প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আশেক আলী খান
চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট আশেক আলী খান। তিনি শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। আমৃত্যু তিনি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।
আশেক আলী খানের জন্ম ১৮৯১ সালের ১ জুলাই, কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। বাবা আইনউদ্দিন খান, মা আলেকজান বিবি। আশেক আলী খান যে সময়ে জন্মেছেন সে সময়টি অগ্রসর ছিল না। শিক্ষা-দীক্ষা-বিজ্ঞানে সমাজের মানুষজন ছিল অসচেতন। এ চিত্র কেবল চাঁদপুরের নয়, বরং সারাদেশেরই ছিল। ১৯১০ সালে ভারতে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রচলন- এ পশ্চাৎপদতার সাক্ষ্য দেয়। তখন চাঁদপুরের বাবুরহাট হাইস্কুল ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আশেক আলী খান এ স্কুলে পড়তেন। তাঁর ক্লাসে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্র। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন, ক্লাসে প্রথম হতেন। ১৯১১ সালে এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। এখান থেকে ১৯১৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু অনটনের কারণে পড়াশোনা থমকে যায়। আশেক আলী খান দমে যাননি। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। সেসময়ে এ ভূখণ্ডে বিএ পাস করা ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর বিএ পাসের পর দেশের গণ্যমান্য বহু মানুষ তাঁকে অভিনন্দিত করেছে। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে মাদ্রাজ, দেরাগাজীখান, পাঞ্জাব, চন্দনপুর, আসাম, পাবনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৫০টি চিঠি পাঠানো হয়। বিএ পাসের পর আশেক আলী খান ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএবিটি পাস করেন। এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। সেকালে চাঁদপুরে কেউ ভালোভাবে ইংরেজি জানতো না। আশেক আলী খানকে বলা হতো ইংরেজি জানা বাঙালি সাহেব। তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষ গর্ব করতো। বিভিন্ন স্থান থেকে বহু মানুষ তাঁকে দেখতে আসতো। জানা যায়, হাজীগঞ্জে সেসময় দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ ছিল। জুমার নামাজ শেষে আশেক আলী খানকে মসজিদের মিম্বারে দাঁড় করানো হতো। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ তাঁকে দেখতো।
শিক্ষকতার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল তাঁর। মনেপ্রাণে তিনি এ পেশাকে ভালোবাসতেন। তিনি চাইলে ডেপুটি ম্যাসিট্রেটের চাকুরি করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। বিএ পাসের পর যোগ দিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। তাঁর প্রথম কর্মস্থল চাঁদপুরের গণি উচ্চ বিদ্যালয়। তাঁর চেষ্টায় এ স্কুলটি সেসময় সরকারি মঞ্জুরী লাভ করে। পরে তিনি স্কুল পরিদর্শক পদে চাকুরিতে যোগ দেন। এ কাজের সুবাধে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখার সুযোগ পান। বুঝতে পারেন শিক্ষা ও সমাজজীবনের নানা চিত্র। স্কুল পরিদর্শকের চাকুরিটিও তিনি বেশিদিন করেননি। ১৯১৯ সালে আশেক আলী খান শিক্ষক হিসেবে সরকারি স্কুলে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এসময় তিনি ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলাস্কুল এবং ঝালকাঠি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিলেও শিক্ষকতা ও শিক্ষা-উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা থেকে অবসর নেননি আশেক আলী খান। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৫ বছর চৌদ্দগ্রামের হাজী জালাল হাইস্কুল, মতলবের নারায়ণপুর হাইস্কুল, হাজীগঞ্জের দরবেশগঞ্জ হাইস্কুল, কচুয়ার রঘুনাথপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। আশেক আলী খান কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজে আলো জ্বালাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে তাঁর গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নিজ-নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আশেক আলী খান হাইস্কুল’। প্রথমদিকে এ পথচলা সুখকর ছিল না। এজন্যে আশেক আলী খানকে অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয়েছে। তাঁর মেয়ে সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব ও লেখক নীলুফার বেগম বাবার কণ্টকময় পথচলা সম্পর্কে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনে তিনি বহু আত্মত্যাগ করে স্থানীয় লোকজনকে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কাজটি ছিল ভীষণ কষ্টকর ও দীর্ঘস্থায়ী। আশেক আলী খান হাইস্কুল হতে তাঁর জীবিতাবস্থায় বহু ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় লোকদের উদ্বুদ্ধ করে যে শিক্ষার আলো তিনি জ্বালিয়েছিলেন তা সত্যিই শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। তৎকালীন এই বিষয়ে তাঁকে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবুও তিনি থেমে থাকেননি।’ ১৯৬৫ সালে আশেক আলী খান হাইস্কুল সরকারি হয়। বর্তমানে এটি কলেজ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যদিকে তাঁর চেষ্টায় কচুয়া থানায় মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। কচুয়ায় পরীক্ষাকেন্দ্র না থাকায় শিক্ষার্থীদের দূরদূরান্তে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হত। এতে ভোগান্তি পোহাতে হত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শিক্ষকতার প্রথম পর্বে আশেক আলী খান নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পারিপাশির্^ক বাধায় তাঁর চেষ্টা সফল হয়নি। উল্টো তাঁর পদোন্নতি আটকে দেয়া হয়েছিল।
সমাজউন্নয়নে আশেক আলী খান প্রাগ্রসর ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর গ্রামে ডাকঘর প্রতিষ্ঠা, মসজিদ নির্মাণ, স্বাস্থ্য, কৃষি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উত্তরণ হয়েছে। তিনি মানুষজনকে বৃক্ষরোপণ, মৎস্য চাষ, হাঁসমুরগি পালন ও কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে অর্থবহ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সবসময় সহযোগিতা করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে আশেক আলী খান ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ের জনক। তাঁর প্রত্যেক সন্তানই সুপ্রতিষ্ঠিত। সাবেক সংসদ সদস্য মেসবাহ উদ্দিন খান, বরেণ্য লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও রাজনীতিবিদ ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর তাঁর সন্তান। তাঁর দৌহিত্র বরেণ্য গবেষক মুনতাসীর মামুন। আশেক আলী খান ১৯৭৪ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়। তিনি কচুয়ায় যে শিক্ষার আলো জে¦লেছেন তাতে আলোকিত হয়েছে চাঁদপুরবাসী, উপকৃত হয়েছে সমাজ। তিনি তাঁর কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন সুদীর্ঘকাল।
ড. এম এ সাত্তার
সামাজিক ও পেশাগত জীবনে সফল মানুষ শিক্ষাবিদ ড. এম এ সাত্তার। তিনি বঙ্গবন্ধুর সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্থনীতিবিদ হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন।
ড. এম এ সাত্তার শাহরাস্তির নাওড়া গ্রামের সন্তান। জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। বাবা আজিজুর রহমান পাটোয়ারী, মা করফুলেন নেছা। পড়াশোনা করেছেন শাহরাস্তির নিউ স্কীম মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম হাই মাদ্রাসা, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, করাচী বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের টাফটর্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬০ সালে মৌলভীবাজার মহকুমার এসডিও হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানীদের কারাগারে বন্দী ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি সিভিল সার্ভিসে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে এম এ সাত্তারকে পরিকল্পনা সচিব পদে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি বস্ত্রমন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা আইকম্প-এর নির্বাহী পরিচালক-এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ড. সাত্তার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলাদেশ গণশিক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার রূপকার। এরমধ্যে রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজ, মৌলভী বাজার কলেজ, নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজ, গণবিদ্যালয় আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এ কীর্তিমান ১৯৯২ সালের ২৬ মে ইসলামাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নামে ‘ড. মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী ড. এলেন মেরি হেরিংটন ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবিকা। চাঁদপুরে আর্থসামাজিক উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১,
২. রত্নগর্ভা চাঁদপুর, মোহাম্মদ সফিউল আলম সম্পাদিত, আমাদের চাঁদপুর প্রকাশনী, প্রকাশ অক্টোবর, ২০০৭
৩. আশেক আলী খান : শিক্ষাসেবী ও গ্রামোন্নয়নের কর্ণধার, নীলুফার বেগম, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২ আগস্ট ২০১৫
৪. চাঁদপুর পরিক্রমা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রিয়তোষ সাহা; আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