বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

সরকার আবদুল মান্নানের কথা
আবদুল্লাহ আল মোহন

১.

২১ জুলাই ছিল তাঁর জন্মদিন। তিনি অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান (Sharkar Abdul Mannan), আমার প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় গবেষক, শিক্ষক মান্নান ভাই। তিনি ১৯৬৪ সালের এই দিনে চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার জহিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যের স্বজন, নন্দন শিল্পের পরম আত্মীয় মান্নান ভাইকে জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছা, সশ্রদ্ধ অভিবাদন, অতল ভালোবাসা। আপনার জন্মদিন শুভ হোক, প্রিয় মান্নান ভাই। আপনি ভালো থাকুন, জীবনানন্দে বাঁচুন, সুস্থ ও সুন্দর থাকুন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিরন্তর। প্রিয় গবেষক, লেখক সরকার আবদুল মান্নান রচিত আলোচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’, ‘শিক্ষা ও স্বদেশচিন্তা’, ‘কবিতার রূপকল্প ও আত্মার অনুষঙ্গ’, ‘গল্পের আল্পনা’, ‘কবিতার স্থাপত্যরীতি ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘বাংলা কথাসাহিত্য আধুনিকতার কুশীলব’ অন্যতম। শিশুসাহিত্যের প্রতি রয়েছে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। তাঁর লেখা শিশুতোষ গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : দুষ্টু রাজকুমার ও অন্যান্য গল্প, জলের সঙ্গে শৈশব, কাক ও পুতুলের গল্প, ইঁদুর শিকারি ডুরি, পালতোলা নৌকা, জ্যোছনা রাতে ভূত, গল্পগুলো চিরকালের (সম্পাদিত), চিল ও মুরগীর ছানা। উল্লেখ করা অপ্রসাঙ্গিক হবে না যে, প্রিয় এই মানুষটি এবং তাঁর রচিত বইয়ের সমালোচনাসহ স্বতন্ত্র একাধিক রচনাও রয়েছে আমার।

২.

তাঁর পিতার নাম মোঃ আবদুল হাকিম সরকার এবং মায়ের নাম মিসেস মমতাজ বেগম। স্ত্রী ফেরদৌসী মমতাজ এবং কন্যা সেঁজুতি ও পুত্র সাকিবকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান আমাদের প্রাণের শিক্ষাঙ্গন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে ১৯৮৫ সালে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৮৬ সালে স্নাতকোত্তর, ১৯৯৫ সালে এম.ফিল এবং ২০০২ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে বর্তমানে দায়িত্বপালনকারী অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল মান্নান বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের একজন সম্মানিত সদস্য। তিনি ইতিপূর্বে বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন শিক্ষা সংক্রান্ত নানান সরকারি দপ্তরেও। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে থাকলে প্রজ্ঞাবান শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করে তারা ঋদ্ধ, আলোকিত ও আলোড়িত হতো যেমনটি, তেমনই গবেষক-লেখক হিসেবে মান্নান ভাই নিজের সৃজনীশক্তির, লেখক সত্ত্বার প্রতি আরো বেশি সুবিচার করতেন বলেই গভীরভাবে বিশ্বাস করি। জীবনের অভিজ্ঞতায় জেনেছি, সহায়ক পরিবেশের অভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্য বিকাশ শক্তিতে নিদারুণভাবে ব্যাহত করে, বিনষ্ট করে, ক্ষয় হয় সাধকের আরাধনা নিমগ্নতার মনোসংযোগ ভাব-অনুভবের। এর ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজ করে জীবনীশক্তি-স্বপ্নের অপচয়, অবক্ষয় করতে হয়, ‘সময় খেয়ে ফেলে’ ‘সবারে আমি নমি’র নামতা জপের মোহে, আসক্তি রোগ ভোগে। তবে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতেই হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে বর্তমানে দায়িত্ব গ্রহণ করে ইতিমধ্যেই তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে কয়েকটি যুগান্তকারী নীতিমালা প্রনয়ণে সবিশেষ ভুমিকা পালন করে আমাদের মনে দাগ কেটেছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থালা-বাটির বদলে সকলক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের বই এবং শিক্ষা সামগ্রী উপহার প্রদান, মেন্টর নিয়োগ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানোর কথা না বললেই নয়। মানসম্পন্ন ও সুশিক্ষা সুনিশ্চিতকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের মান বজায় রাখা, আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশ সুনিষিশ্চত করা, দেশপ্রেম জাগরণ ও সমাজসচেতনতা সৃষ্টি ও বিকাশে সহ-শিক্ষামূলক কার্যৃক্রমসমূহ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিজন শিক্ষকের সক্রিয়তায়-অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণসহ তাঁর আরো নানাবিধ স্বপ্ন- কৌশল-নীতিমালার প্রতি আমার প্রবল আশাবাদ রয়েছে। আশা করছি সেগুলোও সরকারী নীতিমালায় পরিণত হবে। আনন্দময় সহশিক্ষার নানান সৃজনশীল আয়োজনের আমার অনেক তথাকথিত ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র মতোন ‘পাগলামী’র পরম উৎসাহ-অনুপ্রেরণাদানকারী এই স্ববান শিক্ষাবিদের, শিক্ষা-প্রশাসকের প্রতি তাই আমার পরম আস্থা এবং দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।

