প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আমার প্রিয় শিক্ষক অনেকজন। শিক্ষকরা আমার কাছে অনেক সম্মানিত মানুষ, পিতৃতুল্য। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পরিক্রমায় শিক্ষকদের ভূমিকাও ছিলো অনেক বেশি। কতোজনের কথা বলবো? কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমিও শিক্ষকদের কাছে সবসময় একটা ভালো স্পেস পেতাম (আমি এখনও জানি না সেই কারণ)। প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজন স্যারের কথা না বললে আমার গুনাহ হবে ব্যাপারটা ঠিক এমন।
শরিয়ত উল্লাহ স্যার (মানিক স্যার)
আমার প্রথম শিক্ষক শরিয়ত উল্লাহ স্যার। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সেভেন স্যারের কাছে ছিলাম আমি। সকালে আব্বা দিয়ে যেতেন স্কুলে, আমার দুপরের খাবারও আসতো স্যারের বাসায়, তাই খাওয়াও হতো ওইখানে। রাতে পড়া শেষ করে আব্বা বা কাকা নিয়ে যেতেন রাত ৯টা-১০টার মধ্যে। স্যারের বাসা স্কুলের পাশেই ছিলো। বিকেলে খেলাধুলা জে.কে. স্কুলের মাঠে করে আবার সন্ধ্যা থেকে স্যারের কাছে পড়া। স্যারের ছেলে তারেক আমার বাল্যবন্ধু। এছাড়াও ফারুক স্যারের ছেলে সুমন, সুমন সাহা, অপু, রাসেল ভাই, জনি ভাই, রূপম ভাই, বাসু দা, সঞ্জয় দা, দিদার (তারেকের ছোট ভাই) সবাই মিলে একসাথে পড়তাম। স্যারের পড়ানোর পদ্ধতি ও প্ড়া নেয়ার পদ্ধতি ছিলো আলাদা। খুব যে রাগী ছিলেন তা না, কিন্তু রাগলে অনেক শাস্তি দিতেন। অনেকগুলো বেত ছিলো স্যারের, আবার বাঁধার জন্যে দড়িও ছিলো। দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে মারতেন পরীক্ষায় খারাপ করলে কিংবা দুষ্টুমি করলে। আমাদের প্রায় গল্প শোনাতেন স্যার। অসম্ভব সুন্দর স্যারের ভয়েস। আদরও করতেন স্যার। আবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাতের বেলায় চুপিচুপি দেখে আসতেন আমরা বাসায় কি করি ছুটির দিনগুলোতে। এই ছিলেন মানিক স্যার। আমার কাছে আজও মানিক স্যার অনেক ভয়ানাক এক শিক্ষক, দেখা হলে এখনও বুক কাঁপে। ভয় পাই। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে স্যারের মধ্যে যে একটা পিতৃ¯েœহ ছিলো। তা এখন ভালো করে উপলব্ধি করতে পারি। ইস্ আমার ছেলেকে যদি স্যারের কাছে পড়াতে পারতাম, তাহলে ওর হাতেখড়িটাও ভালো হতো। স্যার জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরষ্কার পেয়েছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্কাউটের একজন অন্যতম পুরষ্কারপ্রাপ্ত লিডার ট্রেইনার (এই সংখ্যাটা জাতীয় পর্যায়েই অনেক কম) আল্লাহ্ আমার স্যারকে সবসময় সুস্থ রাখুক।
আনোয়ার স্যার
আনোয়ার স্যার, ট্যেকনিক্যাল হাই স্কুলের সায়েন্স ও স্পোর্টস-এর শিক্ষক। আমার অন্যতম একজন প্রিয় শিক্ষক। আমাকে নিজের ছেলে হিসেবে দেখতেন। কোথাও পাঠালে বলে দিতেন আমার ছেলেকে পাঠালাম। স্কাউটিং করার কারণে স্যারের খুব কাছে আসা। আমি পেট্রল লীডার ছিলাম। স্যার আমাকে অনেক বিশ্বাসও করতেন। স্যারের রুমের এক সেট চাবি আমার কাছে থাকতো। কাজ করতে করতে কোনো দিন দেরি হয়ে গেলে স্যার আমাকে বাসায় নিয়ে যেতেন। তখন আজিম ভাইয়ের সাথে থাকতাম আমি। খালাম্মাও অনেক আদর করতেন। স্যারও বাংলাদেশ স্কাউটের একজন সিনিয়র লিডার ট্রেইনার (এলটি) ছিলেন। স্যারের কল্যাণে আমার স্কাউটের বেসিক ট্রেনিং করে ইউনিট লিডার