সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট
নাহিদ মিয়া

আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার পাশাপাশি যুগোপযোগী শিক্ষা হিসেবে কারিগরি শিক্ষা অন্যতম। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হাতে-কলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা। অর্থাৎ যে শিক্ষা ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দেশের শিক্ষার্থী সমাজকে দক্ষ এবং বাস্তবসম্মত জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে করে গড়ে তোলে। সাম্প্রতিক সময়ে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব আমাদের দেশে এতোটাই বেশি, যা আমরা এমন প্রাত্যহিক জীবনেও পদে পদে অনুভব করে আসছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছোটখাটো জিনিসপত্র থেকে শুরু করে বৃহৎ কোনো মেরামত কাজেও হাতের কাছে সময়মতো লোক পাওয়া যায় না। সেসময় টাতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি অন্যের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেই তা সমাধান করে ফেলতে পারে। ভোকেশনাল এডুকেশন বা কারিগরি শিক্ষা এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি যেখানে পাস-ফেল বলে কিছু নেই। তাই পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জনের জন্য এবং একজন প্রতিযোগী হতে আপনাকে যতবার প্রয়োজন ততোবার পরীক্ষা দেওয়ার এবং নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কারিগরি শিক্ষায় তত্ত্বীয় পড়াশুনার চেয়ে বাস্তব প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে করে একজন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজের সুযোগ খুঁজে নিতে পারে। বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কারিগরি শিক্ষাকে চাকুরির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। তাই সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিযোগিতার বাজারে কারিগরি শিক্ষা যোগ্য প্রতিযোগী তৈরিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা আমরা অনেক আগে থেকেই অনুভব করতে সক্ষম হই। এ প্রেক্ষাপটে অতি সম্প্রতি শিক্ষার মান উন্নয়নে এক হাজার ৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করে। যেখানে ১০০ টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি স্কুল ও পলিটেকনিক নির্মান করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সরকার বলেছে, মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার হার ও এ শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। কারিগরি শিক্ষা গুরুত্ব পায় যখন সরকার আলাদাভাবে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড গঠন করে, এবং এ শিক্ষার জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ে দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আত্ম-কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ‘কুদরত-ই খুদা’ শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। যদিও ১৯৭৫ সালের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। অতঃপর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ ও খসড়া শিক্ষা আইন-২০১৬’ প্রণয়ণ করেন। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই উপলদ্ধি করতে পেরেছেন, যে দেশের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যত বেশি; সে দেশের জনগনের মাথাপিছু আয় তত বেশি। আর তাই তিনি বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রুপান্তর করার লক্ষ্যে ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ২০ শতাংশ করার এবং ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালে ৪০ শতাংশ করার উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। এ উদ্দ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ প্রণয়ন করা হয়। ঐ নীতিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ সচিবালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কতৃপক্ষও গঠন করা হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষের গভর্নিং বর্ডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ঠ সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৭৫টি করিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১২ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই স্থরে শিক্ষার্থী অনুপাত তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। আর তাই নতুন করে দেশে ২৩টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং উপজেলা পর্যায়ে ১০০ টি টিএসসি নির্মান করা হচ্ছে। মহিলাদের জন্য বিভাগীয় শহরে নির্মাণ করা হচ্ছে মহিলা পলিটেকনিক এবং টিএসসি।

শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই বেশ সচল। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিনত করতে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন। এর মাধ্যমে প্রয়োজন মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের দক্ষতা বাড়িয়ে দারিদ্র বিমোচন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাক্সিক্ষত গুণগত মানের দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তব কর্মক্ষেত্র থেকে প্রায়ই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। ফলে ভারতসহ বহুদেশের লোক বাংলাদেশে কাজ করছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ তরুণ, তাদের কর্মসংস্থান ও আত্ম-কর্মসংস্থানে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও দক্ষ জনবলের যথেষ্ঠ চাহিদা রয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষাকে অর্থবহ করার জন্য কারিগরি শিক্ষার আরও সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে কারিগরি শিক্ষাকে উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় গ্রামগঞ্জের মেধাবী ছেলেমেয়েরা এতে উৎসাহিত হবে। কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের জন্য আরও পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ছাত্রিদের অধিকতর বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান এবং পড়াশোনা শেষে চাকরিপ্রাপ্তি সহজতর করা প্রয়োজন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী, নতুন নতুন বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা চালু করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমানে চালু সিলেবাস গুলোকে যুগের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকীকরণ ও সংশোধন করা প্রয়োজন।

কারিগরি শিক্ষা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়। স্থানীয়ভাবে সুপারিশের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অগ্রাধিকার পায় বেশি। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নে মানসিকতা প্রয়োজন। শিক্ষক সংকট, উপকরণের অভাব, অনুন্নত কারিকুলামসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের কারিগরি শিক্ষা। এছাড়াও কারিগরির বিভিন্ন বিষয়ে বিদেশে চাহিদা থাকলেও শিক্ষার মান উন্নয়েনে আশাতীত কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। কারিগরি শিক্ষার মান নিয়ে আছে প্রশ্ন। সরকারি পলিটেকনিকে চলছে শিক্ষক সংকট, যে কয়জন শিক্ষক রয়েছেন তাদের দ্বারা ১ম শিফট ও ২য় শিফট একসাথে পাঠদান করানো অসম্ভব। ল্যাবগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই, ব্যাবহারিক ক্লাসের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, আর যাই আছে তার বেহাল দশা। একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে হয় দুই বছরে, আর ডিপ্লোমা কোর্স করতে হয় চার বছরে। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। রয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট। শুধু রয়েছে একটি মাত্র ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট)। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগের পক্ষে আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমাদের কিছু কাঠামোগত ত্রুটি রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে, যা দূর করা প্রয়োজন। আমাদের নতুন ধরনের শিক্ষায় শিক্ষকের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে,দক্ষতা অর্জন কারিগরি শিক্ষার মূল লক্ষ্য।

পরিশেষে, সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এখনই গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। একটি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে কোনো প্রকার সংকট সৃষ্টি হলে তা অত্যন্ত নেতিবাচক বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যে অভিযোগগুলো সামনে এসেছে সেগুলো আমলে নিয়ে এবং সংকট নিরসনে উদ্যোগী হতে হবে। সর্বোপরি, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান নিশ্চিত করতে ঊর্ধ্বতন মহলের সর্বাত্মক সহযোগিতা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : শিক্ষার্থী, আর্কিটেকচার এন্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন টেকনোলজি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিক ইন্সিটিটিউট।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়