প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। আসছে শিক্ষাবর্ষে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষাক্রমে পড়ালেখা শুরু করবেন। এই দুই শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক জেলায়, জেলা থেকে উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। উপজেলা থেকে পাঠ্যবই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে। নতুন বছরের একদম শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে যাবে।
গত কয়েক বছর থেকে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়া শিক্ষাক্ষেত্রে এই সরকারের একটি প্রশংসনীয় কাজ, তাতে কারো দ্বিমত নেই। আমাদের সময় বই কিনে পড়তে হতো। এরপরও সব বই হাতে পেতে কোনো কোনো সময় তিন-চার মাস লেগে যেতো। যাই হউক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অন্যান্য শ্রেণিতেও পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে এবং ২০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা সব শ্রেণিতে কার্যকর হবে। এর রূপরেখা ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি। প্রত্যেকে এটিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত আমরা যারা শিক্ষক ছিলাম বা আছি, তারাও এর মাধ্যমে শিক্ষায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করছি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। তদুপরি মনের ভেতর একটা আশংকা থেকে যায়। নতুন কারিকুলামটি পূর্বের অন্যান্য কারিকুলাম ও সিলেবাসের ন্যায় কতটুকু সফল হবে?
একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নতুন কারিকুলামে আমরা সৃজনশীল পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। গত ১০ বছরে আমরা এই পদ্ধতি থেকে কী কী অর্জন করতে পেরেছি, আর কী কী অর্জন করতে পারিনি, না পেরে থাকলে কেনো পারিনি- এ সব নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ আছে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, এনসিটিবি বা শিক্ষাবোর্ডের কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে আমাদের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর নামে শত কোটি টাকা নিশ্চয় দুর্নীতিও হয়েছে। কিন্তু, এর সুফল আমরা কতটুকু পেয়েছি? শিক্ষায় যে কোনো পদ্ধতি বাস্তবায়নে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত এবং এর প্রতিবন্ধকতা কী কী হতে পারে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তা কীভাবে অতিক্রম করা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে কথিত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তার অভাব নেই। জেলায় জেলায় শিক্ষা অফিসে গবেষণা কর্মকর্তা আছেন। এরা শিক্ষা নিয়ে কী গবেষণা করেন, কে জানে? এতো কিছুর পরও শিক্ষায় আমাদের দৈন্য দশা অন্যের চেয়ে বেশি। কারিকুলাম কিংবা সিলেবাস যেটিই হোক না কেনো, শিক্ষকেরা সেটি বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বরাবর সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষকরা অবহেলিত থেকে যান। এসব প্রণয়নে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ তেমন দেখা যায় না। সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়নে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কেউ ডাকে বলে মনে হয় না। তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভাবান ও মেধাবী শিক্ষক আছেন। অনেক সিনিয়র শিক্ষক আছেন যারা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞের চেয়েও অভিজ্ঞ।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, নতুন কারিকুলামের আলোকে প্রস্তুত না করে তা বাস্তবায়নের মতো কঠিন কাজটি শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বিষয়টি কেউ চিন্তা করে না। সৈনিকদের যুদ্ধের কলা কৌশল না শিখিয়ে যুদ্ধের মাঠে নামিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা। এর ওপর তাদের ঠিক মতো খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করা না হলে ক্ষুধার্ত কিংবা খালি পেটে তারা কীভাবে যুদ্ধ জয় করবেন?
যারা এনসিটিবিতে কাজ করেন এবং যারা কারিকুলাম ও সিলেবাস বিশেষজ্ঞ থাকেন, তাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয। অথচ মাঠ পর্যায়ে যারা সিলেবাস ও কারিকুলাম বাস্তবায়নে কাজ করেন, জাতির মহান কারিগর সে সব শিক্ষকদের নিয়ে কারো চিন্তা নেই। তাদের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এক শ্রেণির লোক মনে করে, শিক্ষকরা গুরুজন। তাদের সম্মান অনেক। টাকাণ্ডপয়সার লোভ তাঁদের থাকা উচিত নয়। আগেকার দিনে শিক্ষকেরা টাকা-পয়সার পেছনে এতো ঘুর ঘুর করেননি। এই হলো তাদের কথা। আমাদের কথা হলো, যারা এসব কথা বলে তারা এখানে লোভের কী দেখতে পেলো? শিক্ষকরাও মানুষ। তাদেরও পেট, পিঠ আছে। স্ত্রী-সন্তান আছেন। ভাই-বোন এবং বাবা-মা আছেন। অসুখ-বিসুখ থাকতেই পারে।