প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
‘তুই অ পুত চোগর মাথা’ন খাবি। আঁধা হই যাবিগোই, এন করি কম প’রৎ পড়ি পড়ি!’ [তুই তো পুত চোখের মাথাটা খাবি! অন্ধ হয়ে যাবি, এতো কম আলোয় পড়ে পড়ে!]
সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসার পরও বাইরে বাগানে বা উঠোনে আমাকে বইয়ে মুখ গুঁজে রাখতে দেখে আমার মা প্রায়ই এভাবে বকাবকি করতেন। এখন বই পড়াপড়ির কথা ভাবতে গেলেই মায়ের এ কথাটা মনে পড়ে।
মা’র কথাটা একদিকে মোটেও ঠিক হয়নি। কারণ আমার চর্মচক্ষু দুটো এখনও ঠিক আছে, যদিও চল্লিশ পেরুনোর পর চালশের চশমা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু আরেকদিক দিয়ে মায়ের কথা ঠিক হয়েছে। অতিরিক্ত পড়ে পড়ে জীবনের এক পর্যায়ে আমার অন্তর্চক্ষু হারিয়ে ফেলেছিলাম। সৎ-অসৎ, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, চিরায়ত মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। নেতিকে ইতি, ইতিকে নেতি ভাবতে শুরু করেছিলাম। এক ধরনের আত্মঘাতী, মরবিড দর্শনকে যাপিত জীবনের সারাৎসার করে নিয়েছিলাম।
খেয়াল করে দেখলাম, আমার মনোজগতের এই পালাবদলের সঙ্গে আমার পাঠাভ্যাসের ধরন-ধারণ জড়িত। আমাদের পারিবারিক পাঠাগারের গ্রন্থাবলি সীমিত ছিলো আদিযুগ থেকে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বলয়ভুক্ত বা তাঁর সমসময়ে সমধর্মী সাহিত্য চর্চারতদের লেখা বইপত্রের মধ্যে। কৃত্তিবাসী রামাছু, কাশীরাম দাসের মহাভারত, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, চ-ীদাস প্রমুখের মহাজন পদাবলী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর যুগের ও সমধারার কবি-সাহিত্যিকদের প্রায় সবার সম্পূর্ণ রচনাবলী বা সিংহভাগ গ্রন্থ আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে ছিলো।
এখানে বসেই আমি আমার বালক বয়সে ভারতের দুই আদি মহাকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, এবং বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, কাজী নজরুল, মীর মোশাররফ হোসেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখের রচনাবলী পাঠ করেছি। পড়েছি জওয়াহরলাল নেহরুর ‘গ্লিম্পস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’র অনুবাদ ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’ এবং ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র অনুবাদ ‘ভারত সন্ধানে’, পুষ্পময়ী বসুর করা পার্ল এস. বাক-এর ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘গুড আর্থ’-এর সেই সুখপাঠ্য অনুবাদ, জন স্টেইনবেকের ‘মুন ইজ ডাউন’-এর অনুবাদ ‘অস্তগামী চাঁদ’, এরিখ মারিয়া রিমার্ক-এর ‘অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর অনুবাদ ‘পশ্চিম রণাঙ্গন শান্ত’, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি’র ‘হাউ দা স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড’-এর অনুবাদ ‘ইস্পাত’ প্রভৃতি। কান্তি ঘোষের করা ওমর খৈয়ামের অনুবাদের রাজসংস্করণও এ পাঠাগারে পেয়েছিলাম, মনে আছে। এখানেই পরিচিত হয়েছি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কামিনী রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন থেকে শুরু করে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নীহার রঞ্জন গুপ্ত প্রমুখের লেখার সঙ্গেও। শেষোক্তরা আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে ঢুকে পড়েছিলেন আমার বাবা-মার বিয়েতে বিভিন্ন জনের উপহার হিসেবে। তখনকার দিনে, মানে বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাঙালি ভদ্রলোকের বিয়েতে বই উপহার দেয়ার বহুল প্রচলন ছিল বলে জেনেছি।
তবে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ এবং তাদের পরবর্তী সময়ের কবি-লেখকদের বই আমাদের পাঠাগারে তখন পাইনি।
