বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩, ০০:০০

মাতৃপীঠের মেয়েবেলা
অনলাইন ডেস্ক

ঘড়িতে এখন সকাল সাতটা। জানালার গ্লাস শীতের কুয়াশায় ঢাকা। কম্বলের নিচে শুয়ে শুয়ে ভাবছি গতকাল বাসায় ফিরে ব্যাডমিন্টন ব্যাটটা কোথায় রেখেছি! টিফিন টাইমে আর যা-ই হোক খেলা মিস করা যাবে না। চোখ মুছতে মুছতে উঠে পড়লাম। তাড়াহুড়ো করে স্কুলড্রেস খুঁজছি। দেখি আলমারির কোথাও নীল-সাদা চিরপরিচিত ড্রেসটি নেই। বিরক্ত হয়ে ব্যাডমিন্টন ব্যাটটা খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো হ্যাঙ্গারে অ্যাপ্রোন ঝুলছে , টেবিলে মোটা কতেক বই। মুহূর্তেই যেন আমার বর্ণিল ভাবনাগুলো সোনালি শৈশবে মিশে গেলো। বাস্তবতার হাতছানিতে বুঝতে পারলাম, স্কুলে যাবার দিন তো গত হয়েছে সেই কবেই। বন্ধুরা কেউ স্কুলে নেই; কেউ অপেক্ষা করছে না খেলার মাঠে। স্কুল ড্রেসের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে আমার সেই সুদিনগুলোও। দুঃখমনে নাস্তার প্লেট হাতে মনে পড়ে গেলো স্কুলের টিফিনের কথা। সবাই সমুচা-সিঙ্গারাও কী অমৃত মনে করে খেতো। গ্রীষ্মকালে সবাইকে লাইন করে আম দেয়া হতো। যদিও নলকূপের পাশের আমগাছে উঠে আম পেড়ে খেতো অনেকেই, কিন্তু ধরা পড়ার ঝুঁকি ছিলো। অবশ্য তেমন মুহূর্ত এলে এক দৌড়ে গায়েবও হওয়া যেতো।

স্কুলে বিশেষ দিনে দেয়া হতো ঢাকা কনফেকশনারির বার্গার। সবাইকে গেইট লক করে জড়ো করা হতো সিঁড়িতে। এতো ভিড়ে দম নেয়ার উপায় নেই। কিন্তু ধাক্কাধাক্কির মাঝেও বার্গার সবার চাই। এসব মনে পড়তেই টেবিলে বসে নিজে নিজে হাসতে লাগলাম। আমার এখনো মনে পড়ে, মাতৃপীঠে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী ফিরেছি; অপেক্ষা করছি ফলাফলের জন্য। রাতে জানতে পারলাম ওর হয়নি। খারাপ লাগা আর ভয়ের এক মিশ্র অনুভূতি নিয়েই শুরু হলো মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার প্রথম দিন। গেইট দিয়ে ঢুকেই মাঠজুড়ে পেলাম আমার মতো আরো অনেককে। জানতে পারলাম আমাদের ক্লাস হবে তিনতলায়। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ ছিলো শ্রেষ্ঠ সময়ের দিকে একেকটা পদক্ষেপ। অচেনা নতুন মুখগুলো যে একদিন এতোটা আপন হয়ে উঠবে তা তখনও বুঝিনি।

ছোটবেলার অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত কিংবা আজ পর্যন্ত সুখণ্ডদুঃখের দিনগুলোতেই পাশে পেয়েছি আমার স্কুলের বন্ধুদের। আমার মনে হয়, বয়সের সাথে সাথে আমাদের জীবনের হিসাবনিকাশ বেড়ে যায়। তখন প্রকৃত বন্ধু পাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে। তাই বোধহয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্কুলের বন্ধুদের ব্যাপ্তি থাকে সারাজীবন। হৃদয়ে তাদের জন্য অন্যরকম মায়া জন্ম নেয়।

স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আগে একরকম উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হতো। বড়দের দায়িত্ব দেয়া হতো ভলান্টিয়ারিং-এর, সে যেন এক আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। প্রতিযোগীদের সমর্থনে করতালিতে মুখর হয়ে উঠতো বিদ্যালয়ের পরিবেশ। দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ পড়ে যাক বা না যাক গ্রীষ্মের তপ্ত রোদের অ্যাসেম্বলিতে কেউ না কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যেতোই! স্কুলে শিক্ষকরা যেমন স্নেহ করতেন, অন্যায়ে শাসনও থাকতো কঠোর। খালেদা ম্যামের একটা বেত ছিলো। বেত বের হয়েছে জানতে পারলেই জানালায় উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে যেতো কে মার খাচ্ছে দেখার জন্য। কিন্তু ম্যাম চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন শূন্যতা জেঁকে বসেছিলো ঐ চেয়ারটায়। ম্যামকে খুব ভয় পেতাম। তবে আজও ম্যামের সাথে যেখানেই দেখা হয় ম্যাম জড়িয়ে ধরেন। তাঁর স্নেহ মনের মধ্যে এটা এক অন্যরকম ভালোলাগা সৃষ্টি করে।

স্কুলে সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমের অনেক সুযোগ ছিলো। শিক্ষকদের উৎসাহে আমাকে প্রথমবার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পাঠানো হলো। তারপর চাঁদপুরের গণ্ডি পেরিয়ে কুমিল্লা, সিলেটসহ কতদিকে জয়যাত্রা, সর্বশেষ বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। জাতীয় টেলিভিশনের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উচ্চারিত হয়েছিল আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠের নাম। এখনও প্রধান শিক্ষকের কক্ষে পুরস্কারগুলো যত্ন করে সাজানো আছে। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এর চেয়ে গৌরবের আর কি হতে পারে। সেবার ঢাকা থেকে ফেরার পর স্কুল থেকে আমাদের সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করা হয়েছিল। এই অনুভূতি প্রকাশ করা বর্ণনাতীত। সময়ের রঙ থাকে। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। নীল-সাদার মুক্ত ভুবনের দুরন্ত সময় পার হয়ে এলো বিষাদের নীল রঙ। মিলাদের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যেনো জানিয়ে দিলো-স্কুলের পথচলায় ইতি এখানেই। এরপর আরেক যুদ্ধ। ভেজাচোখে সেদিন স্কুলের গেইট থেকে বের হয়েছি, সাথে ফেলে এসেছি কত-কি! কতজনের সাথে ঐদিন-ই শেষ কথা হয়েছিল। এসএসসির ফলাফলের পর কোথায় কে চলে গেলো, আর দেখাও হয়নি।

সত্যিই জীবনযুদ্ধে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ক্লাস ফোরে পড়া মেয়েটা কি জানে, বছরখানেক পর স্কুলে ফেরার কী তীব্র কাতরতা সে অনুভব করবে? কংক্রিটের এই জীবনে মনেহয় শান্তির নিশ্বাস নেবার উপায় নেই। আমি চাইলেই যদি পাখি হয়ে এক নিমিষে উড়ে স্কুলে যেতে পারতাম, কিংবা প্রজাপতি হয়ে স্কুলের কৃষ্ণচূড়া ফুলে ঘুরতাম আর উচ্ছ্বসিত মুখগুলো দেখতে পারতাম! কিন্তু চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়? শৈশবে ফেরা যায়?

ফাতেমা বিনতে নূর : ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস), পঞ্চম বর্ষ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ, ঢাকা। প্রাক্তন শিক্ষার্থী (এসএসসি : ২০১৫ ব্যাচ), মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর।

* শিক্ষাঙ্গনে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়