারে অন্য কোনো ভাষায় তা কখনই সম্ভব নয়। একই মতামত প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো। ‘ÔEducation in a multilangual world’ নামে একটি প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে [ ৃ ] research has shown that learners learn best in their mother tongue as a prelude to and complement of bilingual education approaches.’ মাতৃভাষায় শিখন-শেখানোর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয় (identity), জাতীয়তাবোধ ও ক্ষমতার বিষয় জড়িত। কোনো শিশুর পড়াশোনা যদি শুরুই হয় অন্য ভাষায় তা হলে তার মধ্যে পরিচয়ের, জাতীয়তাবোধের ও ক্ষমতায়নের সঙ্কট দেখা দেয় এবং শিক্ষার্থীরা সহজাত এক শিখনপ্রক্রিয়ায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হয়।’

১১.

একজন অনুবাদক হিসেবেও সরকার আবদুল মান্নান আমার কাছে সম্মানিতজন। বিশেষ করে তাঁর অনূদিত ডিক গেগরির আত্মজীবনী থেকে ‘আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি’ রচনাটি আমার ভীষণই প্রিয় বলে অনেকের কাছেই উল্লেখ করে থাকি এবং সেটি পাঠ করতে উদ্দীপ্ত করি। আমার মতে রচনাটি প্রতিটি শিক্ষকের জন্য পাঠ আবশ্যিক, বাধ্যতামূলক করা উচিত। আমরা শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীর মানসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে অনেকসময়ই দারুণ অবহেলা করি, শিশু শিক্ষার্থীর মনোজগতকে জানার চেষ্টা না করেই নিয়মের অক্টোপাসে আটকে ‘জিপিএ’র ‘বনসাই’ বানাতে সদা তৎপর থাকি আর সেটাকেই সাফল্য বলে ধন্য ধন্য বলি নিজেদের। এক্ষেত্রে ডিক গেগরির আত্মজীবনীটি আমাদের শিক্ষকদের আত্মপরিচয় উন্মোচনে সবিশেষ সহায়ক হতে পারে বলেই বিবেচনা করি। আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী পিতৃপরিচয়হীন এক কৃষ্ণাঙ্গ ডিক গেগরি। উল্লেখ্য, এই মানুষটি ধনী আমেরিকায় দরিদ্রতম শৈশব অতিবাহিত করেন। অসাধারণ এক সংগ্রামমুখর জীবনে তিনি শেষপর্যন্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার একজন ভাষ্যকার হিসেবে এবং লেখক ও ব্যবসায়ী হিসেবে। বিশেষ করে কালো মানুষদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এই অসাধারণ মানুষটির শৈশবের এক যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়ের পরিচয় পাওয়া যায় আমি ‘কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি’ নামক ক্ষুদ্র আত্মজীবনীতে। সেটিরই সফল অনুবাদ করেছেন মান্নান ভাই। তাঁরই অনুবাদে রচনার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠ করা সময়ের দাবির কারণেই জরুরি। ডিক গেগরি অকপটে লিখেছেন, ‘আমার ঘরে এবং আমার পরিবারে আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি। লজ্জিত বা অপমানিত হওয়ার কারণও কখনো ঘটেনি। স্কুলে যাওয়ার পর আমি প্রথম ঘৃণার মুখোমুখি হই, অপমান ও লজ্জার মুখোমুখি হই। তখন কত হবে আমার বয়স? সাত। সাতের বেশি নয়। শিক্ষক ভেবেছেন আমি বোকা আর বেয়াদপ আর অপদার্থ। বানান করতে পারি না। পড়তে পারি না। অঙ্ক পারি না। বোকার হদ্দ। শিক্ষক কখনোই বুঝতে চাইবেন না যে তুমি খুব ক্ষুধার্ত। সকালে নাস্তা খেতে পাওনি। খিদের জ্বালায় তুমি পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছ না। তোমরা হয়তো দুপুরের খাবারের কথা ভাবছ। দুপুরের খাবার তো হবেই। কিন্তু সেই খাবার কি সত্যি সবার আসে? আসে না। সে ক্ষেত্রে একজন ক্ষুধার্ত শিশু হিসেবে তুমি অন্য শিশুদের খাবারে কামড় বসাতে পারো। আমার জীবনে সবকিছুই ছিল অভূতপূর্ব, দুর্লভ। বিস্ময়কর দারিদ্র্য নিয়ে আমার ছিল নিত্য বসবাস। ধুলো আর দুর্গন্ধময় জীবন, কনকনে ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপানো জীবন, এক বস্ত্রে নিত্যদিন কাটানোর জীবন এবং বাধাহীন এতিম জীবন- এই সব নিয়ে আমার যে জীবন- অখাদ্য পেস্টির স্বাদ সেখানে মন্দ নয়। শিক্ষক ভেবেছিলেন, আমি গোলমাল পাকানোর ছেলে। রুমের সামনে থেকে তিনি সবাইকে দেখছিলেন। আর দেখছিলেন পেছনের চক দিয়ে গোল দাগ দেওয়া সিটে বসে আছে একটি কালো ছেলে। বদমাইশ ছেলে। গ-গোল পাকানোর ছেলে। কাছে-পিঠের সবাইকে সে খোঁচাচ্ছে, উত্যক্ত করছে। আর আমার মনে হলো তিনি সত্যিকারের দুষ্ট ছেলেটাকে দেখছেন না।

শিক্ষক আমার দিকে তাকালেন। তিনি ক্ষিপ্ত। পাগল প্রায়।

‘রিচার্ড, আমরা অর্থ সংগ্রহ করছি তোমার জন্য। তোমার প্রতি দয়া দেখানোর জন্য আমাদের এই আয়োজন। তোমার বাবা যদি পনের ডলার দিতে পারেন তা হলে তো রিলিফ নিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই। তা-ই না?’

‘জি, মেম। টাকাগুলো আমি এখনই পেয়েছি। এই কিছুক্ষণ আগে। বাবা আমাকে দিয়েছেন। বলেছেন আমি যেন।’

‘আরও কিছু?’

আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই শিক্ষক অবজ্ঞা আর কৌতুকের সঙ্গে জানতে চাইলেন। তখন তার নাসারন্ধ ফোলা, ঠোঁট কম্পমান পাতার মতো হালকা এবং চোখ বিস্ফোরিত। বললেন তিনি,

‘আমরা জানি, তোমার কোনো বাবা নেই। তুমি এতিম।’

হেলেন আমার দিকে তাকাল। তার চোখ জলে ভরা। আমার অসহায়ত্ব তাকে বেদনা-ভারাক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমি আর তার দিকে তাকাতে পারলাম না। আসলে আমিও তখন কাঁদছিলাম।’ (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়