৩.

তাঁর পরম স্নেহাশীষ প্রীতির অবিরল ধারা সবসময়ই আমার জন্য অবারিত ছিলো, আজো আছে তেমনই। তাঁর সাথে দেখা হওয়া মানেই শিল্পকথনে মেতে উঠার না থামা আনন্দময় অভিযাত্রা, জম্পেস বিতর্কের ঝড় তুলে অভিজ্ঞান লাভের অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তাঁকে চিনি তাঁর মনস্বীতার কারণে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার আরেক প্রিয়জন অনি’দা (অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহালী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক-গবেষক), বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে। পরে ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’-এর নিচে বসে বিশ্বসাহিত্যের দিকশূন্যপুরে পরিভ্রমণ করেছিলাম আমরা। মনে পড়ে সেই রাতের কথা, আমি তখন মানিকগঞ্জে সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করি। বন্ধুবর মামুনের (মানিকগঞ্জের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা জজ) কাছে আমার খোঁজ পেয়ে মান্নান ভাই হাজির হয়েছিলেন আমাদের আস্তানায়, জমেছিলো আলোকিত আলাপন। এরকম আরো অজস্র সম্প্রীতির স্মৃতির রেখাচিত্র আঁকা আছে আমাদের জীবনে, আছে কথায় কথায় রাত হয়ে যাওয়া ক্ষণের দিবারাত্রির কাহিনিও।

৪.

অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান আমাদের সাহিত্য-আলোচনার জগতে এক উল্লেখযোগ্য নাম। রচনার মনস্বীতার কারণেই মননশীল পাঠকসমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য। তাঁর ভাবনার বিচরণ ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে সাহিত্যের প্রতি একনিষ্ঠ মমত্ত্ববোধ ও নিজস্ব সাহিত্য-চিন্তন। ভাষা, সাহিত্য, রবীন্দ্ররচনা, আধুনিক গদ্যসাহিত্য ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের উপরে তাঁর রয়েছে অগাধ পাণ্ডিত্য। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’ গবেষণা গ্রন্থটি যেমন আমার চিন্তাজগতকে নাড়া দেয় তেমনি তাঁর পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভের পরিমার্জিত রূপে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন : নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ গ্রন্থটিও আমার প্রিয় একটি গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করি। স্বীকার করতে সংশয় নেই, অনেকের পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ রচনা পাঠের সুযোগ হয়েছে কিন্তু সেগুলোর মান এতটাই নিম্নস্তরের যে আমার মতোন অনেকেরই পি.এইচ.ডি-র প্রতি ভীতি জন্মে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই মনস্বীতায়, আপন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণী ও মৌলিক ভাবনার বৈভবে মান্নান ভাইয়ের ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন : নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ গবেষণা গ্রন্থটি অনন্যতা দাবি করে। গ্রন্থটি পাঠের পর গবেষক হিসেবে মান্নান ভাই পাঠকের সমীহ আদায় না করে ছাড়েন না। কারণ তাঁর গভীর পাঠ অভিজ্ঞান প্রসূত মূল্যায়ন বহুমাত্রিকতা লাভ করে শব্দঘর সৃষ্টি করে, নিজস্ব ভাষা স্বাক্ষর তৈরি করেন। এখানেই গবেষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব, সাফল্য অন্যদের চেয়ে আলাদাই নন, স্বতন্ত্র। বাংলা কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রযুগের অন্তিমপর্বের সমকালীন কিছু সাহিত্য সাধকের হাতে যে জটিল মানব প্রকৃতির বঙ্কিম ও বহুরৈখিক চরিত্র ক্রমশ উন্মোলিত হয়েছিলো, সেই ধারাবাহিকতার যাত্রাবিন্দু নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, মধ্যপথে জগদীশ গুপ্তের সাক্ষাৎ মেলে এবং একই পথে অনেক দূর হেঁটে যান মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখযোগ্য এই তিনজন কথাশিল্পীর উপন্যাসে বাঙালি সমাজের অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের যে চরিত্রচিত্রণ উঠে এসেছে তার গভীর চিন্তাশ্রয়ী ও বিশ্লেষণ নির্ভর গবেষণাগ্রন্থ ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন : নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’। গ্রন্থের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : মনোদৈহিক অসুস্থতার চালচিত্র’ প্রবন্ধটিও মানিককে বোঝার জন্য মানিকপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য রচনা বলে বিবেচনা করি।

৫.

