মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

স্মৃতিতে চাঁদপুর কলেজ
অনলাইন ডেস্ক

এক.

১৯৫৭ সনের ১৫ই জুন আমি চাঁদপুর কলেজে যোগদান করি। কয়েকদিন ছাত্রদের হোস্টেলের একটি কক্ষে থাকতে হয়েছিল। চাঁদপুর কলেজের নিজস্ব কয়েকটি বাসা আছে। তার মধ্যে চারটি বাসায় তখনো সরকারি কর্মচারীরা থাকতেন। ঠিক সময়েই একজন সরকারি কর্মচারী বাসা ছেড়ে চলে গেলেন। আমি বাসা পেয়ে গেলাম। আমার বাসার সামনে বাসা দুটির একটিতে থাকতেন অধ্যক্ষ আজিমউদ্দিন আহমদ, অন্যটিতে অধ্যাপক দবিরুদ্দীন আহমদ। আমার পাশের বাসায় থাকতেন অধ্যাপক মোহাম্মদ উল্লা আর পিছনের বাসায় থাকতেন কলেজের হেড ক্লার্ক সৈয়দ আহমদ সাহেব। তখন কলেজে আর পাঁচজন মাত্র অধ্যাপক ছিলেন- শৈলেন রায়, শাহদৎ হোসেন চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র পোদ্দার, সত্যেন্দ্রনাথ ভৌমিক ও শাহাদাৎ উল্লা। আমার কয়েকদিন পরেই এলেন তর্কশাস্ত্রের অধ্যাপক বদরুদ্দোজা সাহেব। চাঁদপুর এসেই অধ্যক্ষ মো. আজিমউদ্দিন সাহেবের নির্দেশে কলেজে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। ঐ অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা ও গায়ক আব্বাস উদ্দীন সাহেব। উভয়েই গান গেয়ে অনুষ্ঠানটিকে উপভোগ্য করে তুলেছিলেন। আজিমউদ্দিন সাহেব সাহিত্যামোদী লোক ছিলেন এবং নিজেও লিখতেন। ১৯৪৭ সালে চাঁদপুরে তার সম্পাদনায় ‘আলো’ নামে একখানা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কয়েক বছর পত্রিকাটি চালু ছিল। ১৯৪৮ সালে আজিমউদ্দিন সাহেবের উদ্যোগে চাঁদপুরে মুকুল ফৌজের শিক্ষা শিবির হয়েছিল। ঐ শিবিরে কোলকাতা থেকে এসেছিলেন মুকুলফৌজের সর্বাধিনায়ক জনাব কামরুল হাসান-পরবর্তীকালে বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে যিনি বিপুল সুনাম অর্জন করেছেন। ঢাকা থেকে এসেছিলেন আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন প্রমুখ। হাসান আলী হাই স্কুলে কয়েকদিনব্যাপী ঐ শিবির অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে আজিমউদ্দিন সাহেব কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন।

১৯৪২ সালে জাপানি আক্রমণের ভয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অংশবিশেষ স্থানান্তরিত হয় চাঁদপুর হাসান আলী হাইস্কুলে। ১৯৪৬ সালে ঐ কলেজ কুমিল্লা ফিরে গেলে স্বতন্ত্র চাঁদপুর কলেজ স্থাপিত হয় আজিজ আহম্মদ ময়দানে সামরিক বাহিনীর পরিত্যক্ত ব্যারাকে। কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বাবু পরেশ চন্দ্র গাঙ্গুলী যিনি চাঁদপুরে স্থানান্তরিত কুমিল্লা কলেজের অংশ বিশেষের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর অধ্যক্ষ হয়েছিলেন জনাব মো. আজিমউদ্দিন আহমদ। ত্রিশের দশকে খেলাধুলার প্রয়োজনে পাশেই একটি দিঘি কাটিয়ে এই ময়দান তৈরি করা হয়েছিল।

দুই.