সেইসঙ্গে ছিলো পুরোনো দিনের বিচিত্রা, বসুমতী, ভারতবর্ষ, প্রবর্তক, প্রবাসী প্রভৃতি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকার বাঁধাই করা কপি। প্রথম যুগের সাপ্তাহিক (বর্তমানে পাক্ষিক) দেশ পত্রিকার অনেকগুলো কপিও ছিলো। তখনও সেখানে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে কলকাতার দৈনন্দিন জীবনের খণ্ডচিত্রাবলীর হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনমূলক কলাম শ্রীবিরুপাক্ষ (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র)-এর ‘ট্রামে-বাসে’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ধারাবাহিক রম্যনিবন্ধগ্রন্থ ‘পঞ্চতন্ত্র’, প্রবোধকুমার সান্যাল, তারাশঙ্কর, গজেন্দ্রকুমার মিত্র প্রমুখের অসাধারণ সব উপন্যাসের ধারাবাহিক কিস্তি। আর ছিলো ছোটদের পত্রিকা পাঠশালা, জয়ন্তী মৌচাক, সন্দেশ প্রভৃতিও। কত যে অমূল্য, অসামান্য সুন্দর লেখা এসব পত্রপত্রিকায় পাঠ করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। এসব অবিরল পাঠের মধ্যে দিয়ে সারাক্ষু যে একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ লাইব্রেরিতেই পেয়েছিলাম চাণক্য কৌটিল্যের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’-এর একটি চমৎকার বঙ্গানুবাদ। অনুবাদকের নাম স্মরণে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে, তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে মূল গ্রন্থের দুর্গনির্মাণ, রণসজ্জা, সৈন্যসমাবেশ ইত্যাদি বিষয়ক অধ্যায়গুলোর অনুবাদ যে এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি, সেটা তিনি শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।
পারিবারিক এই পাঠাগারে পেয়েছিলাম ‘রেকর্ড সঙ্গীত’ নামে পাঁচশতাধিক পাতার একটা বই। সে আমলের হিজ মাস্টারস ভয়েস, হিন্দুস্তান রেকর্ডস, মেগাফোন প্রভৃতি রেকর্ড কোম্পানি প্রকাশিত তৎকালীন অসংখ্য কণ্ঠশিল্পীর অসংখ্য গানের বাণী। কে. সি. দে ওরফে ‘অন্ধ গায়ক’ পরিচয়খ্যাত কৃষ্ণচন্দ্র দে, কুন্দনলাল সায়গল, কে. মল্লিক ওরফে কাশেম মল্লিক, আঙুরবালা, বেদানাসুন্দরী, মানদাসুন্দরী, শ্যামাসুন্দরী দাসী, কাননবালা প্রমুখের নাম এবং তাঁদের জনপ্রিয় সব গানের কথা আমি প্রথম এ বইয়েই পাই। গানের সঙ্গে শিল্পীদের পাতাজোড়া অনেক দুর্লভ আলোকচিত্রও এ বইয়ে ছিলো। তাছাড়াও ছিলো সে আমলে রেকর্ডকৃত অসংখ্য কৌতূক নকশা, চন্দ্রগুপ্ত, শাজাহান, জনা, মেবার পতন প্রভৃতি নাটকের অংশবিশেষ ইত্যাদিও। প্রতিটি গান বা অন্যান্য আইটেমের কথার সঙ্গে রেকর্ডটির নম্বর এবং রেকর্ড কোম্পানির নামোল্লেখও ছিলো।
নাটক প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো, গিরীশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের অনেক নাটকও ছিলো এ পাঠাগারে। তবে সবচেয়ে বেশি ছিলো মন্মথ রায়ের লেখা নাটকের বই। প্রসঙ্গত, আমাদের সুদূর শৈশবে এসব নাটক পাঠাগারের আলমারির তাকে বই হিসেবে চুপচাপ বসে থাকতো না, সরব মুখর হয়ে নিয়মিত মঞ্চে আবির্ভূত হত কুশীলবদের অভিনয়সমৃদ্ধ হয়ে।
রবীন্দ্রনাথের একেবারে শুরুর দিককার কিছু রেকর্ড করা গানের কথাও এ বইয়ে ছিলো। গানগুলোকে অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে গ্রন্থিত না করে, শুধু গানের বাণীর শেষে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামোল্লেখ করা হয়েছে। দীনেন্দ্রনাথ ওরফে দীনু ঠাকুর, অমিয়া ঠাকুর, কাননবালা, কে. এল. সায়গল প্রমুখের গাওয়া আদিযুগের কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঠ বইটায় পেয়েছিলাম, মনে আছে।
এ পাঠাগারে আমি ছিলাম একটা পোকাবিশেষ, সাধুভাষায় যাকে বলে গ্রন্থকীট। আমার পড়াশোনা যতোদিন এ পাঠাগারে সীমাবদ্ধ ছিলো, ততোদিন আমার জীবনে কোনো তালভঙ্গ বা ছন্দপতন ঘটেনি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন নিজে বইপত্র কিনতে বা সংগ্রহ করতে শুরু করলাম, তখন ধীরে ঘরে তথা মাথায় ঢুকতে শুরু করলো ১৯৩০-এর দশকের তথা কল্লোল যুগের সাহিত্য, ডানপন্থী মরবিড আর বামপন্থী বিপ্লববাদী সাহিত্য, বদল্যেরের ‘ফ্লর দ্য মাল’ বা ‘ক্লেদজ কুসুম’, সার্ত্রে-কামু’র অস্তিত্ববাদী সাহিত্য ইত্যাদি, তখনই আমার মাথার মধ্যে ওলট-পালট শুরু হলো, আর তার অনপনেয় ছাপ পড়লো জীবন্যাপনে, জীবনধারণেও, যার জের এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি এবং বাকি আছুষ্কালে পারবো বলেও মনে হয় না।
কথাগুলো অবশ্যই আরো বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে, যা আগামীতে করার ইচ্ছে রাখি। তবে আমাদের পারিবারিক পাঠাগার আমার মেধা-মনন, জীবনদর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে কতটুকু গভীর নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। আজকে আমি যা হয়েছি, যতোটুকু হয়েছি, তার অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ এ পাঠাগারেরই দান বলে আমি মনে করি।
আমাদের বাড়ির সে পাঠাগারের অস্তিত্ব আজ আর নেই। নানা প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে সে পাঠাগারেরও বিলুপ্তি ঘটেছে অনেক আগেই। কিন্তু আমার মেধা-মননে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের রেশ এখনও কান পাতলে শোনা যায়।