প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
বই পড়া নিয়ে এখন আর কাউকে কথা বলতে শুনি না। আর লেখালেখি তো নয়ই। বই পড়া নিয়ে কোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধ চোখে পড়ছে না অনেক দিন ধরে। কেউ লিখছেন না। একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন এবং আরও অনেকে লিখেছেন। তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বই পড়ার সংস্কৃতি তৈরি হতো স্কুলজীবন থেকেই। আমি পাঠ্যপুস্তকের কথা বলছি না। বলছি ‘আউট বই’-এর কথা। শৈশবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য সব বইকে আমরা ‘আউট বই’ বলতাম।
এখন শৈশব থেকে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে, শিশুদের পড়াশোনা ভালোই হচ্ছে। কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই কেউই অস্বীকার করবেন না, আজ অবধি পাঠ্যপুস্তক শিখন-শেখানোর আনন্দদায়ক শিখনসামগ্রী হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর মানে এই নয় যে, আমরা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকবিমুখ করার প্রেরণা জোগাব। তা আমরা করব না। বরং বিদ্যায়তনিক পরিবেশে এবং বাড়িতে কী করে তারা আনন্দের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক পাঠ করবে, সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করব। কিন্তু এও জানা যে, এই চেষ্টা সুদূরপরাহত।
তা হলে আমরা কী করতে পারি? খুব সহজ একটি কাজ করা যেতে পারে, আর তা হলো বাড়িতে শিশু-কিশোরদের উপযোগী প্রচুর বইয়ের সমহার ঘটানো। এ প্রসঙ্গে একটি গল্পের অবতারণা করা যায়। যিনি ব্যক্তিজীবনের এই গল্পটি বলেছেন, তার নাম ওল্ফ, ম্যারিয়েন ওল্ফ। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্টার ফর ডিসলেক্সিয়া, ডাইভারসিভ লার্নার্স অ্যান্ড সোশ্যাল জাস্টিসের পরিচালক। অধ্যাপক ওল্ফ তার প্রথম বই ‘প্রুস্ট অ্যান্ড দ্য স্কুইড’-এ লিখেছেন, তখন তিনি একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণিতে কী শেখানো হয়, সে বিষয়ে সব শিক্ষার্থীরই ধারণা ছিল। ওই বিষয়ে যখন শিক্ষক তাকে কিছু বলতে বলেন, তখন তিনি অনর্গল বলে যেতে থাকেন। কিছুতেই তিনি থামছিলেন না। অতিরিক্ত ও অনর্গল কথা বলার এই অভ্যাস তার জন্য একটি রোগের লক্ষণ ছিল। শিক্ষক ধৈর্যসহকারে তার কথা শুনেছেন এবং তার রোগটি চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছেন। পরে ওল্ফের দরিদ্র মা-বাবার সঙ্গে দেখা করেন ওই শিক্ষক এবং তাকে গ্রন্থের মধ্যে, পঠন-পাঠনের মধ্যে ব্যস্ত রাখার পরামর্শ দেন।
ওল্ফের জন্য সেভাবেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রচুর বইয়ের মধ্যে, নানা রকম ও নানা বিষয়ের বইয়ের মধ্যে তার শৈশব অতিবাহিত হয়। অনেক বইয়ের মধ্যে প্রফেসর ওল্ফ একটি বইয়ের কথা কখনো ভুলে যাননি, আর সেই বইটি হলো ‘অল অ্যাবাউট স্টারস’। তিনি লিখেছেন, ‘বই আমার ছোটবেলার জীবন বদলে দিয়েছে।’ তিনি আরও লিখেছেন যে, তার জীবনে যদি ওই মহৎ বইগুলোর সঙ্গে পরিচয় না ঘটত, তিনি যদি ওই বইগুলো থেকে বিপুল এক জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না পারতেন, তা হলে আজকের এই জ্ঞানসমুদ্রের দিশা তিনি কোনো কালেই পেতেন না। বাচালের মতো কথা বলেই তার জীবন নিঃশেষিত হতো। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নীরবে-নিভৃতে বইয়ের সঙ্গে কথা বলে তার মধুর সময় অতিবাহিত করার সুযোগ হতো না।
