প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩, ০০:০০
আর দশটি প্রাণীর মতো মানুষও জীবতত্ত্বীয় দিক থেকে প্রাণী বৈ কিছু নয়। এই সীমার মধ্যে যদি মানুষের বিস্তার রহিত থাকত তাহলে বলার কিছুই ছিল না। মানুষ ছাড়া প্রাণিজগতের অন্য সদস্যদের নিয়ে যেমন কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু মানুষ তার জৈব গড়নের বিশেষ কোনো তাৎপর্যের জন্য জন্মাবধি চিন্তা ও কর্মে এবং কল্পনাপ্রতিভায় বিকশিত হওয়ার সামর্থ্য রাখে। মানুষ বাবুই পাখি নয়, সহজাত এক নির্মাণ-কৌশলের চিরকালীন পুনরাবৃত্তি মানুষের স্বভাব নয়। প্রতিনিয়ত মানুষ নতুন ভাবনা ও নতুন কর্মে আত্মনিয়োগ করে। ব্যক্তিজীবনের বিচিত্র রহস্য থেকে শুরু করে বিশ্বজগতের রহস্য উন্মোচনের ভেতর দিয়ে সে জীবন ভাঙে, জীবন গড়ে; জগৎ ভাঙে, জগৎ গড়ে। সুতরাং মানুষ নামক প্রজাপতি এযাবৎ আবিষ্কৃত বিশ্বব্রহ্মা-ের মধ্যে একমাত্র সদস্য, যে অফুরন্ত সৃষ্টিশীলতার অধিকারী।
কিন্তু এই সৃষ্টিশীল মানুষ, অপরিসীম কর্মকৌশলী মানুষ শুধু জন্মগত তাৎপর্যেই গড়ে ওঠে না। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। বাবুই পাখির বাসা বোনার কৌশল শিখতে হয় না। এ তার সহজাত এক জীববৃত্তি। কিন্তু মানুষকে প্রতিনিয়তই শিখতে হয়, এক নিরন্তর শিখন-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হয় তাকে। আর এই শিখন-কৌশলের প্রাতিষ্ঠানিক আশ্রয় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়। চিরকাল হয়তো স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। কিন্তু শিক্ষার জন্য কোনো না কোনো অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল। এসবের ভেতর দিয়ে মানুষ জীবনযাপন ও জীবনাচরণের মানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, মানবীয় সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে এবং সেই সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ক্রমিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং মানুষের জন্য শিক্ষা লাভ অপরিহার্য এবং অবশ্যই মৌলিক অধিকার। কোনো শিশুকেই এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, এই হলো আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার অঙ্গীকার।
শিক্ষার মতো শিক্ষা নিয়ে ভাবনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। দেশ ও কালের পটভূমিতে সেই ভাবনা বিচিত্র। কারণ প্রতিটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যেমন এক নয়, তেমনি সময়ের বিবর্তনে একই দেশের মধ্যে কত রকম পরিবর্তন যে সাধিত হয় তার ইয়ত্তা থাকে না। তাই শিক্ষা নিয়ে ভাবনার কোনো অন্ত নেই এবং একই কারণে শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করাও দুরূহ।
আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য আমরা বুঝি। আমরা এও বুঝি যে, জীবনের খুব কম কাজই অন্ধকারে করা যায়; কিন্তু প্রায় সব কাজই আলোতে করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত ‘শিক্ষার বাহন’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দিনের আলোককে আমরা কাজের প্রয়োজনের চেয়ে আরও বড়ো করিয়া দেখিতে পারি, যখন দেখি জাগার প্রয়োজন। এবং তার চেয়ে আরও বড়ো কথা, এই আলোতে মানুষ মেলে, অন্ধকারে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়।’ সুতরাং শিক্ষার যদি একটি চিরকালীন ও সর্বজনীন অভিধা নির্ধারণ করতে হয়, তা হলে বলা যেতে পারে যে, অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তন হলো শিক্ষা। শিক্ষার এই অভিধা বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং পরিমাপযোগ্যও নয়, এটি ধারণাগত সংজ্ঞা। কেননা, অন্ধকারের মতো অশিক্ষা মানুষকে যদি বিচ্ছিন্ন করে, অজ্ঞতা মানুষকে যদি অচেতন করে, তা হলে আলোর মতো শিক্ষা মানুষকে জাগিয়ে তোলে, তার মধ্যে চেতনার সঞ্চার ঘটায় এবং তাকে ঐক্যের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। সেই ঐক্যে স্থান ও কালের দূরত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ হলো মোটা দাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনা।
বহুকাল পূর্ব থেকে কত পণ্ডিতরা যে শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন এবং শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন তার হিসাব-নিকাশ নেই। এই সংজ্ঞায়নের দুটি রূপ আছে। শিক্ষাবিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করছেন, ভাবছেন এবং নানা রকম তত্ত্ব ও তথ্যের সন্নিবেশ ঘটাচ্ছেন। এটি হচ্ছে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিত। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিত শিক্ষাকে একটি সাধারণ প্রপঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং এই দিকটি হলো শিক্ষার দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক দিক। শিক্ষার এই দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক দিকটি নানাভাবে পরিপুষ্টি লাভ করেছে।
