প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
গত মাসের ১৪ ডিসেম্বর আমরা যখন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশ করি, তখন সূর্য মধ্যগগনে। শুরুতেই ‘লার্নিং সেন্টার’ তথা শিশু শিখন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়া মনস্থ করি। সেখানকার লার্নিং সেন্টারগুলো তখনও ছুটি হয়নি। শিশুরা স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে পড়াশোনা করছে। পাঠদানরত অবস্থায় কয়েকটি শিখন কেন্দ্রে আমরা যেসব শিক্ষক পেয়েছি, তাদের সবাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। বার্মিজ ভাষায় তারা শিশুদের পড়াচ্ছেন। একেকটি শিখন কেন্দ্র একেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালনা করছে। এটা ভালো বিষয়, তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যেই যেসব ছেলেমেয়ে শিশুদের পড়ানোর যোগ্য তাদের বের করে সে কাজে নিয়োজিত করেছেন। এতে একদিকে রোহিঙ্গা শিশুর শিখন যেমন সহজ হচ্ছে, তেমনি ওইসব শিক্ষকেরও আয়ের একটা পথ খুলেছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো সেখানে আরও নানাভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে। যেমন রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই অক্সফ্যামের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন একজন আমাদের লার্নিং সেন্টারগুলো ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। এসব স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গার মধ্যেই সামাজিক ও পারিবারিক নানা বিষয়ে সচেতনতার কাজও করে থাকেন।
কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকাজুড়ে পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা শিবির। ৩৩টি শিবিরের যে কোনো একটিতে প্রবেশ করলেই রোহিঙ্গাদের ছোট ছোট ঘরের পাশাপাশি এমন লার্নিং সেন্টার বিশেষভাবে নজরে পড়বে। গত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে গড়ে ওঠা সাড়ে তিন হাজার লার্নিং সেন্টার। যদিও জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান ফর রোহিঙ্গা হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস গত বছর মোট ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছিল। এর মধ্যে কক্সবাজারের স্থানীয় হোস্ট কমিউনিটির শিশু রয়েছে ৬০ হাজার ৩৬টি। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫৬ হাজার শিশু শিক্ষার আওতায় আসে। সেখানে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক নারী। ওইসব লার্নিং সেন্টারে হোস্ট কমিউনিটি তথা স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষকতা করছেন সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক, যাঁদের বেশিরভাগই নারী। রোহিঙ্গা শিক্ষকরা শিশুদের বার্মিজ ভাষায় পাঠদান করান আর স্থানীয় শিক্ষকরা ইংরেজি ভাষার শিক্ষা দেন।
রোহিঙ্গা শিবিরের লার্নিং সেন্টারগুলোয় আসা সব শিশুর হাতেই আমরা বইসহ শিখন উপকরণ দেখেছি। মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুসারে শিশুরা পড়াশোনা করছে। রোহিঙ্গা শিশুরা 'লার্নিং কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাপ্রোচ' বা এলসিএফএ পদ্ধতিতে শিখছে। এ পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম থেকে চতুর্থ গ্রেড সমমানের শিক্ষা নিশ্চিত করছে। এলসিএফএর মাধ্যমে রোহিঙ্গা শিশুরা ইংরেজি, বার্মিজ, জীবনদক্ষতা ও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে। গত বছর থেকে সেখানে নতুন পাঠ্যক্রমের পাইলটিং চালু হয়েছে। যেটি প্রাথমিকভাবে ষষ্ঠ থেকে নবম গ্রেডের ১০ হাজার শিশুকে লক্ষ্য করে চালু করা হয়েছে। এ কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফের লক্ষ্য, ২০২৩ সালের মধ্যে সব রোহিঙ্গা শিশুকে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমের মাধ্যমেই শিক্ষা নিশ্চিত করা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবে আমরা সাক্ষাৎ করি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা বিষয়ে তিনি বলেছেন, এতদিন রোহিঙ্গাদের শিক্ষা এতদূর ছিল না। এখন সেটা নবম শ্রেণি পর্যন্ত হয়েছে। তাদের বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে, যাতে মিয়ানমারে ফিরে গিয়েও তারা শিখতে পারে কিংবা এখানকার শিক্ষার আলোকে তারা বাস্তবে কাজ করতে পারে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেছেন, সেটি হলো রোহিঙ্গা শিশুদের একই সঙ্গে তাদের ইতিহাসও পড়ানো দরকার। তারা যেভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাখাইনে গণহত্যার শিকার হয়েছে, মিয়ানমারে যেভাবে বারবার তাদের অধিকার হরণ করা হয়েছে এবং তাদের নির্যাতন করে বাস্তুচ্যুত করতে বাধ্য করেছে এবং যে কারণে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে কিংবা অন্যান্য দেশেও রয়েছে। সেটি তারা জানবে। রোহিঙ্গা শিবিরে ঘুরে বিভিন্ন লার্নিং সেন্টারে সাধারণ শিক্ষা যেমন দেওয়া হচ্ছে, তেমনি কিছু হাফেজি মাদ্রাসাও চোখে পড়েছে। বিশেষ করে মসজিদকেন্দ্রিক গড়ে ওঠেছে এসব মাদ্রাসা। যেখানে রোহিঙ্গাদের মধ্যকারই যাঁরা হাফেজ রয়েছেন, তাঁরাই সেখানে শিক্ষকতা করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় শিক্ষার সুযোগ যেভাবে রয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে ভালো বিষয়। বিশেষ করে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা চালু হওয়ায় ঘাটতি অনেকখানি কমবে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুরা পড়ার পরও সার্টিফিকেট বা সনদ না পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সার্টিফিকেট না দিলে রোহিঙ্গাদের অনেকেই শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে না। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে প্রকাশিত এটিএন বাংলার এক বিশেষ প্রতিবেদনে রাশেদা কে চৌধুরী পরামর্শ দিয়েছেন, ইউনিসেফসহ অন্য সংস্থাগুলো যারা রোহিঙ্গাদের শিক্ষায় এগিয়ে এসেছে, তারা সার্টিফিকেট পাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করতে পারে। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি তাদের সনদের বিষয়েও আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে সোচ্চার হওয়ার কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে আমরা যখন ফিরে আসছি তখনও কানে বাজছিল রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ার শব্দ। তাদের সে কলকাকলি মধুর এবং স্বস্তির। বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া, তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং তাদের শিশুদের শিক্ষার যে ব্যবস্থা করছে, তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা শিশুরা সাক্ষরতা অর্জন করছে, তাদের শিক্ষার সনদের ব্যবস্থা করলে তারা মিয়ানমারে গিয়েও সেটি কাজে লাগাতে পারে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি এ বিষয়টির দেনদরবারও মিয়ানমারের সঙ্গে করা দরকার।