প্রশ্ন হতে পারে, এসব ‘আউট বই’ পড়ে কী হবে? এর সঙ্গে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার সম্পর্ক কী? ওপরে উল্লিখিত ঘটনার আলোকে এই জিজ্ঞাসার পুরো উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে উত্তর খুব সোজা। অনেক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রথমত, শিশু-কিশোরদের শব্দভাণ্ডারের জগৎ সমৃদ্ধ হবে; ভাষাবোধ তীব্র ও শানিত হবে; তথ্যভাণ্ডার প্রসারিত হবে; সৃজনশীল প্রতিভা বিকশিত হবে এবং অবশ্যই পরীক্ষা ও রেজাল্ট ভালো হবে। এই হলো বই পড়ার একদিক। অন্যদিক আছে বখে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি লাভ। কেউ কি কখনো শুনেছেন, যে শিশুরা বইয়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, বই না পড়লে যাদের পেটের ভাত হজম হয় না, তারা কেউ নেশাগ্রস্ত হয়েছে, মাস্তান হয়েছে, অপরাধী হয়েছে? আমার এই প্রায় ৬০ বছর জীবনে এমন কোনো নজির পাইনি।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গাটি হলো একমুখিনতা। নবমণ্ডদশম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা বিচিত্র বিষয় পড়ার সুযোগ পাই। এই বৈচিত্র্য কমে আসে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে। তখন আমাদের জানার পরিধিও কমে আসে। আমরা বিজ্ঞান নিয়ে, মানবিকী বিজ্ঞান নিয়ে বা ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়ি। ক্রমে আমরা ওই সব বিষয়ের আরও কোনো ক্ষুদ্রতর অধ্যায় নিয়ে পড়ি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই এই পরিধি সংকোচিত হতে থাকে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষাজীবন শেষ করা হলো, কর্মক্ষেত্রে সেই বিদ্যার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিংবা অধিকাংশ সময় পেশাগত জীবনে এই ক্ষুদ্রতর অধ্যায়ে গভীরত গবেষণার মধ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রাখি। সব সর্বনাশের মূল এখানেই। কারণ, ওই অধ্যয়নের যে পর্যায়ে গেলে জ্ঞানের সব শাখা একাকার হয়ে যায়, সেখানে আমরা পৌঁছোতে পারি না এবং পারি যে না, তাও বোঝার শক্তি আমাদের থাকে না। কিংবা আমাদের পেশাগত জীবনে অধ্যয়নের অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। ফলে অধিকংশ ক্ষেত্রে যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, সেই সম্প্রদায় মানবিক মানুষ হয়ে ওঠে না। তারা সুন্দর-অসুন্দরের ব্যবধান বোঝেন না, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য চিহ্নিত করতে পারেন না, নানা রকম বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য সংস্থাপন করতে পারেন না, তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় না এবং সর্বোপরি তাদের মধ্যে এমন কোনো মহৎ বোধ তৈরি হয় না, যাকে আশ্রয় করে তারা চমৎকার এক জীবন অতিবাহিত করতে পারে।
যে কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যদি ঘরে ঘরে আমরা নানা রকম গ্রন্থের সমাহার না ঘটাই, তাহলে আমাদের শিশুদের মধ্যে গ্রন্থ পাঠের অভ্যাস তৈরি হবে না। আর যদি তাদের মধ্যে গ্রন্থ পাঠের অভ্যাস তৈরি না হয়, যদি প্রতিনিয়ত তারা বিচিত্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গ্রন্থের প্রতি কৌতূহল অনুভব না করে, তা হলে কী নিয়ে তারা সময় কাটাবে? তার তো কৃষক নয়, চাকুরে নয়, ব্যবসায়ী নয়, তারা শিক্ষার্থী। প্রাতিষ্ঠানিক শিখন-শেখানো কার্যক্রমের বাইরে তাদের যথেষ্ট সময় থাকার কথা এবং সেই সময় খেলাধুলার পাশাপাশি তাদের আরও কাজ থাকতে হবে। যদি তা না থাকে, যদি সুষ্ঠু বিনোদনের ব্যবস্থা না করা হয়, তা হলে তারা এমন বিনোদনের পথ বেছে নেবে, যে বিনোদন তাদের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। যেমন: টেলিভশন, ফেসবুক, ইউটিউব ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়া।
এই প্রবণতা ব্যক্তি-শিশুটির জন্য কিংবা পরিবার-পরিজনের জন্য কিংবা সমাজের জন্য এবং এমনকি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তার প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে বটে, কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে যে জগতের সঙ্গে সে পরিচিত হচ্ছে, যেখান থেকে সে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না, সেই জগৎ তার জন্য তো কল্যাণকর নয়ই এবং অন্য কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। সুতরাং আমাদের আবারও বিবেচনা রাখতে হবে যে, একটি আলোকিত প্রজন্ম তৈরির জন্য গ্রন্থ পাঠের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। এই গ্রন্থ পাঠের অভ্যাস আমরা কী করে তৈরি করতে পারি, এই বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
