মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকার বাস্তবতা
অনলাইন ডেস্ক

(গত সংখ্যার পর)

একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, গণিতের গ্র্যাজুয়েট যারা, তাদের শিক্ষার্থীরা গণিতে ভালো করেছে। যারা বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট তাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে ভালো করেছে। আর ম্যানেজমেন্ট পড়ে যারা গণিতে পড়াচ্ছেন তাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের হার কম। ভিন্ন বিষয়ের স্নাতকধারীরা গণিত কিংবা বিজ্ঞান পড়াতে গেলে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন কঠিন হবেই। প্রশিক্ষণের দিক দিয়েও বেশ পিছিয়ে রয়েছেন গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকরা।

২০১৯ খ্রিস্টাব্দে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার নানাদিক নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান। এর ফলাফলের ভিত্তিতে ‘সেকেন্ডারি স্কুল টিচারস ইন বাংলাদেশ : ইন দ্যা লাইট অব এসডিজি ফোর’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। তাতে উঠে আসে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে নিয়োজিত ৫৫ শতাংশ শিক্ষকেরই বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। শিক্ষকের মানের কথা বলতে গেলে সবার আগে যে বিষয়টি আসে সেটি হলো, শিক্ষকের যোগ্যতা। কারণ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিষয়টি বেশ অবহেলিত। আর যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক না পাওয়ার অন্যতম কারণ, আমরা এ পেশায় তাদের আকৃষ্ট করতে পারছি না। বিভিন্ন খাতে যত বড় উন্নয়নই হোক না কেনো, শিক্ষাকে অবহেলায় রেখে তা কখনই টেকসই হবে না। তাই আমাদের শিক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে হলেও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা প্রয়োজন।

গণিতে ষষ্ঠ শ্রেণির প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী খারাপ। এর মধ্যে ১৩ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছেন তিন ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থী। খুবই ভালো স্তরে আছে কেবল ৫ শতাংশ। অষ্টম শ্রেণিতে গণিত বিষয়ে ২২ শতাংশ খারাপ অবস্থায়। মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছেন ৩৬ শতাংশ। বাকিরা ভালো ও খুবই ভালো। দশম শ্রেণিতে প্রায় ৭ শতাংশের মতো শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ। এ শ্রেণিতে খুবই খারাপ শিক্ষার্থী প্রায় নেই বললেই চলে। ভালো অবস্থায় আছেন প্রায় ৩৮ শতাংশ। দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৬ হাজারের বেশি ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে ২২ শতাংশই স্নাতকে ইংরেজি পড়েননি। আর ৪ শতাংশ ইংরেজি শিক্ষক শুধু এইচএসসি পাস।

অপরদিকে মাধ্যমিকের ৬৭ হাজার ৯৭৫ জন গণিত শিক্ষকের মধ্যে ১২ শতাংশের এইচএসসিতে গণিত ছিলো না। আর প্রায় ২৪ শতাংশের স্নাতকে গণিত বিষয় ছিলো না। অর্থাৎ স্নাতকে গণিত ও ইংরেজি না পড়েই এক পঞ্চমাংশ শিক্ষক গণিত ও ইংরেজি বিষয় পড়াচ্ছেন। শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা না থাকলে তাদের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন সম্ভব নয়। এরশাদ সরকার জনপ্রিয়তার জন্য ইংরেজি ছাড়া বিএ ও গণিত ছাড়া বিএসসি পড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তখন পাস করা শিক্ষার্থীদের একটা অংশ শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে গণিত ও ইংরেজি বিষয় পড়াচ্ছেন। আমার প্রশ্ন, আমাদের দেশের তখনকার শিক্ষাবিদরা কি বিষয়টিতে খুব একটা বাধা দিয়েছিলেন? দেননি। এরশাদ আর্মির লোক। আর্মিতে তো ইংরেজির গুরুত্ব থাকে সবক্ষেত্রেই। কিন্তু এখানে কী ঘটেছিল?

