প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
মানুষের জীবনের সোনালি সময় কোন্টি? এ প্রশ্নটি করা হলে অধিকাংশই উত্তর দিবেন ছাত্রজীবন। আমিও তার থেকে ব্যতিক্রম নই। সেই সোনালি অধ্যায়গুলোর একটি অধ্যায় কেটেছে চাঁদপুর সরকারি কলেজে। একেবারে গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি মফস্বল শহর ও নতুন বিদ্যাপীঠের অঙ্গনটি নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয়। মনে যেমন ভয় ছিল তেমন ছিল স্বপ্ন ও শিহরণ। সময়টি ১৯৯৮ সাল। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষে চাঁদপুর সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হতে আসি। তখন বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা ছিল। একজন শিক্ষার্থীর তিনটি বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ ছিল। আমি বাংলা বিষয় নিয়ে পড়ব বলে শুধু বাংলা বিষয়েই ভর্তি পরীক্ষা দিই। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে আসি। প্রথমদিন শিক্ষকদের নাম জানা সম্ভব হয়নি। পরে সবার নাম জেনেছি এবং সবার সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। এখনও মনে পড়ে মমতাজ ম্যাডাম ও ফৌজিয়া ম্যাডাম ভর্তির কাজগুলো সম্পাদন করেছিলেন। বিভাগে তখন শিক্ষক হিসেবে ছিলেন প্রফেসর ড. জয়নাল আবেদীন, মনোহর আলী, মমতাজ বেগম, প্রণব কান্তি চৌধুরী, শায়লা নাসরিন, ফৌজিয়া রুমি ও তাহমিনা কবির।
প্রথমদিকে বাড়ি থেকে কলেজ বাসে আসা-যাওয়া করে ক্লাস করতাম। ১৯৯৮-এর বন্যার কিছুদিন আগে চাঁদপুর চলে আসি এবং প্রফেসরপাড়ায় একটি মেসে উঠি। অনার্স প্রথম বর্ষে আমরা ৬০ জন ভর্তি হয়েছিলাম। আমার ক্লাস রোল ছিল ১২১০। বর্তমান ২নং ভবনের নিচতলায় বাংলা বিভাগের অবস্থান ছিল। দোতলায় ছিল হিসাববিজ্ঞান বিভাগ। প্রথম বর্ষ থেকে নিয়মিত ক্লাস করেছি। বাংলা বিভাগের দুটি শ্রেণিকক্ষে আমরা ক্লাস করতাম। সেমিনার কক্ষে আড্ডার পাশাপাশি রেফারেন্স বই পড়তাম। বাবরি চুলের মনোহর আলী স্যার পাঞ্জাবি পরে যখন ক্লাসে ঢুকতেন অসাধারণ লাগত। স্যারের পড়ানোর স্টাইলও ছিল ব্যতিক্রমী। মেঝেতে পা রেখে টেবিলে আধো বসা আধো দাঁড়ানো ভঙ্গিতে তিনি পুরো সময়টা তার বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। মূল বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রেফারেন্স বইয়ের প্রসঙ্গ আলোচনা করতেন। স্যারের মুখে শুনে আর্নেস্ট হেমিং ওয়ের ‘দ্যা ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি’ গ্রন্থটি পড়ি। অসাধারণ উপন্যাস। প্রণব স্যারের ক্লাসে ডায়েরিতে যে নোট করেছি শিক্ষকতা জীবনে এসেও তা কাজে লাগিয়েছি। স্যারের পড়ানোর কৌশল অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। ফৌজিয়া ম্যাডামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য পড়ানোর দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। তাহমিনা ও ফৌজিয়া ম্যাডাম একসঙ্গে থাকতেন, একসঙ্গে চলতেন। ক্লাসের বাইরে যখনই দেখা হতো হাসি দিয়ে কথা বলতেন, লেখাপড়ার খোঁজ নিতেন। মমতাজ ম্যাডামের পুরানো বাসায় আমরা কয়েকজন মিলে মেস করে থাকতাম বলে ম্যাডামের সঙ্গে অনেকটা পারিবারিক সম্পর্কের মতো হয়ে গিয়েছিল। ম্যাডামকে খালাম্মা বলে সম্বোধন করতাম। ম্যাডামের সাথে আমৃত্যু এ সম্পর্ক বজায় ছিল। অনার্স প্রথম বর্ষে ভালো রেজাল্ট করায় শিক্ষকদের আদর-স্নেহ পেয়েছি। অনার্স তৃতীয় বর্ষের শেষ সময়ে ফৌজিয়া ম্যাডাম ইন্তেকাল করেন। আমরা বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা ওনার জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য ঢাকায় যাই। তৃতীয় বর্ষের শেষদিকে বিভাগে যোগদান করেন তানজিনা ফেরদৌস ম্যাডাম। খুব বেশি ক্লাস করার সুযোগ হয়নি। পরে ওনাকে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পর ভাইভার আগে বিভাগে যোগদান করেন প্রফেসর মিহির কান্তি রায়। অসাধারণ বাগ্মী। যাকে বলা যায় কথার যাদুকর। মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন সবাইকে। শিক্ষক হিসেবে বেশিদিন না পেলেও পরে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি।
মূল বিষয়ের পাশাপাশি আমাদের সময় সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে ইসলামের ইতিহাস ও সমাজকর্ম পড়তে হয়েছিল। সমাজকর্মের নুরুল ইসলাম স্যার ও আতিক স্যারের ক্লাসের কথা মনে পড়ে। দুজনেই গুণী শিক্ষক ছিলেন। আতিক স্যার কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করে চাকরি থেকে অবসর নেন। ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিশাত ম্যাডামের ক্লাসের কথা স্মৃতিতে ভাস্বর। ওয়ালীউল্লাহ স্যারকে ক্লাসে না পেলেও স্যারের বাসার কাছে থাকতাম বলে স্যারের সঙ্গে পরিচয় ছিল। স্যারের কাছে একদিন ‘ঝঃৎববস ড়ভ পড়হংপরড়ঁংহবংং’-এর অর্থ জানতে চেয়েছিলাম। স্যার সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে প্রথম দিকে কয়েকটা গ্রুপ ছিল। শহর থেকে যারা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে তারা গ্রাম থেকে আসা বন্ধুদের সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে চাইতো। পড়ালেখার বিষয়ে সবার মধ্যে একটা গোপন প্রতিযোগিতা চলতো। অবশ্য একসময় সেগুলো দূর হয়েছিল। সবার সাথে আন্তরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে অনার্স অধ্যায় শেষ করেছি। শেষ করেছি এ কারণে বলা, মাস্টার্স পড়তে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। অনার্স জীবনের অধিকাংশ সহপাঠী সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছে মাহফুজ, শাহীন, জসিম, সাগর, জাকির, মানিক, জুয়েল, রুবেল (কবি), জেসমিন, পান্না, শাহীন, রুমাসহ অনেকে। মামুন চাঁদপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে আছে মাসুম। লেখাপড়া শেষ করে প্রথম কর্মস্থল হিসেবে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ২০০৬ সালের ২ এপ্রিল প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। ২০০৮ সালে বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা একটি সংগঠন করি ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পরিষদ’। সংগঠনের কল্যাণে পুরানো বন্ধুদের সাথে মাঝে সাক্ষাৎ হয়। ২০১৬ সালে আমরা বাংলা বিভাগের রজতজয়ন্তী পালন করি।
আমাদের সময় এখনকার মতো এতগুলো বিষয়ে অনার্স ছিল না। অনার্স বিভাগ হিসেবে তখন বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, অর্থনীতি, গণিত বিভাগ ছিল প্রথম সারির। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় তখন বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তখন আন্তঃবিভাগ প্রতিযোগিতা হতো। আমাদের সময়ে দুবার আন্তঃবিভাগ ফুটবল খেলার কথা এখনও মনে পড়ছে। আন্তঃবিভাগ ফুটবল খেলায় একবার বাংলা ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে ফাইনাল খেলা হয়। বাংলা বিভাগের ফুটবল দলের একজন সদস্য হিসেবে ফাইনালে খেলা এখনও স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে। স্যার ও ম্যাডামদের উচ্ছ্বাস-উৎসাহ ছিল অবর্ণনীয়। দুর্ভাগ্যজনক, ফাইনালে আমরা হেরে গিয়েছিলাম। আমাদের দলের সদস্য ও সহপাঠী মাহফুজ উল্যাহ খানের একটি পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ছাত্রজীবনের খেলার স্মৃতি হিসেবে আজও আমার কাছে জার্সিটি সংরক্ষিত আছে। আরেকবার ইংরেজি বিভাগের সঙ্গে আমরা ক্রিকেট ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন হই। কলেজ মাঠে আমরা সকালবেলা ফুটবল খেলতাম। বৃষ্টির দিনে একবার খেলতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কুদ্দুস ভাইয়ের হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল।
চাঁদপুর সরকারি কলেজে নববর্ষ উদযাপন, বসন্তবরণ অনুষ্ঠানের প্রথম সূচনা করে বাংলা বিভাগ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বিভিন্ন সাহিত্যিকের জয়ন্তী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জাঁকজমকভাবে পালিত হতো। নবাগত শিক্ষকের বরণ ও বিদায়ী শিক্ষকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও বাংলা বিভাগে আমরা আয়োজন করতাম। এসকল অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। পরবর্তী সময়ে এসব অনুষ্ঠান বাংলা বিভাগের ঐতিহ্যে পরিণত হয়। শিক্ষা সফর নিয়মিত হতো। লঞ্চে করে আমরা একবার ষাটনল শিক্ষা-সফরে যাই। প্রথম শিক্ষা সফর হিসেবে অসাধারণ ভালো লাগা। এখনও পুরো দিনের দৃশ্য চোখে ভাসে। লঞ্চের ছাদে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রণব স্যারের নাচ এখনও স্মৃতিতে অমলিন। লঞ্চে ঢাকা যাওয়া-আসার পথে প্রতিবারই সে স্মৃতি নাড়া দেয়।
সে সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর তিতাস চৌধুরী। তিনি হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও গুণী, সজ্জন ও সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন। সাহিত্যবিষয়ক অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। ‘অলক্ত’ নামে সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। উপাধ্যক্ষ হিসেবে তখন ছিলেন প্রফেসর বজলুর রহমান স্যার। অসাধারণ রসিক মানুষ ছিলেন। স্যার থাকতেন ডরমেটরির একটি কক্ষে। স্যারের কক্ষের পাশ দিয়ে প্রফেসর পাড়া যাওয়ার রাস্তা। আমার সাথে মেসে থাকতো ডিগ্রি পড়া এক বন্ধু। সে প্রায়ই যাওয়ার সময় গলার স্বর পরিবর্তন করে স্যারকে ‘বজলু ভাই’ বলে ডাক দিত। একদিন স্যার উত্তর দিলেন ‘আপনে আমার কেমন ভাই হন’। সেদিনের পর আর সে স্যারকে নাম ধরে ডাকেনি।
আমাদের সময় কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন দলের মিছিল মিটিং-এ কলেজ সরগরম থাকত। কখনো কখনো আধিপত্য নিয়ে প্রায় মারামারি হতো। মাঝেমধ্যে দেশীয় অস্ত্রের মহড়াও দেখেছি।
১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চাঁদপুর সরকারি কলেজে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কেটেছে বলে অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে এ বিদ্যাপীঠ ও সহপাঠীদের নিয়ে। শিক্ষকতা জীবনের ১৭ বছরও এ কলেজে কেটেছে। তথাপি শিক্ষা জীবনের চার বছরকে শ্রেষ্ঠ সময় বলতে হচ্ছে। সে স্মৃতি এখনও মনের গহীনে নাড়া দিয়ে যায়। এ কলেজের শিক্ষার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে সে প্রত্যাশা অবিরত।
শরীফ মাহমুদ চিশতী : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, স্নাতক, বাংলা বিভাগ, শিক্ষাবর্ষ : ১৯৯৭-৯৮; সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।