প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
মূল্যায়ন শিখন শেখানো কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও বিষয়। আমরা যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করে এসেছি, সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিলো। তাই নতুন কারিকুলামে এখানে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এটি নিয়ে বিপাকে প্রায় সবাই। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমণ্ডদুটোই থাকছে।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ‘শিখনকালীন’ এবং বাকি ৪০ শতাংশ হবে পরীক্ষার ভিত্তিতে। নবমণ্ডদশম শ্রেণিতে এটি ৫০ শতাংশ, ৫০ শতাংশ আর উচ্চ মাধ্যমিকে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রমের ভিত্তিতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয়ের পুরোটাই শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। এখানেই বেধেছে বিপত্তি। একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছে, ঠিকমতো বই পৌঁছায়নি সব শিশুদের কাছে, ইতোমধ্যে দুটো বই তুলে নেয়া হয়েছে।
যেসব বই শিশুদের কাছে এসেছে সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ছে-সবকিছু নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিড়ম্বনায় পড়েছে। আমি দেখছি, শিক্ষার্থীদের চেয়ে শিক্ষকরা বেশি বিপাকে পড়েছেন। কারণ, তাদের বলা হয়েছে ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন এবং বাকি ৪০ শতাংশ পরীক্ষার ভিত্তিতে অর্থাৎ সামষ্টিক মূল্যায়ন। এখন এই ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন কীভাবে হবে সেটি কারোর কাছেই স্পষ্ট নয়। অনেক শিক্ষক কথা বলছেন, ফোন দিচ্ছেন, মেইল দিচ্ছেন বিষয়টি আরও খোলাসা করার জন্য। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছি, আপনারা প্রশিক্ষণে এর উত্তর পাননি। উত্তরে সবাই যেটি বলেছেন, তার সারমর্ম হচ্ছে ‘বারবার জিজ্ঞেস করা স্বত্ত্বেও প্রশিক্ষকরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টি সম্পর্কে তাদেরও স্বচ্ছ ধারণা নেই।’ আসলেও তাই। কোনো বিষয়ের বইয়ে কোনো ধরনের মডেল প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়নি। সম্ভবত শিক্ষার্থীদের অধিকমাত্রায় সৃজনশীল করার জন্যই এই প্রচেষ্টা।
কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আইইএলটিএসের মতো আন্তর্জাতিক পরীক্ষায়ও খুব সুন্দরভাবে সিলেবাস, মডেল প্রশ্ন দেয়া থাকে। পরীক্ষার চারটি অংশের কোনো অংশে কত সময়, কয়টি প্রশ্ন থাকবে, ঐ ধরনের প্রশ্নের উদ্দেশ্য কী অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কী টেস্ট করা হচ্ছে সবকিছুই সুন্দরভাবে উল্লেখ করা থাকে। আর আমাদের কি হলো, আমরা হঠাৎ করে এত সৃজনশীল বানানোর চেষ্টা কেনো করছি, এতে তো দেখছি ‘আম’ ও ‘আমের ছালা’ সবই যাচ্ছে। শিক্ষকরা বিভ্রান্তিতে, অভিভাবকরা বিভ্রান্তিতে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসছেন না বহু জায়গায়, আসলেও কিছু করতে চাচ্ছেন না। এই অবস্থা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে!
