বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

সহপাঠী আজফার হোসেন
কামরুল হাসান

কলেজে তার নাম ছিল সক্রেটিস। মা-বাবার দেওয়া নাম নয়, সহপাঠীদের দেওয়া নাম। সহপাঠীরা সকলেই মেধাবী, বত্রিশটি স্কুলের ফার্স্টবয় জড়ো হয়েছে একটি কলেজে, যার ভেতর বেশ কয়েকজন বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থানপ্রাপ্ত, রয়েছে দুই বোর্ডের দুই ফার্স্ট স্ট্যান্ড, কামরুল ইসলাম ও গোলাম সামদানী। তাদের মাঝে জ্ঞানীর আখ্যা পাওয়া কম কথা নয়। দার্শনিক সক্রেটিসকে আমরা চোখে দেখিনি, তাঁর পোষাক-পরিচ্ছেদ কেমন ছিল জানি না। আজফার হোসেন ছিল পোষাকে উদাসীন, স্নানবিমুখ, নিজের শারীরিক ভালোমন্দের প্রতি নির্বিকার। তার মেধাবী মাথাটি ভরে ছিল বিবিধ জ্ঞানজিজ্ঞাসা ও উত্তরে। সেসব চমকিত করেছিল শুধু সহপাঠিদের (আহা, মুগ্ধ হবার মতো একজন সহপাঠিনীও ছিল না একশভাগ ছেলেদের কলেজটিতে) নয়, কলেজের শিক্ষকদেরও। বয়সের তুলনায় আজফার হোসেনের এই এগিয়ে থাকা, জ্ঞানের গভীরতা অনেকসময়েই বিব্রতাবস্থায় ফেলত তার শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যখন সে ভর্তি হয়, তখন শ্রেণিকক্ষে তার ডিসকোর্স গুণী শিক্ষকদের করতো মুগ্ধ, নবীন শিক্ষকদের করতো নড়বড়ে।

প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করার এক সংস্কৃতিতে আমরা বড়ো হয়েছি, নিজস্ব মতামত ও চিন্তা বিকাশের চেয়ে জোর দেওয়া হয় অপরের লেখা (এরা হলেন এক্সপার্ট হেডমাস্টার) মুখস্থ করে পরীক্ষাপত্রে উদগীরণ করার। ঠিক এই কারণেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় আজফার হোসেনের সৃজনশীল উত্তরগুলো সমাদৃত না হয়ে কম নম্বর পেয়েছিল, মেধা তালিকায় সে স্থান পায়নি। এখন বুঝতে পারি সে ছিল তার পরীক্ষাপত্র মূল্যায়ন করা পরীক্ষকদের চেয়ে এগিয়ে, বিশেষ করে তার ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় দখল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আজফার ছিল তরুণ প্রতিভা, ইংরেজিতে একে বলা হয় ঢ়ৎড়ফরমু। উচ্চ মাধ্যমিকে সে বোর্ডের মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান পেয়েছিল, এর একটি কারণ ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ইমেজ। যে কলেজে দুই বোর্ডের দুজন ফার্স্ট বয় এবং বেশ কিছু মেধাতালিকার ছাত্র আছে, সে কলেজের খাতা গুরুত্ব দিয়েই দেখেন পরীক্ষকগণ।

ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে আমাদের ব্যাচটির ৪৫ জনই ছিল বিজ্ঞান বিভাগের; মাত্র ৩জন ছাত্র নিয়ে মানবিক বিভাগটি ছিল যথার্থই ক্ষুদ্র। আমাদের ইংরেজি ও বাংলার ক্লাসগুলো একসাথেই হতো। সেসব ক্লাসে দেখেছি আজফারের মেধার দীপ্তি ও বাকচাতুর্য। আমার সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সাহিত্যপ্রীতি থেকে, আমরা দুজনেই কবিতা লিখতাম, আমি শুধুই বাংলায়, আজফার বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই। অবাক হই না গবেষক ও প্রাবন্ধিক আজফার হোসেনের প্রথম গ্রন্থ ঈযৎড়সধঃড়হবং ইংরেজি কবিতার। এই বই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আমাদের কলেজ জীবনের সখ্য এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে একবার কলেজ ছুটিতে আজফার আমাকে রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে তার ছোটো খালার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই স্বপ্নময় ভ্রমণটি আমি কখনো ভুলব না। সেই ভ্রমণ আমাকে আজফারের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ করে তোলে, তার অসম্ভব স্নেহশীল মায়ের স্নেহ পাবার সুযোগ করে দেয়। বস্তুত আজফারের মায়ের মতো স্নেহশীল মা আমি খুব কম দেখেছি, বা দেখিনি। আমি তার সন্তানের বন্ধু, তাতেই যে আদর আমি পেয়েছি, তা মাতৃতুল্য। ঐ বয়সেও তিনি আজফারকে হাতে তুলে খাইয়ে দিতেন, পিঠে সাবান ঘষে, পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দিতেন। আজফার ছিল তার স্বপ্নের শিশু, ঈশ্বরপ্রদত্ত এক অমূল্য ধন, সমগ্র জীবনের আকাঙ্ক্ষার ফসল। তবে মায়ের অতিআদরে সে উচ্ছন্নে যায়নি, সে আরও পুস্তকবিলাসী, মেধামনস্ক ও সংসার উদাসীন হয়েছে। মা তাই চাইতেন, ছেলে যেন সবকিছু নির্বিঘ্নভাবে পায় তার ব্যবস্থা করতেন। মায়ের আরও তিনটি সন্তান ছিল, তাদেরকে তিনি নিয়োজিত রেখেছিলেন বড়োটির সেবাযত্ন করতে। আমার মনে আছে তাজমহল রোডে তার কক্ষে সংখ্যাতীত বইয়ের ভেতর বসে আজফার পড়াশোনা করতো আর দুই বোনকে ফরমায়েশ দিত চা বানাতে। এক সকালেই অসংখ্যবার চা পান করতো সে। কোন দুষ্টচক্রে পড়ে সে তরুণ বয়সেই সিগারেটে আসক্ত হয়েছিল। আদর্শবাদী পিতার কড়া শাসনের প্রহরা ডিঙিয়ে ছোট ভাইটি ছুটত সিগারেট আনতে। পিতাকে ভয় পেত আজফার, মা তাকে ঝড়ঝাপটা থেকে আগলে রাখতেন।

রাজশাহী থেকে ঢাকা ফেরার পথে আমরা ফরিদপুর শহরে থেমেছিলাম, যে শহর থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল আজফার। এ শহরের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল সে, গভীরভাবে। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই পরীটিকে দেখাতে। দুর্ভাগ্য, তার দেখা মেলেনি, কেবল যে উঠোনে তার পা পড়ে সেই উঠোনটি দেখেছিলাম। বন্ধুর প্রেমিকার প্রতি আমার এতখানি আবেগ ছিল যে মনে আছে সেসময় একটি কবিতা লিখে ফেলেছিলাম তাকে নিয়ে, যার শুরুর পঙক্তি ছিল, 'নতমুখী উঠোনের শৈল্পিক ধারে, অলস পদপাতে ভরে তোল দুপুরের বিজন প্রহর।' অথচ নতমুখীর মুখ কেন, পা-ও দেখতে পাইনি। সে সময়ে আজফারের লেখা একটি পঙক্তি এখনো মনে গেঁথে আছে, গেঁথে থাকবে আজীবন, 'দুপুর উপুড় করে ঢেলে নিব আছে যত রৌদ্র।' আশ্চর্য যে আজফারের সেই প্রেমিকা কয়েকবছর পরে এসে ঢাবির ইংরেজি বিভাগেই ভর্তি হয়, কিন্তু ততদিনে তার প্রতি বিশিষ্ট আবেগ অবশিষ্ট নেই। আজফার চলে গেছে ভিন্ন প্রেমিকার দখলে। তাকে দেখেছি ভালোবাসার টানে কারফিউ উপেক্ষা করে মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডি চলে যেতে । আমেরিকাতে সে যাকে বিয়ে করেছিল সেই মেলিসা টেনিসন ছিলেন কবি লর্ড টেনিসনের বংশধারার মেয়ে, উত্তরাধিকার।