যদিও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। কারণ, এসব শিক্ষক অবসরে চলে গেলে ও নতুন যোগ্যতা অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ হলে এমনটি আর থাকবে না। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উচ্চশিক্ষা সবক্ষেত্রেই ইংরেজিতে দক্ষতা জরুরি। আর বিশ্বের সব শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় গণিত শিক্ষাকে। এ দুটোতেই আমাদের শিক্ষার্থীরা দুর্বলতা নিতে উপরের শ্রেণিতে উঠতে থাকে।

মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকা একটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? যারা গণিত, ইংরেজি কিংবা বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্স নিয়ে পড়াশোনা করেন তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় ঢোকার চেষ্টা করেন এবং ঢুকে যান। এটিও স্বাভাবিক। শিক্ষকতা অর্থনৈতিকভাবে সব জায়গায় বা সবক্ষেত্রে আকর্ষণীয় নয়। তা ছাড়া এ পেশা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং বর্তমান যুগে খুব চাপেরও। প্রতিষ্ঠান যদি একটু নামকরা হয় তাহলে শিক্ষকদের খাটুনির অন্ত থাকে না। যদি নামকরা না হয় তাহলে চাকরি করাটা অনেকের নিকট প্রেস্টিজের ব্যাপার বলে মনে হয়। তাই, অনেক মেধাবী এ পেশায় আসতে চান না।

আর অনার্স-মাস্টার্সে শিক্ষার্থীরা যে কন্টেন্ট ও অধ্যায় নিয়ে পড়াশোনা করেন সেগুলোতে মাধ্যমিক নেই। তবে জ্ঞান নিয়ে তাদের যে চর্চা বা প্র্যাকটিস হয় সেটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের কাজে লাগে। যেমন ইংরেজিতে যারা অনার্স পড়েন তারা যে শেক্সপিয়র, বায়রন পড়ে আসেন তা কিন্তু মাধ্যমিকে নেই। আবার ল্যাংগুয়েজ স্ট্রিম থেকে যারা আসেন তারাও এসে দেখেন মাধ্যমিকে পড়ানোর বিষয় আলাদা। মাধ্যমিকে ভালোভাবে পড়ানোর জন্য তাদের আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়। গণিতে তারা যেসব বিষয় গ্রাজুয়েশন লেভেলে পড়ে আসেন সেগুলো কিন্তু মাধ্যমিকে নেই। অন্য বিষয়ের শিক্ষক যদি ডেডিকেটেড হন তাহলে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কিন্তু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান আনন্দময় করতে পারেন। গণিতে অনার্স পড়ুয়ারাই যে গণিত পড়াতে পারবেন তা নয়। যারা অর্থনীতি কিংবা একাউন্টিং কিংবা ম্যানেজমেন্ট পড়ে আসেন তারাও কিন্তু পারবেন। একইভাবে ইতিহাস, অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে যারা অনার্স পড়েন তারা যদি চর্চা করেন, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তাহলে ইংরেজি পড়াতে পারেন। আর সেটি তো করতেই হবে, এটিই তো আমাদের বাস্তবতা। উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষক থাকেন বিষয়ভিত্তিক।

আমরা সাধারণত ইংরেজিতে দুর্বল বলতে কী বুঝি? ইংরেজিতে হয়তো ‘এ’ প্লাস পায়নি শিক্ষার্থীরা কিংবা গ্রামারের কিছু জিজ্ঞেস করলে সঠিকভাবে বলতে পারে না সেগুলোকে বলে থাকি। আসলে ইংরেজিতে নিজে কোনো কিছু লিখতে পারবে, বলতে পারবে শুদ্ধভাবে, বিদেশিদের ইংরেজি শুনে বুঝতে পারবে, যে কোনো ইংরেজি বিষয় পড়ে তার মর্মোদ্ধার করতে পারবে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি কিন্তু সেভাবে পড়ানো হয় না। এমনকি ইংরেজিতে অনার্স পড়ে যারা মাধ্যমিকে শিক্ষকতা করতে আসেন তারাও এভাবে পড়ান না। তারাও কিছু গ্রামারের নিয়মণ্ডকানুন মুখস্থ করান, কিছু কম্পোজিশন মুখস্থ করান। একইভাবে গণিতের মাধ্যমে যে বেসিক ধারণা সৃষ্টি হওয়ার কথা শিক্ষার্থীদের সেটি কিন্তু হয় না। কাজেই অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের আগ্রহে আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়ে মাধ্যমিকের বিষয়গুলো ফলপ্রসুভাবে পড়ানোর দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

মাছুম বিল্লাহ : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়