শিখনকালীন কোনো লেসনে বা চ্যাপ্টারে কীভাবে নিতে হবে, প্রতি সপ্তাহে না মাসে নিতে হবে , যেহেতু নম্বর দেয়ার পদ্ধতি নেই, তাহলে সেগুলোর গড় কী ভাবে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনও ঘোলাটে। তারপর সে ফলগুলো মূল ফলকে, মূল মূল্যায়নে কিভাবে সংযুক্ত হবে এবং সার্বিক মূল্যায়নে সেটি কী ভাবে মূল্যায়িত হবে সে সব বিষয় পুরোপুরি অনুপস্থিত। কাজেই শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকরাও বিপাকে। প্রশিক্ষণে এ ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি। কেউ কেউ করতে চেয়েছেন, প্রশিক্ষকরা এড়িয়ে গেছেন। বিষয়টি প্রশিক্ষকদের কাছেও স্পষ্ট নয়। যে অ্যাপসের মাধ্যমে এটি করার কথা, সেই অ্যাপসের খবর নেই।কবে হবে..তারও কোনো দিক নির্দেশনা নেই। শিক্ষকদের মধ্য থেকেই বিষয়টি নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা ও প্রশ্ন আসার কথা ছিলো, সেভাবে কিন্তু আসেনি বা আসছেনা। শুধুমাত্র আগ্রহী ও সিরিয়াস কিছু টিচার বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন। আমাদের পূর্ববর্তী মূল্যায়ন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের দায়িত্বই শতভাগ-যা প্রাইভেট কোচিং, শিক্ষার্থীদের মুখস্থ-নির্ভরতা, শিক্ষকদের নোট প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলোকে প্রভাবিত করতো।
দীর্ঘদিন ধরে এটা ছিলো আমাদের শতভাগ মূল্যায়নের ধরণ। এখন যে প্রক্রিয়াটি আসছে, সেখানে শিক্ষার্থীর স্বমূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে। সে হাতে কলমে একটা কাজ করে এসে তারপর ছকটা পূরণ করে ওই জায়গাগুলোতে তার যে পর্যবেক্ষণগুলো সে দেখেছে বা শুনেছে বা হাতে কলমে করেছে..তার এভিডেন্সগুলোর রেফারেন্স লিখতে হবে। দ্বিতীয়ত, সহপাঠী মূল্যায়ণ গ্রুপ, একটা গ্রুপ আরেকটা গ্রুপকে মূল্যায়ন করবে। আবার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে অভিভাবক বা অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে তার যে ইন্টারঅ্যাকশন হচ্ছে তারাও এখানে বিভিন্ন উপায়ে অংশগ্রহণ করবেন। এগুলোর এভিডেন্সগুলো থাকছে, এসবের ভিত্তিতে শিক্ষককে একটি কালেক্টিভ রেজাল্ট তৈরি করতে হবে। আগে যে মূল্যায়ন পদ্ধতি ছিলো সেখানে ক্রসচেকের কোনই উপায় ছিলো না, বর্তমানে তা থাকার কথা। স্কুল বেজড অ্যাসেসমেন্ট ছিলো লিখিত পরীক্ষানির্ভর ৮০ ভাগ, আর ২০ ভাগ ছিলো ধারাবাহিক শিখনকালীন মূল্যায়ন।
প্রায়োগিক দিকের যে প্লানিং ছিলো, সেখানে বড় গ্যাপ। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকই একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। যার ফলে, শিক্ষক সেটিকে সঠিকভাবে করতে পারেননি অনেক ক্ষেত্রেই। বর্তমানের মূল্যায়নটা আলাদা কারণ অভিজ্ঞতা চক্রের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা শিখবেন, যেখানে শিক্ষার্থীর স্বমূল্যায়নের জায়গা আছে, তাকে নানা রকম কাজ করতে হবে। বর্তমান মূল্যায়ন ব্যবস্থায় এসব বিষয়ের উল্লেখ আছে, কিন্তু শিক্ষকরা এগুলোর সঙ্গে এখনও পরিচিত নন, আত্মবিশ্বাসী হওয়া তো দূরের কথা।
সৃজনশীল প্রশ্ন মানুষের শিখনকে লিখিত উপায়ে প্রকাশের একটা বিকল্প মাধ্যম, যেটা মানুষের ক্রিটিক্যাল থিংকিংকে উন্নত করার জন্য করা হয়েছিলো। কিন্তু মানুষ তো তার শিখনকে শুধু লিখে প্রকাশ করেনা। এখানে একটি গ্যাপ রয়েছে। লিখে প্রকাশ করা বিষয়টিকে ঠিক রেখে নানা রকম বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। যে কোনো মূল্যায়নে লেখাটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে দেখা হয়। কারণ, লেখার অর্থ হচ্ছে, প্রার্থীর অন্তর্নিহিত ধারণা, চিন্তাধারা, মতামত, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কল্পনা, পরিকল্পনা, স্বপ্ন, উদ্দেশ্য বিস্তারিতভাবে তার লেখায় ফুটে উঠে যদিও লেখার দ্বারা তার উপস্থাপন দক্ষতা কিংবা সহমর্মিতা বা গণতান্ত্রিক ধারণার বাস্তব প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। লেখার মাধ্যমে নান্দনিক দিকগুলোও ফুটে উঠে। তাই যুগ যুগ ধরে লেখাটাই একজন প্রার্থীর গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।কিন্তু নতুন কারিকুলামে লেখা বিষয়টির ওপর উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