কলেজ জীবনে আজফার ছিল অস্থির প্রকৃতির এক যুবক। শিক্ষকরা আড়ালে গেলেই সে সিগারেটে আগুন ধরাত আর ধোয়ার কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে কঠিন সব বিষয় ভেবে চলত। তার হস্তাক্ষর, বিশেষ করে ইংরেজি হস্তাক্ষর ছিল টাইপ রাইটারে লেখা অক্ষরের মতো ক্ষুদ্র, গুটিগুটি আর নিটোল। ফলে তার ঘনসন্নিবদ্ধ লেখা উত্তরপত্রে অপর্যাপ্ত দেখাত। আমার অনুমান, বিঘৎ মেপে নম্বর দেওয়া পরীক্ষকদের কাছে তা পর্যাপ্ত মনে হতো না। মাধ্যমিকে তার স্ট্যান্ড না করার এটি একটি কারণ হতে পারে। সে যে স্কুল লেভেলের শিক্ষকদের থেকে ভালো ইংরেজি জানতো এ ব্যাপারে আমরা ছিলাম নিঃসংশয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও তাকে ভুগিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের একাডেমিক সংস্কৃতিতে ছাত্রের প্রশ্ন করা, দ্বিমত পোষণ করাকে শিক্ষক মনে করেন শিক্ষকের জ্ঞানের প্রতি চ্যালেঞ্জ বা বেয়াদবি। আজফার হোসেনদের মতো সৃজনশীল চিন্তা ও গভীরতাসম্পন্ন ছাত্ররা সিস্টেমের বাইরে পড়ে বেখাপ্পা হয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে তার ব্যাচের সেরা মেধাবী ছাত্র হয়েও আজফারকে অনার্সে প্রথম শ্রেণি দেওয়া হয়নি। যেসব বালিকাদের দেওয়া হয়েছিল তাদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মাস্টার্সে অবশ্য তাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি, সে প্রথম হয়েছিল, তবে প্রথম শ্রেণিতে নয়, সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট। আজফারকে প্রথম শ্রেণি দিতে হবে বলে সে বছর কাউকেই দেওয়া হয়নি। এই হতাশাব্যঞ্জক ফলাফলের কারণে তার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে শিক্ষক হতে পারেনি। তাকে লুফে নিল প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর ।

স্নাতক পর্যায়ের ওই অবিচারের জবাব সে দেয় ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স করতে গিয়ে। তার ফোর আউট অফ ফোর সিজিপিএ ছিল দশ বছর আগের রেকর্ডকে স্পর্শ করা এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রথম কোন অশ্বেতাঙ্গ ছাত্রের পারফেক্ট সিজিপিএ অর্জন। আজফারের বাবাকে লেখা এক চিঠিতে আজফারের থিসিস সুপারভাইজার জানিয়েছিলেন যে তার বিশ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আজফারের চেয়ে মেধাবী ছাত্র তিনি পাননি। আজফারকে তিনি বলেছেন Stellar স্টুডেন্ট। ওই ফলাফল এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বিবিধ কর্মশালায় কথা বলা, একাডেমিক লেখালেখি ও সাহিত্য সম্পাদনা দেখে বিমুগ্ধ আমেরিকার বেশ কিছু শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়, যার ভেতরে ছিল হার্ভার্ড, আজফারকে পিএইচডি বৃত্তি দিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকগণ আজফারকে ছাড়তে চায়নি, আজফারও প্রিয় শিক্ষকদের হতাশ করতে চায়নি। সে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হলেও তার পিএইচডি গবেষণা interdisciplinary, যাতে সাহিত্যের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন ও পলিটিকাল সায়েন্স এসে মিশেছে। তার কাজে মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদা, আন্তনিও গ্রামসি, জাক লাকা, এডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়াম চমস্কি এবং অতি অবশ্যই এসে মিশেছেন কার্ল মার্ক্স। তার অভিসন্দর্ভটি ছিল সে বছরের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গবেষণাপত্র।