হওয়া। মাত্র ১৯ বছর বয়সে আমি ইউনিট লিডার হিসেবে টেকনিক্যাল হাইস্কুলের ইউনিটকে নিয়ে জাম্মুরীতে অংশগ্রহণ করি। কুমিল্লার লালমাইতে আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ট্রেনিং-এর জন্যে যখন পাঠালেন তিনি বলে রেখেছিলেন তার ছেলে আসবে ট্রেনিং-এ। তাই সবাই ভাবছিলেন আমি স্যারের সত্যিকারেই ছেলে, আজও মনে পড়ে সেই কথা। পরবর্তীতে জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে রিটায়ার্ড করেছিলেন স্যার। কিন্তু খুব বেশি বয়স না হলে আল্লাহ্র ডাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন আমার প্রিয় স্যার, আনোয়ার স্যার। আল্লাহ্ স্যার-এর বেহেশত নসিব করুক।
ড. মো. নাছিম আখতার
ইন্টারমিডিয়েটের পর গাজীপুরে পাড়ি দিলাম কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশনের জন্যে। এমআইএসটিতে পড়ি আমি তখন। সেকেন্ড ইয়ারে অপারেটিং সিস্টেমের ক্লাস নিতে আসলেন পার্টটাইম টিচার নাছিম স্যার। সুদূর ঢাকা থেকে। স্যার মনে হয় তখন আইএসটিটিতে পড়াতেন। সোভিয়েত রাশিয়ার ইউক্রেনের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার্স করা আমার এ প্রিয় শিক্ষক। পরবর্তীতে স্যার পিএইচডি ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যারের কথা শুনতাম। আইটিতে পড়াশোনা করাটা স্যারের কল্যাণে একটা স্বপ্নে পরিণত হলো। ছাত্রদের সাথে স্যার খুব ভালো মিশতে পারতেন। আমাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলাসহ নানা ইনডোর গেমস্ খেলতেন স্যার। ইউক্রেনের কত গল্প স্যার আমাদের শোনাতেন। উন্নত বিশ্বে আইটি এডুকেশনে কি কি হয় আমাদের বলতেন। পড়াশোনাটাকে একটা আনন্দের বিষয় বানিয়ে ফেললেন স্যার। আমাদের অনুরোধে স্যারকে একরকম জোর করে ডুয়েটে অ্যাপ্লাই করালাম আমরা কয়েকজন, বিশেষ করে আমি আর সাগর। স্যারের চাকুরি হয়েও গেলো। ব্যাস শুরু হলো আরেক জীবন। গাজীপুরে স্যার ও আমরা কয়েকজন একই বিল্ডিং-এ থাকতাম। ভাবী বাপের বাড়িতে গেলে স্যার খেতেন আমাদের সাথে। গোটা খাসি জবাই করে মাংস কিনে নিয়ে আসা, কিংবা স্যার রাজশাহী থেকে লিচু আর দই নিয়ে আসা, আম নিয়ে আসা। স্যারের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। আবার স্যার তার পুরো ফ্যামিলি নিয়ে নোয়াখালীতে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। হাজার হাজার স্মৃতি কয়টা বলে শেষ করবো? শিক্ষকের চেয়েও বেশি ছিলেন আমাদের বন্ধু হিসেবে। আমাদেরকে আপনি করে বলতেন। খুব পরিশ্রমী এই মানুষটি তাঁর পরিশ্রমের মূল্যও পেয়েছেন জীবনে। হয়েছেন ডুয়েটের প্রফেসর, সিএসই ডিপার্টমেন্টের হেড এবং ইলেক্ট্রনিক্স অনুষদের ডীন। সাফল্যে চূড়ায় উঠে আসেন গত বছর। এ সম্মানীয় মানুষকে সম্মানিত করলেন বাংলাদেশ সরকার। স্যারকে নবগঠিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নির্বাচিত করলেন। স্যার এখনও আমাদের গর্ব। আমি স্যারের আরো উন্নতি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
এছাড়াও বশির স্যার, মূর্তুজা স্যার, মতিলাল স্যার, নূরুল্লাহ স্যার, বারী স্যার, খোরশেদ স্যার, কিবরিয়া স্যার, হানিফ স্যার, হাবিব উল্লাহ স্যার, জুয়েল স্যার, পার্থ সালাহউদ্দিন স্যার, কামাল স্যার, শোয়েব স্যার, মাহবুব স্যার সবার সুস্বাস্থ্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।