আমি জনসংযোগ বাড়াবার জন্য শিশু কিশোর সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম এবং ১৯৫৭ সালেই আমার পরিচালনায় চাঁদপুর অঙ্কুর কচিকাঁচার মেলা জন্মলাভ করলো, এ সংগঠন গড়ে তোলার কাজে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল আমাদের কলেজের ছাত্র শাহ মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লা ও তার বড় বোন হেনা। সেও তখন আমাদের কলেজের ছাত্রী। হেনা আমাদের কলেজ থেকে বিএ পাস করে স্থানীয় মাতৃপীঠ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা নিযুক্ত হয় এবং পরে আমার সাহায্যে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বাংলায় এম.এ. পাস করে। তার স্বামী ছিল রাজশাহীর গোপালপুর চিনিকলের একজন ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী লাইনে দাঁড় করিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাকেও হত্যা করে। ঐ আঘাতে হেনা পাগল হয়ে গেছে। এখন সে চাঁদপুরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

তিন.

১৯৫৮ সালে আমাদের কলেজে ভর্তি হলো অরুণ নন্দী। ১৯৫৯ সালে সে আন্তঃকলেজ সাঁতার প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হয়। ঐ বছরেই তিন মাইল মহকুমা সাঁতার প্রতিযোগিতায় সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। প্রথম হয়েছিল আমাদের কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল মালেক। অরুণ নন্দী ১৯৬৩ সালে কোলকাতায় সাঁতার প্রতিযোগিতায় রিলেতে প্রথম এবং ১০০ মিটার সাঁতার প্রতিযোগিতায়ও সে দ্বিতীয় হয়, ১৯৬৭ সালে ফরিদপুরে ১৪ মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় সে প্রথম হয়। ১৯৬৮ সালে কুমিল্লায় সে ৫৮ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কাটে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কোলকাতায় ৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট অবিরাম সাঁতার কেটে সে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং সন্তরণ শ্রী উপাধিতে ভূষিত হয়। সাঁতার থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ সে মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দান করেছিল। ১৯৭৪ সালে অরুণ নন্দী মীরপুর থেকে চাঁদপুর ৭০ মাইল সাঁতার কেটে দূর পাল্লার এশীয় রেকর্ড সৃষ্টি করে। অরুণ নন্দীর পূর্বে আমাদের কলেজের বিখ্যাত সাঁতারু ছিল আব্দুল মালেক। ব্রজেন দাসের পরে সে পূর্ববঙ্গের দ্বিতীয় ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী।

চার.

চাঁদপুরের এসে আমার সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমাদের বাংলা বিভাগের প্রধান বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ভৌমিকের সঙ্গে। চাঁদপুর গনি মডেল হাই স্কুলের ঠিক সামনেই তাদের বাসা। তার পিতা বাবু কৈলাস চন্দ্র ভৌমিক ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমাস্টার ছিলেন। ঐ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন চাঁদপুরের বিখ্যাত দানবীর সমাজসেবক আমজাদ আলী পাটোয়ারী। তিনি চাঁদপুর নুরিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯০ সালে। ১৯২৮ সালে এটি হাই মাদ্রাসা-১৯৬৯ হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। আমজাদ পাটোয়ারী সাহেব চাঁদপুর পুরাণবাজারে স্থাপন করেন ‘আমীন চ্যারিটেবল ডিসপেনসারী।’ এই তিনটি প্রতিষ্ঠান তিনি স্থাপন করেছিলেন তিন পুত্র নুরুল হক, বজলুল গণি ও আমিনুল হকের নামে। তিনি চাঁদপুর হাসান আলী জুবিলী হাইস্কুলের আহম্মদীয়া হোস্টেল ও বেইলী হোস্টেল নির্মাণে বিপুল আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। আহম্মদীয়া হোস্টেল বর্তমানে মহিলা কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। আহম্মদীয়া হোস্টেলের প্রতিষ্ঠাতা রূপসার জমিদার আহাম্মদ গাজী চৌধুরী। চাঁদপুর পুরাণবাজার জামে মসজিদও প্রতিষ্ঠিত হয় জনাব আমজাদ পাটোয়ারী প্রদত্ত জমিতেই।