আত্রাই অঞ্চলে একসময় কমিউনিস্ট আন্দোলন বেশ বেগবান ছিল। আজফার তখন বালক, সুতরাং সেই আন্দোলনের কোনো প্রভাব তার ভেতরে থাকার কথা নয়, কিন্তু মাটির একটি সোঁদা গন্ধ থাকে যা বাতাসে ছড়ায়, কিছু গল্প থাকে যা মুখে মুখে ফেরে। নিজের জীবনে শ্রেণিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা, চারপাশের নষ্টভ্রষ্ট সময়, অন্তরে লালন করা মানবিক আবেগ, অত্যাচার ও শোষণের প্রতি ঘৃণা তার ভেতরে যে জমিন তৈরি করেছিল তাতে সবচেয়ে সোনালি ফসল হলো র‌্যাডিকাল হিউম্যানিজম, যা পরে গড়িয়ে যায় মার্ক্সবাদে। অনুমান করি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে, বিশেষ করে কিছু মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকের সংস্পর্শে এসে সে কমিউনিস্ট মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তার প্রিয় শিক্ষকগণ যেমন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক কাশীনাথ রায় প্রমুখ ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসে পেল অধ্যাপক আনু মোহাম্মদকে, লেখক শিবিরে এসে পেল অধ্যাপক বদরুদ্দিন উমর, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হককে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ এই চার বছর আজফার লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। বুদ্ধিজীবি ড. সলিমুল্লাহ খানের সাথে তার পরিচয় ঢের পরে। এদের বাইরে তার সখ্য ছিল বিতর্কিত বুদ্ধিজীবি ফরহাদ মজাহারের সাথে। এডওয়ার্ড সাঈদ আর নোয়াম চমস্কির দেশ আমেরিকা এসে আজফারের বাম ঝোঁক আরো বেড়ে যায়, পিএইচডি গবেষণার সূত্রে সে গভীরভাবে পাঠ করে গ্রামসি, দারিদা, ফুকো, বাখতিন, আলথুসার। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ তার আগেই পড়া।

অনেকগুলো বছর আজফার ও আমি মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে থেকেছি। আজফারের পড়াশোনার জন্যই ওর মা-বাবা রাজশাহী ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছিলেন। আমরা একই সড়কের দুই প্রান্তে থাকতাম, তখন থেকেই আজফারের মায়ের সাথে আমার মায়ের

বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমি যখন বিয়ে করে ঘরসংসার পেতেছি আজফার তখনো একাকী। আমাদের কমন বন্ধু ছিল কাজল ভাই ও মনজুর। তুমুল আড্ডা হতো আমাদের। কাজল ভাই ও আজফার দুজনেই ছিল তুমুল ধূমপায়ী, ফলে নেশার প্রান্ত এসে মিলত। মনজুর ছিল আজফারের প্রতিভামুগ্ধ এক ভক্ত, যার ভেতরে দুটি পরস্পরবিরোধী জগতের সম্মিলন ঘটেছিল। তখন দেখেছি ঢাবির দুই মেধাবী তরুণ মাশরুর আরেফিন ও জিয়াউল করিম ঘনঘন তাজমহল রোডে আজফারের বাড়িতে আসতো। আসতো অপূর্ব রূপবতী নিলুফা খান।

ডিপার্টমেন্টে আরেকদল অনুসারী দ্বারা পরিবৃত থাকতো আজফার। এরা হলো দাউদ আল হাফিজ, পারভেজ আহমেদ খান প্রমুখ। সক্রেটিসের যেমন শিষ্য ছিল এরা তেমনি আজফারের শিষ্য। আর আজফার তো সক্রেটিসই!