অচেনা জগদীশ গুপ্তকে নতুন করে চেনা-জানার সুযোগ হয় তাঁর ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’ গবেষণাগ্রন্থটি পাঠের মধ্য দিয়ে। আমরা জানি, কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত ( জন্মঃ ২২ আষাঢ়, ১৮৮৬ - মৃত্যুঃ ১৫ এপ্রিল, ১৯৫৭ ) কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ছোটগল্পকার হিসেবেই বাংলা সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেন। তিনি গল্প ও উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অনেকেই তাঁকে বাংলা ছোটগল্পের জনক বলে থাকেন। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে তাঁর গল্পের বই ‘বিনোদিনী’ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রংশসা করেছিলেন “ছোটগল্পের বিশেষ রূপ ও রস তোমার লেখায় পরিস্ফুট দেখিয়া সুখী হইলাম” এই বলে। যদিও বাংলঅ সাহিত্যে পতিতাণ্ডপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথও যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ অসহিষ্ণু ও সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে জগদীশ গুপ্তের ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাসের আলোচনায়। তবে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা কথাসাহিত্যের যে আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন, উত্তরপর্বে সেই রুচি, রূপ, রীতি ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য ও বিচূর্ণ করে কথাসাহিত্যে যে পালাবদল এসেছিল, এক ভিন্ন অর্থে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন তার প্রধান ঋত্বিক। মনে করতে পারি, রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের প্রায় অর্ধ-শতক পরে এই ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাস সম্পর্কে একালের সমালোচক মূল্যায়ন করেছেন : “কাম্য বিষয়ের স্পষ্টতায় এবং স্পষ্ট কামনার সঙ্গে প্রাক্তনের কর্মফলের সংঘাতে ব্যক্তির চূর্ণীকৃত রূপরচনায় লঘুগুরু অনুপম। লঘুগুরু তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাস হলেও সার্থকতায় বোধ করি জগদীশ গুপ্তের সর্বোত্তম রচনা” (‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৭১; পৃ. ২৬৪)। স্বতন্ত্র স্বাক্ষরে কথাশিল্পী জগদীশ গুপ্ত 'বিজলী', 'কালিকলম', 'কল্লোল' প্রভৃতি সেকালের নূতন ধরনের সকল পত্রিকাতেই গল্প প্রকাশ করেছেন। গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রকাশভঙ্গীর স্বাতন্ত্র্যের জন্য সাহিত্যিক মহলে বিশিষ্ট স্থান পেয়েছিলেন। ছোটগল্পের বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন জগদীশ গুপ্ত। গভীর জীবনবোধ, সুঠাম কাহিনীবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্যে তাঁর ছোটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। মনোবৈকল্য ও মনোবিশ্লেষণ এবং দুঃখময়তার নিপুণ বর্ণনায় তাঁর শিল্পকর্ম এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সামাজিক অন্যায়-অবিচারের চেয়ে অদৃষ্টলিপিই দুঃখময়তার কারণ বলে তাঁর গল্পে বিশ্লেষিত। জগদীশ গুপ্ত জন্মেছিলেন সেকালের নদীয়া জেলার মহকুমা-শহর কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরে আমলাপাড়ায়। অবশ্য তাদের আদি আবাস ছিলো ফরিদপুর জেলার খোর্দ মেঘচারমি গ্রামে। পিতা কৈলাশচন্দ্র গুপ্ত কুষ্টিয়া আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন। পিতার কর্মসূত্রে জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া জেলার আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে কলকাতা সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। অতঃপর কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে এফ. এ পরীক্ষা দিয়ে কলেজের পাঠ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে কলকাতা কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট থেকে শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শিক্ষা গ্রহণ করেন। বীরভূম জেলার সিউড়ি জজকোর্টে টাইপিস্টের চাকুরী লাভ করেন ১৯০৮ সালে। সেখানে ৪/৫ বছর চাকুরীর করার পর উড়িষ্যার সম্বলপুরে একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে পুণরায় টাইপিস্টের চাকুরী গ্রহণ করেন ১৯১৩ সালে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটায় চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন তিনি। অতঃপর কলকাতার "জাগো'স ইঙ্ক" নামের ফাউন্টেনপেনের কালি তৈরীর একটি কারখানা খোলেন। এ ব্যবসায় উন্নতি করতে না পেরে ১৯২৭ সালে বোলপুরের চৌকি আদালতে আবারো টাইপিস্টের চাকুরীতে যোগদান করেন। সেখানে একটানা ১৭ বছর চাকুরীর করার পর ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর কুষ্টিয়ায় বাস করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কুষ্টিয়া ত্যাগ করে কলকাতায় গমন করেন ও সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। জগদীশ গুপ্ত রচিত গল্পগ্রন্থঃ বিনোদিনী (১৩৩৪); রূপের বাহিরে (১৩৩৬); শ্রীমতি (১৩৩৭); উদয়লেখা (১৩৩৯); শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী (১৩৪১); মেঘাবৃত অশনি (১৩৫৪); স্বনির্বাচিত গল্প (১৩৫৭) উপন্যাসঃ অসাধু সিদ্ধার্থ (১৩৩৬); লঘুগুরু; দুলালের দোলা (১৩৩৮); নিষেধের পটভূমিকায় (১৩৫৯); কলঙ্কিত তীর্থ (১৩৬৭), কবিতাণ্ডসঙ্কলনঃ অক্ষরা। স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীর ‘জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্গ ও পঙ্গজ’ গবেষণা গ্রন্থটির পাঠও আমার জগদীশ গুপ্ত প্রীতির ক্ষুধা নিবৃত্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো। আমার জগদীশ প্রেম সৃষ্টি হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে, সেই জগদীশ গুপ্ত পাঠ আগ্রহ তীব্রতায় সবিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে মান্নান ভাইয়ের ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’ গবেষণাগ্রন্থটি। আমার একান্ত অবোধ বিবেচনায় অনেক গ্রন্থ রচনা করলেও এই গবেষণাগ্রন্থ দু’টির কারণেই অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জগতে আলোচিত গবেষক হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখিত হবেন।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়