সত্যেন বাবু স্টেটসম্যান পত্রিকা রাখতেন। প্রতিদিন বিকেলে তার বৈঠকখানায় বসে এ পত্রিকা পড়তাম। তিনি চাঁদপুরের একজন বিখ্যাত কবিরাজও ছিলেন। তার মত নির্ভীক, সহৃদয় ও স্পষ্টবক্তা খুব কমই দেখেছি। তিনি এবং আমাদের কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক বাবু শৈলেন রায় ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত কুমিল্লা কলেজের সহপাঠী ছিলেন। কিন্তু শৈলেন বাবু চেয়েও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল নিকটতর। প্রায় সব ব্যাপারে আমাদের দুই জনের দৃষ্টিভঙ্গির মিলই হয়তো এর প্রধান কারণ। আমার আসল পরিচয় শুধু তিনিই জানতেন এবং সমস্ত বিপদে আপদে আমার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতেন। মার্শাল ল’র প্রথমদিকে কয়েকদিন তার বাসায় আত্মগোপন করেছিলাম। ১৯৭১ সালে এক বস্ত্রে সত্যেন বাবুর পরিবার গৃহত্যাগ করেছিলেন। কয়েক মিনিট পরেই পাকবাহিনী তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৭৩ সালে তিনি অবসরপ্রাপ্ত হন। তার বড় ছেলে বড় মেয়ে কলকাতায় থাকতো, তার ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা এবং তার স্ত্রীপুত্র সবাই মিলে তাকে অনেক বুঝিয়েও কোলকাতায় যেতে রাজি করাতে পারিনি। একদিন তিনি ঢাকা থেকে কার্ডিওগ্রাফি করিয়ে এসে ১০ দিনের মধ্যেই তার বাড়িটা বিক্রি করে দিতে বললেন। তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না জানিয়ে তার স্ত্রী-পুত্রকে সংবাদটা না জানাতে বললেন। গোপনে কুমিল্লা গিয়ে তার বাসা বিক্রি করা হলো। সেই দিনই তাকে ঢাকায় নিয়ে বিমানে তুলে দিয়ে চাঁদপুর ফিরে এলাম। কয়েক দিন পরেই খবর পেলাম আমার পরম শুভানুধ্যায়ী সত্যেন বাবু আর নেই।

১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে এলেন ক্যাপ্টেন করিম উদ্দীন আহমেদ। প্রথমে তিনি কুষ্টিয়া কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন পরে সামরিক বাহিনীতে চাকরি নিয়ে প্রথমে কোয়েটা তারপর কাকুলের মিলিটারী একাডেমীতে মোট ৭ বছর ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। এরপর এলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সেখানে কর্নেল ব্রাউন সাহেবের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে এলেন চাঁদপুর কলেজে। করিম উদ্দীন সাহেব উদার ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ। চাঁদপুর কলেজে নিয়ে এলেন নবযুগ। ডিবেট, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা প্রদর্শনী ইত্যাদি তখন চাঁদপুর কলেজে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। ঐ সব অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বেশিরভাগ আমার উপরেই থাকতো।

১৯৬২ সালে শফিউল আলম সাহেব আমাদের কলেজে বাংলার অধ্যাপক হয়ে এলেন। এসেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তিনি দারুণ উৎসাহ প্রদর্শন করতে লাগলেন। তার উদ্যোগে কলেজের উৎসাহী ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আমরা একটি সাহিত্য সংস্থা গড়ে তুললাম। কলেজের ছাদে খোলা আকাশের নিচে আমাদের সাহিত্য আসর বসতো। ঐ সময়ে আমাদের কলেজে সাহিত্য ও বিজ্ঞান প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতো। করিম উদ্দীন সাহেবের অনুপ্রেরণাতেই সপ্তাহব্যাপী ঐ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলা বিভাগের প্রদর্শনীটিই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ঐ ব্যাপারে কলেজের কয়েকজন শিল্পী ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে শফিউল আলম সাহেব খুব পরিশ্রম করেছিলেন। পরে বুঝেছি তার এত উৎসাহের উৎস কোথায়! তিনি কলেজের ছাত্রী উৎসাহী সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দ আহমেদ সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমাকে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানালেন। আমি সৈয়দ আহমেদ সাহেবের কাছে কতটা পাড়লাম। তিনি আমাকে শফিউল আলমের বাড়ি কক্সবাজারের কাছে হাড়বাং পাঠালেন। ঐ পথে ওটাই আমার প্রথম যাত্রা। হাড়বাং আমার কাছে অপরূপ লাগলো। শফিউল আলম সাহেব প্রগতিশীল ছিলেন। সেই জন্যেই তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছিল ঘনিষ্ঠ।

পাঁচ.