আজফার প্রত্যহ সকালের বাসে চড়ে জাহাঙ্গীরনগরে যেত আর দুপুরের বাসে চড়ে ফিরে আসত। একবার তার সাথে জাহাঙ্গীরনগর গিয়ে প্রত্যক্ষ করি নাট্যকার ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক সেলিম আল দীনের সাথে তার গভীর সখ্য। দুজনেই প্রতিভাবান, তুমুল আড্ডাবাজ ও চেইন স্মোকার। আমার ইচ্ছে শ্রেণিকক্ষে বসে আজফারের লেকচার শোনা। ছাত্ররা জড়ো হয়েছে, অপেক্ষাও করছে অনেকক্ষণ ধরে, আজফার একবার ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সঙ্কীর্ণ ক্যান্টিনে যায়; একবার মোহাম্মদ রফিকের কক্ষে, অন্যবার শাহীন কবিরের কক্ষে, ক্লাসে আর যায় না। বেলা বাড়ে, আজফারের ছাত্ররাও অসীম ধৈর্যশীল, তারা গুরুর জন্য অপেক্ষা করে। পরে যখন সে বক্তৃতা শুরু করলো, আমি অভিভূত হয়ে গেলাম, গোটা ক্লাস পিনপতননীরব। সেদিনই বুঝেছিলাম কী অসামান্য শিক্ষক আজফার হোসেন, যখন সে মন দিয়ে পড়ায়।

আজফার সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও বিবিধ বিষয় পড়ায় (interdisciplinary subjects) তাতে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ থেকে শুরু করে বর্ণবৈষম্য, জেন্ডার ইনইকুয়ালিটি-অনেক বিষয় চলে আসে। আমেরিকার গ্রান্ড ভ্যালি ইউনিভার্সিটিতে সে পড়াচ্ছে। এর আগে সে আমেরিকার আরও তিনটি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য, কালচারাল স্টাডিজ এবং এথনিক স্টাডিজ পড়িয়েছে। এগুলো হলো ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি, বৌলিং গ্রীন স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি। ওকলাহোমা শুনেই আমার মন নস্টালজিক হয়ে উঠল, কেননা কৈশোরে আমি প্রথম যে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ছবি দেখি তা এই ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি। তখুনি স্বপ্ন জেগেছিল যদি আমেরিকা যাই, ওখানেই পড়ব। হায়, আমার স্বপ্ন! যা আমি ছুঁতে পারিনি, আজফার সেসবের চূড়ায় গিয়ে বসেছে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি আজফার বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ'- এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই কেন্দ্রের ইংরেজি, বিশ্ব সাহিত্য এবং ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজের অধ্যাপকও আজফার হোসেন।

সে নোয়াম চমস্কির শিষ্য কি না জানি না, তবে চমস্কির মতোই নির্ভীক ও সত্যবাদী। তার ভেতরে পার্হেসিয়া কাজ করে। আমেরিকার মাটিতে বসেই সাম্রাজ্যবাদের কট্টর সমালোচক, সমাজতন্ত্রের প্রতি তার পক্ষপাত প্রকাশে দ্ব্যর্থ। পশ্চিমের গণতান্ত্রিক সমাজের ওই এক অব্যর্থ গুণ, তা বিরুদ্ধ মতবাদকে প্রশ্রয় দেয়, সমালোচনা সহ্য করে। এই সহিষ্ণুতা ও উদারতা ঐসব দেশ ও সমাজকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমরা যে জ্ঞানবিজ্ঞানে এগুতে পারিনি তার উত্তরও ঐখানে নিহিত। আমরা অসহিষ্ণু ও গোড়া, মূর্খতায় আমাদের অধিবাস, সঙ্কীর্ণ মতবাদে আমাদের গড়াগড়ি।