শিক্ষা নিয়ে যারা ভেবেছেন তাদের মধ্যে কোনো কোনো পণ্ডিত শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে সমার্থক করে দেখেছেন, বলেছেন জীবন প্রক্রিয়া এবং শিক্ষা প্রক্রিয়া একই ধারায় বহমান অর্থাৎ শিক্ষার ধারা মানুষের জীবনব্যাপী অব্যাহত গতিতে বয়ে চলে। জীবনপথে চলতে গিয়ে মানুষ যা কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাই তাকে শিখতে সাহায্য করে। কেউ কেউ বলেছেন যে, শিক্ষাই জীবন। শিক্ষা জীবনের জন্য প্রস্তুতি নয়। অর্থাৎ শিক্ষা ও জীবনকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয়নি। এই পণ্ডিতদের অনেকেই মনে করতেন, শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা সতত প্রবহমান। অতএব বাঞ্ছিত পথে শিশুর শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক আচরণের শুভ পরিবর্তনকে শিক্ষা বলে অভিহিত করেছেন তারা। এরিস্টটল খুব সংক্ষেপে শিক্ষার একটি চিরকালীন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার মতে, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।’ দেহ-মনের সুস্থতার এই ধারণা কালে কালে এবং দেশে দেশে বদলায়। পরিবর্তনের ওই পটভূমি বিবেচনায় রেখে যদি এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়, তা হলে দেখা যাবে, শিক্ষার সব উপাদানই এর মধ্যে নিহিত আছে। একই কথা বলেছেন মহাত্মা গান্ধী। তার মতে, ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার সুষম বিকাশের প্রয়াস হলো শিক্ষা। তিনি এরিস্টটলের দেহ ও মনের সঙ্গে আত্মার কথা বলেছেন।
অন্যদিকে সুইস শিক্ষাবিদ জোহান হেনরিক পেস্তালৎসি মনে করেন, শিক্ষা হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোর স্বাভাবিক, সুষম ও প্রগতিশীল বিকাশ। দার্শনিক ইকবালও আত্মশক্তির জাগরণকেই শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই, যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’ তথ্যভারাক্রান্ত শিক্ষাকে তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছেন, এর মধ্যে সত্য থাকতে হবে, যে সত্য শুধু উপকরণে সমৃদ্ধ নয়, সুন্দরেও সমৃদ্ধ। আগুন জ্বালাতে কাঠ লাগে। তার মানে কাঠ আগুন নয়। ব্যক্তিকে আশ্রয় করে শিক্ষা। সুতরাং ব্যক্তি কাঠের মতোই ইন্ধন মাত্র। যখন ব্যক্তির ভেতর থেকে তাপ ও আলোর নিঃসরণ ঘটে, তখনই সে সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ। ‘আমাদের শিক্ষা ও বর্তমান জীবন-সমস্যা’ নামক একটি প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘মানুষ ধাতু নয়, কিন্তু দেহমনে একটি ঙৎমধহরংস, এবং এই ঙৎমধহরংস-এর স্ফূর্তির সহায়তা করাই শিক্ষার একমাত্র কাজ, এক কথায় শিক্ষার ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের উন্নতি সাধনের দ্বারা জাতীয় জীবনের উন্নতি সাধন।’
আমরা বিজ্ঞজনের কাছ থেকে শিক্ষার মূলগত কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এখন দেখব আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমে কী বলা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্ব দানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।’
অন্যদিকে ২০২২ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম উন্নয়নের পটভূমিতে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য জীবনকে নান্দনিক, আনন্দময় ও অর্থবহ করে তোলা এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীকে জীবিকা অর্জনের উপযোগী যোগ্য, সৃষ্টিশীল ও মানবিক মানুষের পরিণত করা। একই সঙ্গে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।’
এই পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলোকে বিবেচনায় রেখে শিক্ষার ভেতর দিয়ে জ্ঞানে, দক্ষতায়, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে ও দূরদর্শিতায় এবং সংবেদনশীল, অভিযোজন সক্ষম, মানবিক ও যোগ্য বিশ্ব নাগরিক গড়ে তোলার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
এই সময়ে আমাদের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে শিক্ষার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার বাইরে তেমন কিছু নেই বলেই মনে হয়। বিশেষ করে কাগজপত্রে যেভাবে লেখা হয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক দিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনেক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, অনেক সভা-সমাবেশ এবং প্রচুর ওয়ার্কশপের ভেতর দিয়ে শিক্ষার ওই সব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ধাপ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সামগ্রিক বিষয়টি হচ্ছে আয়োজন। এখন তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশন করবেন সম্মানিত শিক্ষকরা। এই পরিবেশনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে শিক্ষকরা আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবেন, এই প্রত্যাশা।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
* শিক্ষাঙ্গনে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]