বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০

পাঠদান পদ্ধতিতে গবেষণা অব্যাহত থাকুক
অনলাইন ডেস্ক

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মুখ্য অংশীজন শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করেই শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের বিপুল আয়োজনের সিংহভাগ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সম্ভবত সারা পৃথিবীতে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষার মূল উপপাদ্য এবং বাকি যেটুকু আছে, তার সবটুকুই শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক করে তোলার চেষ্টা। কারণ ব্যক্তিমানুষ থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও দেশ পরিচালনার ভবিষ্যৎ কর্ণধার তারাই। এমনকি আধুনিক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রতিটি দেশের তরুণ জনশক্তিকে বিশ্বব্যবস্থায় অবদান রাখার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। এখন আর এ বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই যে, একটি দেশের বস্তুগত ও অবস্তুগত সব ধরনের টেকসই উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার মধ্যে।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে আমাদের যতগুলো শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তি ছিল কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’-এর ভিত্তিও কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন। এই শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষার্থীদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শ এবং আমাদের সংবিধানের মূল দিকনির্দেশনার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষালাভ করে শিক্ষার্থীরা যাতে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হতে পারে এবং অধিকারের নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলোতে নিয়োজিত হয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে তার যোগ্যতা ও পরিবেশ তৈরি করে দেয়া শিক্ষকদের দায়িত্ব। এসব যোগ্যতা অর্জন করে শিক্ষার্থীরা যেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তার নির্দেশনা আছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ। শুধু তাই নয়, ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিক্ষার্থীদের মনে, মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা এবং তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলি, যেমন শ্রেয়বোধ, কর্তব্যবোধ, শিষ্টাচারবোধ, মানবিকতাবোধ, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সাধন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেতনা জাগ্রত করাও শিক্ষকদের দায়িত্ব।

এই দায়িত্ব পালনের জন্য একজন শিক্ষকের বিশ্বাসের জগৎটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনা বা ধারণাকে কেন্দ্র করে মানুষের বিশ্বাস গড়ে ওঠে। মানুষের ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধ তার জীবনাচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এর সঙ্গে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিও কাজ করে। জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের এই বিশ্বাস ও মূল্যবোধ পরিশীলিত ও পরিমার্জিত হয়। বিশ্বাসের সঙ্গে মূল্যবোধের সম্পর্ক আছে এবং মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে মানুষের বিশ্বাস। এই মূল্যবোধ নানা রকম হতে পারে। যেমন অর্থনৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ, সৌন্দর্যের মূল্যবোধ, বৌদ্ধিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ।

একজন শিক্ষকের জীবনে এই বিশ্বাস ও মূল্যবোধ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। কেননা, তিনি শুধু ব্যক্তিমানুষ নন- তিনি শিক্ষক এবং তার দ্বারা বছরের পর বছর অসংখ্য শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। সুতরাং একজন শিক্ষক সমাজের আর দশজন মানুষের মতো ব্যক্তিসর্বস্ব নন এবং নিজের ও পরিবার-পরিজনের উন্নয়নই তার ভাবনার একমাত্র বিষয় নয়। তিনি অনেক শিক্ষার্থীকে ভালো মানুষ, যোগ্য মানুষ ও সুনাগরিক করে তোলেন এবং জাতি গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। শুধু পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষানির্ভর কার্যক্রম একজন শিক্ষকের কর্মপরিধি নয়। তিনি জানেন যে, সব শিক্ষার্থীর শেখার সক্ষমতা রয়েছে এবং তার দায়িত্ব হলো, শেখার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি করা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথ সুগম করে দেয়া। এ প্রসঙ্গে অন্যত্র আমি লিখেছি, ‘শিক্ষক বিপুল পাণ্ডিত্যের অধিকারী। কিন্তু তিনি সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না। তিনি কিছুতেই ভালো শিক্ষক নন। তার অবশ্যই শিক্ষার লক্ষ্য (aims of education), শিক্ষার বিষয়বস্তু (subject matter of education), শিক্ষার পদ্ধতি (methods of teaching) এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি (assessment strategy) সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। তা হলে তিনি চমৎকারভাবে একটি ফলপ্রসূ শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন এবং সব শিক্ষার্থী উপকৃত হবে। অর্থাৎ তিনি একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শ্রেণি কক্ষের পরিবেশ তৈরি করবেন এবং শিক্ষার্থীদের যতনা শেখাতে চেষ্টা করবেন, তার চেয়ে বেশি শেখার কৌশলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতার জন্য প্রতিনিয়ত প্রস্তুতির কথা একেবারেই ভুলে বসে আছেন। তারা মনে করেন, শিক্ষকতার জন্য কিছুই করতে হয় না। ফলে তারা শিক্ষক ছাড়া আর সবই হন অথবা কিছুই হন না। অনেকে মাতব্বর হন, মোড়ল হন, পলিটিশিয়ান হন, ব্যবসায়ী হন, কৃষক হন, চাকরিজীবী হন কিন্তু কিছুতেই শিক্ষক হতে পারেন না এবং কোনো রকম মর্যাদার আসনও লাভ করেন না। অথচ এরা সারাক্ষণ বলে বেড়ান যে, শিক্ষকদের কোনো মর্যাদা নেই এবং শিক্ষকতা হলো একটি বাজে পেশা।’

