প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
বই পড়ার গুরুত্ব এবং না পড়ার কুফল নিয়ে আলোচনা কিংবা সমালোচনা কম হয়নি। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে এ আলোচনা বেশি দেখা যায়। একুশের মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার কারণেই বলা চলে আমাদের বইয়ের আয়োজন অনেকটা ফেব্রুয়ারির মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রকাশকরা এ সময়েই অধিকাংশ প্রকাশ করেন। পাঠকও এ সময়ে নতুন বই খোঁজেন। সেদিক থেকে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত ২৩ এপ্রিলের ওয়ার্ল্ড বুক অ্যান্ড কপিরাইট ডে তথা বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবসটির ভিন্ন মাত্রা এখানেই, অন্তত ফেব্রুয়ারির বাইরের একটি দিনে বইয়ের আলোচনা হচ্ছে।
বইয়ের আলোচনা বহুমাত্রিক। ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে দিবসটির পেজ খুললেই একটা খোলা বইয়ের ছবি সামনে পড়বে, যার ওপর লেখা : রিড...আনটিল নো স্ট্রেঞ্জারস রিমেইন। অর্থাৎ যতক্ষণ অজানা বা অচেনা বিষয় থাকবে ততক্ষণ পড়ুন। মানুষের জ্ঞান সীমিত; যে বিষয়ই আসুক, মনে হয় কত অজানা রে। কেউ সারা জীবন দিনের অধিকাংশ সময় পড়ায় ব্যয় করলেও কি অজানা সব জানা হয়ে যাবে? বলা বাহুল্য, দিবসটির পেজে ইউনেস্কো আরও লিখেছে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন পড়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ! কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা জানতে এবং বৈষম্য ও গুজবের মতো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পড়া জরুরি; বই এখানে অন্যতম অস্ত্র। বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে বই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষ নানা কারণে বই পড়ে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়েন; চাকরিপ্রার্থী চাকরি পাওয়ার জন্য পড়েন; শিক্ষক পড়ানোর জন্য পড়ে; অবসরে অনেকে পড়েন বিনোদনের জন্য। বই সবাইকে সমানভাবে সব ধরনের সেবা দিয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলী অবশ্য বলেছেন, বই পড়া হলো চোখ বাড়াবার পন্থা। কিন্তু যাদের চোখই নেই তারা চোখ বাড়াবে কীভাবে! যাদের সাক্ষরজ্ঞান নেই, তারা চোখ থাকতেও এক প্রকার অন্ধ। গত বছরের সাক্ষরতা দিবসের (৮ সেপ্টেম্বর) হিসেবে, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসাবে এখনও দেশের অন্তত চার কোটি মানুষ নিরক্ষর। বই নিয়ে আমরা যত আলোচনা করি কিংবা বাংলা ভাষা নিয়ে যত গর্বই করি, সব মানুষকে সাক্ষর করা ছাড়া এসব আলোচনা অনর্থক নয় কি?
তার পরও যারা পড়তে পারেন, তাদের অনেকেই পড়েন না। পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে বাঙালি যে পিছিয়ে তা সৈয়দ মুজতবা আলী কয়েক দশক আগে যেভাবে বলে গেছেন তা এখনও অপ্রাসঙ্গিক নয়। তিনি বলেছেন, ‘বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না’। তবে এর মধ্যেও অনেক পাঠক আছে। বই পড়েন। বই কেনেন। সেজন্যই আমরা দেখছি, প্রতি বছর নতুন নতুন বই প্রকাশ হয়। লেখকরা বই লিখেন; প্রকাশকরাও বই প্রকাশে আগ্রহী হন। লেখক তার জ্ঞান ও সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়ে বই লিখেন। বইয়ের মধ্যে যে মণিমুক্তা লুক্কায়িত রয়েছে তা হচ্ছে লেখকের জ্ঞান, গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফসল।
লেখক তার মেধা প্রয়োগ করে বই সৃজন করেন বলেই এটি মেধাসম্পদ। বস্তুত বই দিবসের সঙ্গে এজন্যই কপিরাইটের বিষয়টি এসেছে। বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব গুরুত্বপূর্ণ বলেই তার মালিকানা নিবন্ধনের জন্য যেমন কপিরাইট আইন আছে, তেমনি দেশে সরকারি কপিরাইট অফিসও রয়েছে। সেখানে যে কেউ সৃজনশীল মেধাস্বত্বের নিবন্ধন করতে পারেন। বইয়ের ক্ষেত্রে কপিরাইট যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি লেখকের সম্মানীও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফলে কপিরাইটের পাশাপাশি লেখকের যথাযথ সম্মানীর বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে।
বই পড়া, বই প্রকাশ ও বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতেও দিবসটি ভূমিকা পালন করুক। একই সঙ্গে যারা এখনও নিরক্ষরতার অন্ধকারের মধ্যে পড়ে আছে, তাদের সে অভিশাপ থেকে উদ্ধার করে বইয়ের সাহায্যে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার মধ্যেই রয়েছে বই ও কপিরাইট দিবসের সার্থকতা।শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন
মোঃ নিয়ামতুল্লাহ
আমার চোখে দেখা একটি অরাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম আমাকে আপ্লুত করেছে। সংগঠনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর শাহজাহানপুর ইউনিয়নে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সংগঠনটির নাম ‘শাহজাহানপুর ছাত্র ঐক্য পরিষদ’। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ২০১১ সালে। তখন ইউনিয়নটিতে শিক্ষার হার ছিল একদম নিম্নপর্যায়ে। কয়েক জন শিক্ষার্থীর হাত ধরে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন’ এই স্নোগানকে সামনে রেখে, তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে আজও অবধি। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সে সময়ের রাবির মেধাবী ছাত্র ইলিয়াস হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মেধাবী ছাত্র মোফাজ্জল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক বুটেক্সের মেধাবী ছাত্র মিসবাহ উল হক, উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন ঢাবির মেধাবী শিক্ষার্থী সারোয়ার হোসেন। তাদের হাতে গড়া সংগঠনটি যেমন শিক্ষার হার বৃদ্ধি করছে, তেমন উচ্চশিক্ষার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্র তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
পিছিয়ে পড়া ইউনিয়নটি আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ‘ছাত্র ঐক্য পরিষদের’ প্রচেষ্টায় বর্তমানে ইউনিয়নটিতে বিভিন্ন মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অন্তত ৫০ জন ছাত্র অধ্যয়নরত। শিক্ষার উন্নতির পাশাপাশি সমাজও অনেকটা উন্নতি লাভ করেছে। ইউনিয়নটিতে শিক্ষানুরাগী মানুষ তৈরিতে এ সংগঠনের অবদান অনস্বীকার্য। বলাবাহুল্য, বর্তমানে ইউনিয়নের প্রতিটি ঘরে ঘরে অন্তত একজন হলেও ছাত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
যা সে সময়ে একটা ঘরে নয়, একটা গ্রামেই একজন ছাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। হুমায়ন আজাদের ভাষায়, ‘কোনো দেশের লাঙলের রূপ দেখেই বোঝা যায় ওই দেশের মেয়েরা কেমন নাচে, কবিরা কেমন কবিতা লেখেন, বিজ্ঞানীরা কী আবিষ্কার করেন, আর রাজনীতিকেরা কতোটা চুরি করে’। সুতরাং কোনো সমাজের মূল চালিকাশক্তি যদি নেতৃত্বদানে যোগ্যতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তির মাধ্যমে এবং কোন সংঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হয় (লাঙ্গলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়) তাহলে সে সমাজ ব্যবস্থার রূপরেখাও মানসম্মত হবে বলে আশা করা যায়।
ছাত্রদের নেতৃত্বদানে যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলার ভূমিকা ছাত্রবান্ধব ছাত্র সংগঠন ও সুশৃঙ্খল ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমেই সম্ভব। সমাজ পরিবর্তনে বাহন তৈরিতে, শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে, নেতৃত্বদানে যুগোপযোগী সৎ ও আদর্শবান ছাত্র তৈরিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ‘শাহজাহানপুর ছাত্র ঐক্য পরিষদ’।
এজন্যে শেরিল স্যান্ডবার্গ (চিফ অপারেশন অফিসার)-এর কথায় বলতে হয়, ‘নেতৃত্ব মানে তোমার উপস্থিতিতে অন্যরা উন্নতি করবে এবং তোমার অনুপস্থিতিতেও সেই উন্নতি বজায় থাকবে’। সুতরাং ‘ছাত্র ঐক্য পরিষদ’ যতদিন থাকবে নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও তাদের উন্নতি বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়। সমাজের প্রতিটি স্তরে যদি সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রসমাজ ভবিষ্যতে নেতৃত্বে আসে, সমাজের প্রতিটি স্তর স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হবে, যা সমাজ পরিবর্তনে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো যদি শিক্ষার জন্য, সমাজ পরিবর্তনের জন্য, নেতৃত্বদানে যোগ্যতাসম্পন্ন, সৎ ও আদর্শবান কর্মী তৈরিতে কাজ করে তাহলে আমাদের দেশটি সোনার দেশে পরিণত হবে, বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কেননা, একটি ছাত্রবান্ধব সংগঠন, একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন সমাজ পরিবর্তনের বাহন।