প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
শিশুরা এমনিতেই নতুন কিছু পেলে, দেখলে আনন্দ পায়। আনন্দের এই মাত্রা আরও বেড়ে যায় যখন তারা হাতে পায় নতুন বই। বছরের প্রথম দিন তাদের মধ্যে একটা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করে। আগামী দিনের পথ চলায় বই উৎসবকে কেন্দ্র করেই দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত হয়েছে। নতুন বইয়ের সঙ্গে স্কুল ড্রেস, উপবৃত্তি ও মিড-ডে মিলের মতো উৎসাহব্যঞ্জক সুযোগ-সুবিধা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার একান্তই নিজস্ব ধ্যান-ধারণার বহির্প্রকাশ।
একটি শিশুও অশিক্ষিত থাকবে না, থাকবে না না খেয়ে, শিক্ষিত হয়ে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে, স্মার্ট সোনার বাংলা তৈরি করবে ইত্যাদি এই জননীরই কথা। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশের আগামী প্রজন্মকে সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা। এ বছরও আয়োজনের কোনো কমতি নেই। কাগজের কাঁচামাল, ডলার ও বিদ্যুত সংকটের প্রতিকূলতা কাটিয়ে নতুন দিনে, নতুন বই পাওয়ার অপেক্ষায় এখন দেশের সকল শিক্ষার্থী।
সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ পড়ে ডলার সংকটে। সে কারণে আমদানিনির্ভর অনেক পণ্যের পাশাপাশি প্রভাব পড়েছে মুদ্রণ শিল্পেও। কাগজের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কমেছে কাগজের সরবরাহ। প্রয়োজনীয় কাগজ না পাওয়ায় মুদ্রণ শিল্পের মালিক ও শ্রমিকরা সময় মতো বই বাঁধাই করতে বিলম্ব হয়েছে। ফলে অনেকেই মনে করেছিলেন, এ বছর বই সময় মতো স্কুলে পৌঁছাবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর তৎপরতায় ডলার সংকটের সমাধান হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঠ্যপুস্তকের প্রায় ৮০ শতাংশ বই মাঠপর্যায়ে পৌঁছানো গেছে। অবশিষ্ট বই জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের ১৪ কোটি ৪১ লাখ বই মাঠপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রায় ১৭ কোটির মতো বই প্রস্তুত করা সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, এ বছর সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মোট ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮৩৩টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণের কথা রয়েছে। এর মধ্যে প্রাইমারির (প্রাক প্রাথমিক থেকে ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীসহ) মোট বই ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৭ হাজার ২৪৫টি এবং মাধ্যমিকের জন্য ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি বই বিতরণ করা হবে।
বই উৎসব বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সফল উদ্যোগ। প্রতিবছর ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। এটি পাঠ্যপুস্তক উৎসব বা বই দিবস নামেও পরিচিত। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সংকট কমাতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছর সরকার ২৯৬ কোটি ৭ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক প্রদানের উদ্যোগ নেয় এবং ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি এটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়।
একদিনে বিপুল সংখ্যক বই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ (চলতি শিক্ষাবর্ষ) সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে মোট ৪৩৫ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার ৪১ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে বই। ফলে ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি যেখানে ছিল ৬১ ভাগ, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতভাগে। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বই ছাপানো থেকে শুরু করে বই বিতরণ পর্যন্ত পুরো কাজটি করে থাকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি।
এর ফলে ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি যেখানে ছিল ৬১ ভাগ, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতভাগে। বছরের প্রথম দিন নানা রঙের বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শিশুরা আনন্দে তাদের দুই হাতে রঙিন বইগুলো ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শিক্ষাবিষয়ক নানা রকম স্লোগান যেমন- ‘নতুন বছর নতুন দিন, নতুন বইয়ে হোক রঙিন’, ‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটবো, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশজুড়ে উঠব’- ইত্যাদি গাইতে গাইতে আনন্দ উল্লাসে বরণ করে নেয় নতুন শিক্ষাবর্ষের ‘বই উৎসব’।
টানা তেরো বছর ধরে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদানের এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিগত করোনাভাইরাস মহামারির কারণেও থেমে ছিল না এই কার্যক্রম। স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল বই। শিক্ষায় বাংলাদেশের এই মহতী উদ্যোগ ইউনেস্কোসহ সারাবিশ্বে আজ প্রশংসিত।
বই উৎসবের সাফল্যের এই ধারা নিম্নরূপ- ২০১০ শিক্ষাবর্ষে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ জন শিক্ষার্থীকে ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি; ২০১১ শিক্ষাবর্ষে ৩ কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার ৩২১ জন শিক্ষার্থীকে ২৩ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ২৩৪টি; ২০১২ শিক্ষবর্ষে ৩ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৩টি; ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ শিক্ষার্থীকে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি; ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ শিক্ষার্থীকে ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি; ২০১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি; ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি; ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ জন শিক্ষার্থীকে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি; ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৩ শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি; ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি; ২০২০ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৯৮ শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪টি; ২০২১ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০টি; ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০টি; ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮৩৩টি।
বই বিতরণে প্রচলিত প্রাথমিক, প্রাক-প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্কুলের বাইরে রয়েছে ইবতেদায়ি, দাখিল, শিক্ষক নির্দেশিকা এবং কারিগরি (ট্রেড বই), ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী) পাঠ্যপুস্তক। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে কাঁচামাল ও ডলার সংকট ছাড়াও নানা রকম ভুলত্রুটি অসঙ্গতি হতে পারে। মুদ্রণ বিভ্রাট, পাতা এলোমেলো থাকা, ছাপার মান খারাপ, বানান ও মুদ্রণ ভুল ইত্যাদি অভিযোগ এসেছে বিগত সময়েও। তবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল তথ্য, কোনো কবিতাংশ কিংবা ধর্মীয় বিষয়ে অসঙ্গতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। মুদ্রণের আগে এই বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
সামান্য ভুলের জন্য বিশাল এই কর্মযজ্ঞের মহৎ উদ্যোগটিতে যাতে কোনোরকম দাগ না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আয়োজনটি যেহেতু প্রতিবছরই অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধনী-গরিব সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সফলভাবে হচ্ছে, তাই আগামী বছরের আয়োজনটি এখন থেকেই হাতে সময় নিয়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করা উচিত। চৌদ্দ বছর যাবত বই উৎসবের এই সুবিশাল আয়োজন শিক্ষা পরিবারের একটি বিশাল অভিজ্ঞতা। সংকট আছে, সংকট থাকবে, ভুলভ্রান্তি হলে সমালোচনাও হবে, কিন্তু থেমে যাওয়া চলবে না। আগামী প্রজন্ম নিষ্পাপ শিশুদের মুখের অনাবিল হাসির দিকে তাকিয়ে ডলার সংকটের অজুহাতে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্য নিত্যপণ্য দ্রব্যের ন্যায় শিক্ষার মতো পবিত্র কাজে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি পরিহার করতে হবে। সকল সংকট ও বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণের এই মহাউৎসব যে কোনো মূল্যে অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।