অধিকাংশ সচ্ছল পরিবারে লক্ষ করা যায় যে, প্রতিনিয়তই সংসারের নানা প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে বিচিত্র সামগ্রী ক্রয় করা হয়। বাসায় প্রচুর ফার্নিচারের সমাহার ঘটানো হয়। এগুলোরও হয়তো প্রয়োজন আছে। কিন্তু গুরুত্বের ক্রম বিবেচনায় রাখা দরকার। বিশেষ করে যেসব বাসায় শেষ পর্যন্তু বই রাখার কোনো স্থানের সংকুলান নেই, সেসব বাসার কথা বলছি এবং যেসব বাসায় বই রাখার স্থান অছে, তাদের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো বাসায়াই বই থাকে না। এবং যেসব সামগ্রী দিয়ে বাড়ি বা বাসায় তিল ধারণের স্থান রাখা হয় না, সেসব সামগ্রী সত্যিকার অর্থে শিশু-কিশোরদের কিংবা ওই পরিবারের পরিণত বয়সের সদস্যদের খুব কি একটা কাজে লাগে? মনে হয়, সবাই একমত হবেন যে, এর অধিকাংশই বড়লোকপনা দেখানোর অভিপ্রায় মাত্র। শেষ পর্যন্ত এসব আয়োজন কোনো কাজে আসে না। বরং সন্তানরা যদি ভালো মানুষ হয়, তার চেয়ে ভালো উপঢৌকন আর কী হতে পারে! সুতরাং অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কমিয়ে যদি প্রতিটি পরিবারে বুক শেলফ স্থাপন করা হয় এবং প্রতি মাসেই যদি সুনির্বাচিত কিছু বই ক্রয় করা হয়, তাহলে কোনো না কোনো সময়ে কেউ না কেউ ওই বইগুলোর দু-একটি বের করে দু-এক পাতা ওলটাবে, আবার এমন বইও সেখানে থাকবে, যেটি পড়ে শেষ না করে মুক্তি পাবে না। কোনো বই কারও জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দিতে পারে।
এসব বই পড়ার জন্য শিশুদের বলতে হয় না। নিজের ভালো লাগার তাগিদেই তারা পড়বে। আর কোনো ছেলেমেয়ে যদি তাও না পড়ে, তাতে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তখন বুঝতে হবে, অন্য কোনো সম্ভাবনা তার মধ্যে আছে এবং আমরা তার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারি। এভাবে একটি পঠন-অভ্যাসকেন্দ্রিক পরিবার গড়ে তোলা যেতে পারে। নিশ্চিত করে বলা যায় যে, শৈশব থেকে যেসব শিশু গ্রন্থ পাঠের অভ্যাসের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠবে, তাদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। বলব, নেই বললেই চলে।
বই পড়া এমন এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যার ভেতর দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু যে জীবন ও জগতের প্রতি গভীর মমত্ববোধ সৃষ্টি হবে তা নয়, বরং আরও কত রকমের দক্ষতা, বোধ ও সংবেদনা যে তার মধ্যে তৈরি হবে, তাকে এক-দুই করে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কেননা যে শব্দকে ভালোবাসে, ভাষাকে ভালোবাসে, শব্দের ভেতরগত বিচিত্র রহস্যকে ভালোবাসে, বাক্যের অন্তরালবর্তী ফাঁকফোকর গলিয়ে যার মধ্যে চিন্তার বিচিত্র মাত্রা আপন স্বভাবে ধরা দেয়, তার জন্য আর কারও দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না। কারণ সে বোঝে, চিন্তার চর্চা কীভাবে করতে হয় এবং তার মধ্যে অতি ধীরে ধীরে প্রজ্ঞা তৈরি হয়, মর্যাদাবোধ তৈরি হয়, অহং তৈরি হয় এবং ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। তার মধ্যে যেকোনো বিষয়, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও ঘটনা বিশ্লেষণ করার নিজস্ব পরিমাপক তৈরি হয়। এবং যেকোনো নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলার শক্তিও সে লাভ করে গ্রন্থ পাঠের এই অভিজ্ঞতা থেকে। সুতরাং দেরি করব না; চলুন, আজকে থেকেই আমরা কিছু নির্বাচিত বই ক্রয় করে ঘরে ফিরি।