শ্রেণিকক্ষেই সবকিছু পড়ানো হবে, কথাটি আদর্শিক। বাস্তবের সঙ্গে পুরোটা কিন্তু মেলেনা অন্তত আমাদের দেশের কনটেস্টে। প্রথমত, শ্রেণিকক্ষের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ অনুশীলন দরকার, সেটি হয় না কিছু বাস্তবতার কারণে। একজন শিক্ষার্থীর যে আলাদা সময় প্রয়োজন সেটি দেয়ারও সুযোগ থাকে না। কাজেই শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে যারা ভালো ফলাফল করতে চাইতো, তারা প্রাইভেট পড়ে, কোচিং করে সেগুলো সেরে নেয়ার চেষ্টা করতো। যারা দুর্বল, তারা তা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রাইভেট পড়া ও কোচিং করা চালিয়ে যেতেন। তবে, বিষয় দুটো কিছু ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক আকার ধারণ করায় সচেতন অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও পলিসি মেকাররা প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে আসছেন এবং বন্ধের জন্য কিছুটা এই ব্যবস্থা করেছেন। শিক্ষাকে আনন্দময় করার প্রতিশ্রুতির মধ্যে দিয়ে হোমওয়ার্কের একেবারেই গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টিও চলে এসেছে। কিন্তু হোমওয়ার্ক একেবারে বাদ দেয়া ঠিক হবেনা। কারণ, এই বয়সের শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখতে হবে কিন্তু সেটি যেনো তাদের জন্য বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়। বাসায় একেবারে কিছু করার না থাকলে তারা বাজে কাজে সময় নষ্ট করবে। ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা’ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, সেটিই হয়তো এখানে হবে। শ্রেণিকক্ষের অল্প সময়ের মধ্যে সব বিষয়ের সঠিক অনুশীলন সম্ভব হয় না। তাছাড়া কিছু শিক্ষার্থী সবার সামনে থেকে বিষয় আয়ত্ত করতে পারেন না, তাদের আলাদা এবং নিজস্ব সময় প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীরা পাস করছেন, ভালো গ্রেডিং পেয়ে আসছিলেন-কিন্তু তাদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং উন্নত হচ্ছিলো না। নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় এ বিষয়েটিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে..যেটি সুষ্ঠু পদক্ষেপ। আগে কোনো রকম আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছাড়া, কনটেক্সটের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না বুঝেই একজন শিক্ষার্থী কেবল মুখস্থ করে আশানুরূপ নম্বর পেয়ে যেতো। এখন কিন্তু তাকে বুঝে কনটেক্সটের সঙ্গে রিলেশনশিপ তৈরি করে শুধু মাত্র জানলেই চলবে না, তাকে সেটা প্রয়োগ করার দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। এটিও আদর্শিক দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়। ক’জন শিক্ষকের এ বিষয়টি মূল্যায়ন করার দক্ষতা রয়েছে সেটি একটি বিষয়। তাছাড়া একজন শিক্ষককে প্রতিদিন কতটা করে ক্লাস নিতে হয়, কতজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলতে হয়, কতটা ধৈর্য্য তার থাকে যে-এসব বিষয় লক্ষ্য করে করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। আমাদের শিক্ষার্থীদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
মেধা আছে কিন্তু প্রকাশ করার পরিবেশ, পরিস্থিতি না থাকায় এগুলো সুপ্তই থেকে যায়। প্রকাশিত হয়না, হলেও অনেক বিলম্বে। ভালো গ্রেডিং নিয়ে পাস করেও লেখায় দুর্বল ছিলো। বর্তমান মূল্যায়নে লেখার ওপর গুরুত্ব আরও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তার কার্যাবলীর ওপরই বেশি মূল্যায়ন হবে। যে কোনো মূল্যায়নে লেখাটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে দেখা হয়। যুগ যুগ ধরে লেখাটাই একজন প্রার্থীর গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।কিন্তু নতুন কারিকুলাম বিষয়টির ওপর গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটি বিবেচনার দাবি রাখে। তবে, একজন শিক্ষক যদি দক্ষ হন..শিক্ষার্থীদের লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করায় তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবেন। যে কোনো কারিকুলামেই শিক্ষকের দায়িত্ববোধ, সৃজনশীলতা এবং জানার আগ্রহ শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে ও তা বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।