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন ফেটে পড়ে। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ওয়াজীউল্লাহ ও বাবুল নিহত হয়। চাঁদপুরেও এই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে। ইতোমধ্যে চাঁদপুরে ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে উঠেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি ছিল শেখ মতিউর রহমান। সে তখন কলেজে আবার ভর্তি হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক ছিল জীবন কানাই চক্রবর্তী। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে চাঁদপুরে ঐ আন্দোলন প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে। আইয়ুবী স্বৈরাচারের কবরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে এটাই ছিল আন্দোলনের প্রথম বিস্ফোরণ।

১৯৬৩ সালে প্রথমদিকে চাঁদপুর হিলি পোর্ট উদ্বোধন করতে এলেন কুখ্যাত গভর্নর মোনায়েম খান। তার জনসভায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। চাঁদপুর কলেজের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। ওই গুলি চালানোয় কলেজের বাগানে গনি হাই স্কুলের ছাত্র শফিক একজন দোকান কর্মচারী নিহত হয়। যেখানে ছেলে দুটি নিহত হয়েছিল সেখানে নির্মিত হয় চাঁদপুর কলেজের প্রথম শহিদ মিনার। আটজন ছাত্রনেতাকে দায়ভার সোপর্দ করা হয়। তাদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শেখ মতিউর রহমান, জীবন কানাই চক্রবর্তী, শ্যামল সেনগুপ্ত এরাও ছিলো। বিচারে সকলেই খালাস পেয়ে যায়। পরবর্তীকালে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে এসেছিল আব্দুল হাই, সফিউদ্দীন আহমেদ, জহির উদ্দিন বাবর। তারপর মাহবুবুল হক পাটওয়ারী ও আব্দুল লতিফ। তারপর বাসুদেব সাহা, নিত্য গোপাল রায় ও চম্পক সাহাকে সামরিক আইনে গ্রেপ্তার করা হয় ও বেত্রদণ্ড প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ছিল কালাম, খালেক, সুশীল, আনোয়ার হোসেন আরিফ, আব্দুর রহমান ও মনিষা চক্রবর্তী। এদের মধ্যে তিনজন কালাম, খালেক ও সুশীল ’৭১ সালে বোমা তৈরি করতে গিয়ে শহিদ হয় ও আনোয়ার হোসেন আরিফ গুরুতর আহত হয়। ওদের কাহিনী পরে বলবো।

চাঁদপুর এসে সত্যেনবাবু ভিন্ন আমাদের কলেজের আর কোন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়নি এমনকি আমাদের জেলার অঙ্কের অধ্যাপক যোগেন সরকারের সঙ্গেও নয়। এর মূল কারণ আমাদের মানসিক গড়ন। প্রগতিশীল ব্যক্তি ভিন্ন আর কারো সাথেই আমি অন্তরঙ্গ হতে পারি না। ১৯৬২ সালে পুরাতত্ত্ব বিভাগের সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমাদের কলেজের অধ্যাপক হয়ে এলেন দিলীপ কুমার পণ্ডিত। তার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির দরুন অচিরেই তার সঙ্গে আমার ও আমার পরিবারের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠলো।

ছয়.

মাহমুদা খাতুন শিক্ষক হিসেবে আমাদের কলেজের সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে চলে যান। এই সময়ে আমার বাসায় এসেছিলেন এম এ ক্লাসের সহপাঠী আলীমুজ্জামান। সে তখন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যাপনা করতো। এর কিছুদিন পর সে রেডিও বাংলাদেশের পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের নাট্য বিভাগে যোগ দেয়। বর্তমানে সে রেডিও বাংলাদেশের সহকারী প্রধান। এর কিছুদিন পরেই আমার বাসায় এসেছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আর এক সহপাঠী আব্দুস সাত্তার। প্রথম জীবনে সে আরবি কবিতার অনুবাদ করতো। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতিদের নিয়ে অনেক বই লিখেছেন। এদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন সম্বন্ধে তার বইগুলি এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান ও কৌতূহলোদ্দীপক।

সূত্র : আমার দেশ আমার জীবন, সৈয়দ আব্দুস সাত্তার থেকে সংকলিত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়