মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

স্মার্ট এডুকেশন : করণীয় ও বর্জনীয়
অনলাইন ডেস্ক

ডিজিটাল ডিভাইস, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট, ইন্টারেক্টিভ এনিমেশন ও অডিও-ভিডিও দিয়ে পাঠদান করাই স্মার্ট এডুকেশন নয়। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক যেমন বাঞ্ছনীয়, তেমনি শিক্ষার সব উপকরণ ও সরঞ্জাম, খেলাধুলার মাঠ, যাতায়াতব্যবস্থা ইত্যাদি থাকতে হবে সব প্রতিষ্ঠানে একই রকম। শহরগুলোতে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধ, জায়গার অভাবে স্কুল এবং সংলগ্ন রাস্তায় ভ্যান ও গাড়ির চাপ, ছুটি না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের জন্য মা-বাবার অপেক্ষা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নিজের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র ভালো স্কুলে যাতায়াতে যেমন প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়, তেমনি মূল্যবান কর্মঘণ্টাও নষ্ট হয়। উন্নত বিশ্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক লেভেলের স্কুলগুলো একই মানের হওয়ায় নিজ নিজ এলাকার স্কুলে পড়ানো বাধ্যতামূলক।

স্মার্ট এডুকেশনে শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল ও অন্যান্য এক্সট্রা কারিকুলামের পারফরম্যান্স দেখে শিক্ষার্থী ডাক্তার হবে নাকি ইঞ্জিনিয়ার হবে, তা ঠিক করে দেন ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। এমনকি উচ্চশিক্ষায় ব্যর্থ হলে কারিগরি কিংবা অন্য ভোকেশনাল কোর্সের দিকেও নিয়ে যান ঐ শিক্ষক। এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের মধ্যে কোনো অভিযোগ বা আপত্তি ওঠে না। স্মার্ট দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ থাকে, তখন ঐ শিক্ষার্থীর মা-বাবার অফিস বা কর্মক্ষেত্রেও জাতীয় ছুটি থাকে। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বছরব্যাপী পরীক্ষা, ছুটি ও অন্যান্য শিক্ষা কর্মসূচির একই পরিকল্পনা থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মা-বাবাসহ একসঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাসফর ও অবকাশে যেতে পারে। আমাদের আনস্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থায় ছুটির এই বিষয়গুলো সমন্বয় করতে পারলে স্মার্ট এডুকেশনের পথ ত্বরান্বিত হবে। উন্নত বিশ্বে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য বছরে এক-দুই দিন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয়), গবেষণা কেন্দ্র, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্থানসমূহ পরিদর্শনের জন্য নির্ধারিত থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা কিংবা যে যেদিকে যেতে চায়, তা ঠিক করতে পারে শিশুকাল থেকেই। বছরে কয়েক বার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হয় মতামত, পরামর্শ এবং এর ভিত্তিতে চলে পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম। এই চর্চা আমাদের দেশে খুবই বিরল। এগুলো অন্তর্ভুক্ত হলে স্মার্ট এডুকেশনে অনেকটা সহায়তা হবে।

স্মার্ট এডুকেশনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অশিক্ষিত কিংবা দলীয় লোকের কোনো প্রাধান্য থাকে না। থাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ লোকজন। কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনির ব্যবস্থা নেই। স্কুলের পড়া স্কুলেই শেষ হয়ে যায়। বাসায় এসে শিক্ষার্থীরা মা-বাবার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটায়। বছরব্যাপী পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট পরীক্ষা, কুইজ থেকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করে। ঘন ঘন পরীক্ষা নেই স্মার্ট শিক্ষায়, নেই পিএসসি, জেএসসি, এসএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাও। পরীক্ষা নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী টেনশন করে না, অসুস্থ হয়ে পড়ে না। অনেক সময় শিক্ষার্থী বুঝতেই পারে না এটি একটি পরীক্ষা। সবকিছুই চলে খেলা ও আনন্দের ছলে। শিশুর শরীরের ওজনের চেয়ে বই ও ব্যাগের ওজন বেশি, এই দৃশ্য শুধু আমাদের মতো আনস্মার্ট শিক্ষায় দেখা যায়। স্মার্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকে না কোনো মিছিল, মিটিং, লাইটিং, পোস্টারিং কিংবা গোলাগুলি ও লাশ হয়ে বাড়ি ফেরার ঘটনা।

