সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২২, ০০:০০

শিক্ষক সংকট ও শিক্ষার মান
মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষক সংকট আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই একটি সাধারণ সমস্যা। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক আছে কী নেই, না থাকলে কবে নিয়োগ হবে, এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের খুব একটা মাথাব্যথা থাকে না। শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য যতগুলো শর্ত প্রযোজ্য, মানসম্মত শিক্ষক সেগুলোর মধ্যে প্রধান। তাই সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক থাকা একান্ত জরুরি। আমাদের দেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম, শেষ হিসাব অনুযায়ী ৬৮৩টি। এগুলোতেও রয়েছে শিক্ষক সংকট। এগুলোর শিক্ষকের সংকট কাটাতে ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ২ হাজার ১৫৫ জনকে সহকারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের সুপারিশ করে ফল প্রকাশ করা হয়। এরপর পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ৩০ জানুয়ারি ২ হাজার ৬৫ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এ পদায়ন হয়েছে এলোমেলোভাবে-যেসব বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক প্রয়োজন ছিল, সেসব বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন করা হয়নি। শহর এবং ভালো যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে এমন এলাকার স্কুলগুলোতে পদের অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন করা হয়েছে। অথচ বদলি ও পদায়ন নীতিমালায় নতুন নিয়োগকৃতদের প্রথমে উপজেলার স্কুলে পদায়নের কথা বলা আছে। কিন্তু নতুন শিক্ষকদের রাজধানীর সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জেলা সদরের স্কুলে পদায়ন দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে স্বজনপ্রীতি ও ঘুস লেনদেনের অভিযোগ করেছেন অনেকে।

শহর এলাকার বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের অভিযোগ, যেসব স্কুলে শিক্ষক প্রয়োজন নেই, সেগুলোতে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন করা হয়েছে। আর যেখানে শিক্ষক সংকট রয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক দেওয়া হয়নি। কয়েক মাস আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কাছ থেকে সারা দেশের হাইস্কুলগুলো থেকে শূন্যপদের তালিকা নিলেও পদায়নে সে তালিকার তোয়াক্কা করেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছামাফিক পদায়নে শিক্ষক সংকটে থাকা সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার মান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অপরদিকে যেসব প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন দেওয়া হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর আগের শিক্ষকরা বদলি আতঙ্কে ভুগছেন। তারা বলছেন, অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন দেওয়ায় বেতনভাতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে। নতুন শিক্ষকদের নতুন করে পদায়ন দিয়ে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। বিষয়টিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা শূন্যপদের তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সে হিসাবে পদায়ন হয়নি। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া শূন্যপদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক পাওয়া যায়নি। এটি কেমন ব্যাখ্যা তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এখানে যেটি হয়েছে তা হচ্ছে ‘তেলে মাথায় তেল দেওয়া’। পদের অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়নের বিষয়ে তারা জানিয়েছেন, পদায়নের আদেশে পদ সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সমাধান দেবে। কারও কারও মতে, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শূন্যপদের তালিকা অনুসারে পদায়ন না করে বিষয়ভিত্তিক তালিকা অনুসরণ করে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন দেওয়ায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

পত্রিকায় দেখলাম শরীয়তপুরের পালংতুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে নতুন করে ১২ জন শিক্ষককে পদায়ন করা হলেও আরও ১২টি শিক্ষক পদ শূন্য আছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘নতুন ১২ জন শিক্ষক পেলেও ইংরেজি, জীববিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ১২টি পদ শূন্য থাকবে। অথচ সামাজিক বিজ্ঞানে দুজন শিক্ষক পেয়েছি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে শূন্যপদের তথ্য দিয়েছি, তারপরও কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না।’ নরসিংদী সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় ও নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ১০ জন করে শিক্ষক পদায়ন দেওয়া হয়েছে। অথচ এ প্রতিষ্ঠান দুটিতে শূন্যপদ নেই। শূন্যপদ না থাকার পরও রাজধানীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় এ দুটি প্রতিষ্ঠানে ২০ জন অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ কেন হলো তা অনেকেই অনুমান করতে পারছেন।