অথচ শিক্ষক নিয়মানুবর্তী হবেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে তিনি প্রতিনিয়ত পঠন অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকবেন, নিয়মিত লেখালেখি করতে পারেন। বিশেষ করে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে হালনাগাদ রাখবেন। ক্লাসে যাওয়ার পূর্বে তিনি পাঠ-পরিকল্পনা তৈরি করবেন এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেবেন। শিক্ষার্থীদের মতামতের প্রতি গুরুত্বারোপ করবেন। শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের প্রশংসা করবেন। নম্বর প্রদানে অবশ্যই নিরপেক্ষ হবেন। প্রতিষ্ঠানের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বদা প্রশাসনকে সহায়তা করবেন। পরিমিত, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করবেন, সংক্ষেপে এই হলো একজন শিক্ষকের জীবনাচরণ। এভাবে শিক্ষক যে জীবনাচরণের মধ্যে বসবাস করবেন, সেই জীবনাচরণ শিক্ষার্থীদের কাছে এবং সমাজের কাছেও একটি মডেল হিসেবে প্রতীয়মান হবে। বিষয়টি এমন নয়, শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই তিনি অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হবেন, অধিকন্তু পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্রই তিনি একজন আদর্শ মানুষ, সম্মানিত মানুষ, বিশ্বাসযোগ্য মানুষ ও নির্দ্বিধায় গ্রহণযোগ্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদ, চলন-বলন-আচরণ, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তার ব্যববহার যৌক্তিক, পরিমিত, ন্যায়ানুগ হওয়া দরকার। আর দশজন মানুষ থেকে তিনি যে আলাদা, সেটা তার এই জীবনাচরণ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে। তিনি কোনো ভুল করবেন না কিংবা তার কোনো দোষত্রুটি থাকবে না, নিশ্চয়ই তা নয়। মানুষ হিসেবে কিছু মানবীয় দোষ-ত্রুটি, বংশানুক্রমিক কিছু সীমাবদ্ধতা মানুষমাত্রই থাকে। কিন্তু একজন শিক্ষককে পরিশীলিত জীবনযাপনের মাধ্যমে সমাজের কাছে শ্রদ্ধেয় ও সমীহ করার মতো ব্যক্তিত্ব অর্জন করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, শিক্ষক-ব্যক্তিত্বের এই আর্কেটাইপ একটি আলাদা ডিসকোর্স বা প্রতর্কের বিষয় হতে পারে। এবং এই প্রতর্কের সঙ্গ-অনুষঙ্গগুলো নিয়ে, মাত্রা-মাত্রান্তরগুলো নিয়ে এবং রীতি-পদ্ধতিগুলো নিয়ে যদি অনেক কথা হয়, লেখা হয়, অনেকান্ত আলোচনার উদ্বোধন হয়, তা হলে শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সংবেদনা তৈরি হতে পারে।

শিক্ষকসংক্রান্ত এই যে প্রতিমা, এর প্রায় সবটুকুই শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে রচিত। পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে, এমনকি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিন দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে গর্বে বুক উঁচু হয়ে উঠবে যে, কী অসাধারণ যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকরা এই প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেছিলেন। তাদের শিক্ষার্থী-অন্তপ্রাণই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজসহ পৃথিবীর যেকোনো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য করে তুলেছিল। শিক্ষার্থীদের কী করে নিরন্তর জ্ঞানচর্চার মধ্যে রাখা যায়, কী করে তাদের প্রতিটি সন্ধ্যা বিতর্কের মধ্যে, নাট্যাভিনয়ের মধ্যে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে, লেখালেখি ও খেলাধুলার মধ্যে রেখে সবদিক থেকে যোগ্য মানুষ হিসেবে, সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, এই চেষ্টায় শিক্ষকদের প্রতিটি দিন অতিবাহিত হতো। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় এক শ বছর আমরা শিক্ষকদের এই সর্বান্তকরণ নিবেদন দেখেছি এবং এ-ও দেখেছি যে, শততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে তারা কতটা নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। একবিংশ শতকের এই প্রথমার্ধে এসে আবারও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষকদের দিকে। সবদিক থেকে তাদের সম্মানিত অবস্থানে উত্তরণ ঘটিয়ে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। আর তার জন্য প্রয়োজন পাঠদান পদ্ধতিতে নতুন নতুন গবেষণা। সে ক্ষেত্রে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হলেই- জাতি গঠনে বিপুলসংখ্যক প্রত্যাশিত শিক্ষার্থীর আবির্ভাব ঘটবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়