স্মার্ট এডুকেশনে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চলে ক্লাস, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ। চলে কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিস, ক্রীড়া, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। আধুনিক জিমনেসিয়াম, সুসজ্জিত ব্যায়ামাগার, ডে-কেয়ার ইত্যাদি স্মার্ট এডুকেশনের পূর্বশর্ত। অন্ধ, ডিজেবল ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য থাকে আধুনিক শ্রেণিকক্ষ। গতানুগতিক মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে বাস্তব, কর্মমুখী, সৃজনশীল ও কল্যাণমুখী দেশপ্রেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হাওয়াই স্মার্ট এডুকেশন। সংযুক্ত থাকতে হয় সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, শিক্ষাসফর ইত্যাদির সঙ্গে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ দ্রুতগতির ইন্টারনেট, আইটি ফ্যাসিলিটিজ, ডিজিটাল কনটেন্ট, ডিজিটাল লাইব্রেরি, ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া কোলাবরেশন এবং শিক্ষা শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও উদ্যোক্তা হওয়ার নিশ্চয়তাই হচ্ছে স্মার্ট এডুকেশান। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট এডুকেশনে উন্নতি করার লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রমকে একটি ইউনিক প্ল্যাটফরমে সাজাতে হবে। অর্থাৎ, বাংলা ও ইংলিশ মাধ্যম, ইংলিশ ভার্সন, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাক্রমকে একই ছাতার নিচে আনতে হবে। সেই লক্ষ্যে একটি ইউনিক আইডির সমতলে শিক্ষার্থীদের সব তথ্যসংবলিত আধুনিক ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে, যেখানে উপরিউক্ত সব পদ্ধতিকে অ্যালাইন বা ম্যাপিং করা যায়। সনদ ইস্যু, বেতনভাতা, পরীক্ষার ফি, ফলাফল ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য একই আইডি ব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে এক্সেসযোগ্য হতে হবে—তথ্যসংবলিত ইন্টারেক্টিভ ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ সংযুক্ত হতে পারে। প্রতি বছর নতুন করে ভর্তি করা এবং ভর্তি ফি আদায় করা সমীচীন নয়। বছর বছর ফি নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ হয়তো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কিংবা শিক্ষকদের বেতনে সহায়তা করেন। তবু স্মার্ট এডুকেশনের স্বার্থে এই আনস্মার্ট চর্চা বর্জন করা উচিত— স্মার্টকে (ঝগঅজঞ) বিস্তৃতি করলে দাঁড়ায় ঝ-ঝঢ়বপরভরপ : সুনির্দিষ্ট, গ-গবধংঁৎধনষব : পরিমাপযোগ্য, অ-অপযরবাধনষব : অর্জনযোগ্য, জ-জবষবাধহঃ : প্রাসঙ্গিক, ঞ-ঞরসব-ইধংবফ : সময়ভিত্তিক। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্ক্ষিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে স্মার্ট এডুকেশন বেশ সহায়তা করে। কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের পরিমাণগত ও গুণমান শিক্ষার্থীর শেখার ও বিকাশের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সময়সীমা ঠিক থাকলেও উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সময়সীমা ঠিক রাখা অনেকটাই কঠিন হয়। শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে কর্মক্ষেত্র কিংবা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। রয়েছে প্রাসঙ্গিকতা ও অর্জনে অনেক ব্যর্থতা। সে কারণে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনীর অফিসার ও ব্যবসায়ী হচ্ছে এমপি ও রাজনীতিবিদ, অথচ অর্থনীতিবিদ হয়েও হতে পারছে না কেউ অর্থমন্ত্রী। বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাবেই এমনটি হয়ে আসছে। এসব হযবরলকে স্মার্ট এডুকেশন তো দূরের কথা, আনস্মার্ট এডুকেশনও বলা যায় না। তবে আশার আলো এই যে, সম্প্রতি প্রণীত নতুন কারিকুলামে উপরিউক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও কর্মোপযোগী স্মার্ট এডুকেশনের রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়