বদলি ও পদায়ন নীতিমালায় নতুন নিয়োগকৃতদের প্রথমে উপজেলার স্কুলে কিংবা নতুন জেলা সদরে পদায়নের কথা বলা আছে; কিন্তু নতুন শিক্ষকদের রাজধানীর সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জেলা সদরের স্কুলে পদায়ন দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের সরকারি স্কুল শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা নতুন শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুস খেয়ে তাদের পছন্দ অনুযায়ী পদায়ন করেছেন। তারা হয়তো দেখছেন সবাই এসব কাজ করে টুপাইস কামাচ্ছে, আমরা বসে থাকব কেন? মাধ্যমিকের শিক্ষক নিয়োগ সরাসরি মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে কেন? এটি থাকবে মাউশির কাছে। এখানে শক্ত নিয়মকানুন থাকবে, সেই নিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ হবে, যাতে কোনো ব্যক্তি বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে না পারে। এমনিতেই সরকারি দপ্তরে কাজের পাহাড় জমা হয়ে থাকে বছরের পর বছর, জনগণ তাদের প্রকৃত সেবাপ্রাপ্তি থেকে সব সময়ই বঞ্চিত থাকছে, সেগুলো যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের এত ইনভলভমেন্ট স্মার্ট কাজের ইঙ্গিত বহন করে না। সাধারণভাবে থানা সদরের স্কুল থেকে প্রথমত জেলা সদর, এরপর পুরোনো জেলা সদর থেকে বিভাগীয় পর্যায়ের স্কুলে শিক্ষক বদলির বিষয় বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু নতুন পদায়নের ক্ষেত্রে নিজেদের জারি করা বদলি নীতিমালা মানেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অধিদপ্তর যে তথ্য পাঠিয়েছে, সে অনুযায়ী পদায়ন হয়নি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তা অনুসরণ করেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, ‘নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের। অধিদপ্তরের দেওয়া শূন্যপদের তালিকা অনুযায়ী পদায়ন করা হয়েছে। শূন্যপদের বাইরে কাউকে পদায়ন করা হয়নি। যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে আগে থেকে যারা কর্মরত আছেন, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে।’ কোনো ঘটনা ঘটার পরে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা এ ধরনের কথাই শুনে থাকি। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা আমরা কর্মকর্তাদের কাছে শুনি না।

৩০ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে পদায়নের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানপত্র তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করবেন। পদায়নকৃত পদে অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষক কর্মরত থাকলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাৎক্ষণিকভাবে উদ্বৃত্ত শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানপত্র তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করবেন। পদায়নকৃত পদে অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষক কর্মরত থাকলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাৎক্ষণিকভাবে উদ্বৃত্ত শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদের বিপরীতে সমন্বয়ের ব্যবস্থা করবেন। এদিকে অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালকও একইকথা বলেছেন। জেলা থেকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাতে হবে। জেলা শিক্ষা অফিস মাউশিকে লিখিতভাবে তথ্যটি জানাবেন, তখন পদ সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এ জাতীয় সমাধানের কথা বলছেন শিক্ষা বিভাগের অন্য কর্মকর্তারাও। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান শিক্ষকরা কি বিষয়টি জানেন না, জেনে না থাকলে সেটিও তো একটি বিভাগীয় দুর্বলতা। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা কেন করা হয়েছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে বলেই তো জনগণ, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টি জানতে পেরেছেন। শুধু বিভাগের মধ্যে আটকা থাকলে সমাধান তো হয়ই না, বরং সমস্যা আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। সংবাদকর্মীরা এ জাতীয় কিছু সংবাদ পরিবেশন করেন বলেই তো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়, তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে।

আমাদের শিক্ষায় যে বহুমাত্রিক সংকট চলছে, শিক্ষক স্বল্পতা তার মধ্যে একটি। কী সরকারি, কী বেসরকারি প্রায় সর্বত্র একই অবস্থা। আর একটি বিষয় আমরা জানি, মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সেভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকতে হবে? এ পর্যায়ে বিজ্ঞান ও ইংরেজির শিক্ষক স্বল্পতা এখনো বিরাজ করছে। সরাসরি বিজ্ঞান ও ইংরেজির শিক্ষক পাওয়া না গেলে যেসব শিক্ষকের এসব বিষয়ে আগ্রহ আছে, তাদের একটি লেভেল টেস্ট নিয়ে বিষয়ভিত্তিক বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষের চিন্তা করার সময় কতটা আছে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

মাছুম বিল্লাহ : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়