প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
সমাজের একটি গতিশীল প্রক্রিয়া হলো শিক্ষা, যার সাথে সমাজের সব উপাদানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই সমাজবদ্ধতার প্রাগৈতিহাসিক জীবনেও শিক্ষার অস্তিত্ব ছিল, যখন মানুষ বন্য ফলমূল, পশু শিকার করে জীবিকার সন্ধান করতো। আর আধুনিক যুগে তার পরিধি প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বৃহৎ চেতনায় এই শিক্ষা হলো ক্রম উন্নতির পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তিকে পরিবেশের সাথে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সংগতি বিধানে সহায়তা করে থাকে। আর সেখানেই আসে দক্ষতার প্রসঙ্গ এবং সেই শিক্ষার সাথে দক্ষতার সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন।
ব্যাপক চেতনায় শিক্ষা মূলত দক্ষতানির্ভর। জাতীয় উন্নয়নের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো দক্ষ জনশক্তি। আর জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তরের অন্যতম মাধ্যমে হলো কারিগরি শিক্ষা। এই শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার বাইরে শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তি নির্ভর, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণদানসহ নানা আত্মকর্মসংস্থানমূলক জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে থাকে।
দক্ষতাই আধুনিকতার পরিচায়ক। দক্ষতাবিহীন কর্ম নিষ্প্রয়োজন। আর আধুনিক বিশ্ব হলো প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে দক্ষতা ব্যতীত উন্নয়নের চিন্তা নিরর্থক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নবতর আবিষ্কারের ফলে বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন কৌশল ও পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিনিয়তই খুবই সচেষ্টরূপে বহির্বিশ্বে বাণিজ্য, যোগাযোগ, পরিবহন ও জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও জনসংখ্যায় বিশ্বে তার অবস্থান অষ্টম। কাজেই আমাদের এই বিশাল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হলে দেশের উন্নয়নের পথ অনেকাংশেই সহজ হয়ে যাবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার লক্ষ্যই হলো দেশ ও বিদেশের চাহিদা বিবেচনায় রেখে যথাযথ প্রযুক্তিগত জ্ঞানদানের মাধ্যমে মানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি দ্রুত সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ ও শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দ্রুত দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৯) মতে, এদেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মোট ৭০৫২টি বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১০০১৭৭ জন।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচতে কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের জুড়ি নেই। বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। তবে আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। তাছাড়াও শিক্ষিত বেকার বাড়ার পাশাপাশি মহামারি করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় বিদেশফেরত শ্রমশক্তি এই বেকারত্বের তালিকা আরও বেশি দীর্ঘতর করছে। অথচ শুধু প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে তারা নিজ দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিযুক্ত হতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে শিল্প কারখানা চলমান রাখার স্বার্থে দেশে প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী না পাওয়া গেলেও বিদেশ থেকে বহু অর্থে দক্ষ কর্মী নিয়োজিত করতে বাধ্য হয়ে পড়ছে নিয়োগকর্তারা। আর কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বটা মূলত এখানেই জানান দেয়। তবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে তার গুরুত্ব অসামান্য হলেও আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষা নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বর্তমানে দেশে কারিগরি ডিপ্লোমা ও ট্রেড কোর্সগুলোতে ভর্তির কার্যক্রম চললেও তার প্রচার হচ্ছে খুবই সামান্য। প্রচারের অভাবেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারছে না। তাছাড়া আমাদের তরুণ যুবসমাজের মাঝে কাজের প্রতি অবহেলা ও কাজকে ছোট করে দেখার প্রবণতা প্রখর। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা যেন তাদের কাছে নিতান্তই অবজ্ঞার বিষয়। অথচ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার পদতলেই দেশ বেকারত্বের কালো ছায়ায় নিমজ্জিত হচ্ছে। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ স্নাতকই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনের মাঝে একজনের নামই বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত।
বর্তমানে দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার অধীনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক কম। অথচ জাপান, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের শিক্ষায় দেশের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক বা তারও বেশি অধ্যয়নরত থাকে। আবার ¯œাতক প্রকৌশলীর কর্মপরিকল্পনা ও কার্যাবলিকে যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও শ্রমপোযোগী জনবল। অথচ বাংলাদেশে স্নাতক প্রকৌশলীর তুলনায় এই দুই শ্রেণির জনগোষ্ঠীর হার অনেক কম। এসব সমস্যা ছাড়াও কারিগরি শিক্ষায় প্রচলিত বহু পুরনো পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষকের অপ্রতুলতা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক শিক্ষা ৬০ শতাংশ বলা হলেও তার কার্যকারিতা না থাকা তথা গতানুগতিক ধারার পাঠদান অব্যাহত রাখা, ব্যবহারিক শিক্ষার আদলে অর্থের বিনিময়ে সনদ লাভ, একজনের নামে অন্যজনের পরীক্ষা দেওয়ার মতো নানা অভিযোগ রয়েছে এদেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে।
বর্তমানে কোভিড-১৯ এর করালগ্রাসে পর্যুদস্ত দেশের এই বিশাল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার নিমিত্তে কারিগরি শিক্ষার উপর গভীর মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। ঢালাওভাবে উচ্চশিক্ষার দিকে না ঝুঁকে বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার পথে পা বাড়ালে আমাদের দেশের বিরাট সংখ্যক তরুণদের নিজস্ব কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনাময় পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। কারিগরি শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, প্রয়োজনীয় প্রচারণা, মানসম্মত ও যুগোপযোগী কারিকুলামের উপস্থিতি খুবই জরুরি। এ শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা প্রয়োজন।
ডিপ্লোমা তথা মধ্যম স্তরের প্রকৌশলীদের উপযুক্ত সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণ এবং স্নাতক প্রকৌশলীর পাশাপাশি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও শ্রমপোযোগী শ্রেণির যথাযথ মূল্যায়ন, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধানিশ্চিত আর সেসঙ্গে তাদের উন্নয়নের ধারায় অধিক হারে সম্পৃক্ত করলে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি সাধন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন কর্মীদের স্থলে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তি বহির্বিশ্বে রপ্তানি করলে নিসন্দেহে তা পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে এবং দেশের অর্থনীতির পথকে আরও প্রসারিত করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।