বহুবছর ধরে শুনি সে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো একসঙ্গে ছয়খানা কিতাব লিখছে। বছর গড়ায়, কিতাব আর আসে না। সে জড়িয়ে ছিল হাজারটা কাজে। অবশেষে গতবছর প্রকাশিত হলো বিষয়ে তার অভিজ্ঞানের নির্যাস, দার্শনিক উক্তি ও উপলব্ধির বই 'দর্শনাখ্যান'। মনে পড়লো ড. হুমায়ুন আজাদের কথা, যার সাথে আজফারের বিতর্ক এক সময় আলোড়ন তুলেছিল। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে, দৈনিক আজকের কাগজের ঝিকাতলা মোড়ের অফিসে পাশাপাশি চেয়ারে বসে তাদের দুজনের তর্ক ও ক্রমতর্কাতর্কি। হুমায়ূন আজাদ যেহেতু শিক্ষক, আজফার পর্যাপ্ত সম্মান রেখেই কথা বলছিল, কিন্তু হুমায়ুন আজাদ ছিলেন, শিক্ষকের উঁচু অবস্থান (hierarchy) থেকে, কর্তৃত্বপরায়ন ও আক্রমণাত্মক! হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছের সাথে কিছুটা আঙ্গিকগত মিল থাকলেও প্রবচনগুচ্ছ যেখানে জনপ্রিয়তা অভিমুখী, ঝোঁক চমক সৃষ্টি, সেখানে দর্শনাখ্যান গভীরতাসন্ধানী, ঝোঁক দার্শনিক অভিঘাত সৃষ্টি । দেখি আজফারের বিপুল ভক্ত ও ছাত্রকুল সেই বই সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছে 'সংহতি' স্টলে। চুপিচুপি একটি কপি সংগ্রহ করি আর লিখে ফেলি আমার মুগ্ধতা। সে আলোচনা ভালো লাগে আজফারের। এ বছর প্রকাশিত হয়েছে তার আরো একটি বই। নিরন্তর লিখে চলেছে আজফার হোসেন। যেমন প্রজ্ঞাপূর্ণ তার লেখনি, তেমনি ক্ষুরধার তার কথামালা। টেলিভিশন চ্যানেল ও টকশোগুলো এই বাক্যের তরবারি কাজে লাগায়। বহুবছরের পঠনপাঠন, গবেষণা ও শিক্ষাদান এসে জড়ো হয়েছে এক বিরল মেধাবী মস্তিষ্কে। আজফার ফি বছরই মা ও মাটির টানে বাংলাদেশে আসে, এখানকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর কোনো কেনোটি তাকে বিমানভাড়া দিয়ে নিয়ে আসে। সে এক সেমিস্টার পড়ায়, মায়ের দোয়া নেয় আর চড়ুইপাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় চমস্কির দেশে, যেখানে তার প্রাণপ্রিয় কন্যা সালমা থাকে। অনেক ভালোবাসায় ধন্য আজফার হোসেন এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার মেয়েকে, বাবার মেধার দীপ্তি যার ভেতরে ক্রমপরিস্ফুটমান। ঢাকায় এলে তাকে টানতে থাকে পত্রিকাগুলো, তাদের পাতায় লেখার জন্য। একবার সে ঞযব ঘবি অমব পত্রিকায় লিখেছিল Micronarratives বলে এক অসামান্য সিরিজ। দ্য নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। দ্বিতীয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা। এনটিভিতে আজফারের উপস্থাপনায় একটি সাহিত্যে সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান হতো, যা ছিল প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয়। আজফারের বাগ্মিতা আর জ্ঞানের খবর জেনেছিল সবাই। রবীন্দ্রনাথ হোক কিংবা নজরুল - আজফারের বিশ্লেষণ গতানুগতিকতার বাইরে, ভিন্ন আলো ফেলে।

আজফার হোসেন হয়ে উঠেছে আমাদের কালের একজন তুখোড় সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক, সাহিত্য সন্দর্শী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। আত্মবিক্রয়ের যে লম্বা সারি এখন বুদ্ধিজীবি ও লেখকমহলে প্রত্যক্ষ করি, তাতে আপোষহীন ও নির্লোভ বুদ্ধিজীবি থাকাটাই বিরল ঘটনা। আজফার হোসেনের মতো মেধাবী বুদ্ধিজীবি ও মুক্তচিন্তক এই সঙ্কটকালে তাই এতো জরুরি। এক্ষেত্রে তার শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সহযোদ্ধা বদরুদ্দিন উমর ও সলিমুল্লাহ খানের মতোই নির্ভীক ও নির্লোভ সে। তাকে আমার অভিবাদন। এমন মেধাবী বন্ধু থাকাটাই গর্বের। আশা করি সে দীর্ঘজীবন লাভ করবে এবং অনেক চিন্তাশীল গ্রন্থ আমাদের উপহার দিবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়