সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

গবেষণার উন্নয়নে যা করতে হবে
ড. মো. নাছিম আখতার

গ্লোবাল নলেজ ইনডেস্ক (জিকেআই) ২০২০ সালের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সবার পেছনে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চার বছর পর স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভিয়েতনাম এই তালিকার ৬৬তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম অবস্থানে আছে। সূচক তৈরিতে সাতটি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। যথাÑপ্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সাধারণ সহায়ক পরিবেশ। ১০০ নম্বরের সূচকে বাংলাদেশ প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় সেক্টরে ৪৩.৯ স্কোর পেয়েছে। প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বাংলাদেশের স্কোর ৪৯। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা সেক্টরে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নাজুক। এই সেক্টরে বাংলাদেশের স্কোর ২৪.১। গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন খাতে বাংলাদেশের স্কোর আরো কম, মাত্র ১৬.৪। আইসিটি সেক্টরে স্কোর ৪৩.১, অর্থনৈতিক সেক্টরে ৩১.৫ এবং সাধারণ সহায়ক পরিবেশে ৪৬.৪। এমন অবস্থা সৃষ্টির কারণগুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো ধাপভিত্তিক বিশ্লেষণ করা জরুরি।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সূতিকাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় যে ভিত্তি জ্ঞানের দরকার তার মজবুত ভিত্তি গড়ে ওঠে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে। গবেষণায় উন্নতিকল্পে গবেষণার ধাপগুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে প্রথম কাজ হলো বিদ্যমান জ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপরে সম্যক জ্ঞানার্জন এবং ওই জ্ঞান ও প্রযুক্তির অসুবিধাগুলো নিরূপণ। সর্বশেষে এক বা একাধিক অসুবিধা দূর করে জ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন। এই কাজটি করার জন্য মূল কর্মবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি ছাত্রদের গবেষণার সুপারভাইজার, তাঁর কাজ হলো ছাত্রদের গবেষণার বিষয়টি সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখা এবং শিক্ষার্থীকে উৎসাহ প্রদান করা। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শহরের কিছুটা বাইরে অবস্থিত। শিক্ষকরা তাঁদের পরিবারের সুবিধার্থে শহরে অবস্থান করেন এবং অফিস টাইম ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত মোট আট ঘণ্টা শহর থেকে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস করেন। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সকাল ৮টায় অফিসে পৌঁছতে হয়তো শিক্ষকদের যাত্রা শুরু করতে হয় ভোর ৫টায়। অফিস ছুটির পর ট্রাফিক জ্যাম অতিক্রম করে বাসায় পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা বেজে যায়। এরপর দীর্ঘ যাত্রার ধকল কাটিয়ে খাওয়ার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। আবার সকাল ৫টায় বাস ধরার প্রস্তুতি। এতে সম্মানিত শিক্ষকরা যাতায়াতেই অনেক কর্মঘণ্টা ও প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলে ছাত্রদের সশরীরে উৎসাহ প্রদান এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, যা ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করবেÍএমন কিছু করার সুযোগ প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সীমিত হয়ে পড়ে।

বিদেশে যখন পিএইচডি করি, আমার একটি অমীমাংসিত সমস্যা নিয়ে সুপারভাইজারের কাছে বিকেল ৩টায় গেলাম। দাপ্তরিক কাজ থাকায় সন্ধ্যা ৭টায় তিনি আমাকে সময় দিতে পারলেন। দুজন একসঙ্গে বসে রাত ২টায় সমস্যাটির সমাধান হলো। সমস্যাটি ছিল আমার কাজের একটি গাণিতিক সূত্র তৈরি। রাত ২টা বলে পাতাল রেল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজের গাড়িতে করে আমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিলেন। ঘটনাটি আমার সারা জীবন মনে থাকবে। শিক্ষকরা এমন ছাত্রবান্ধব হলে গবেষণা এগিয়ে যাবেই। প্রকৃতপক্ষে অফিস সময়ের পর নিরিবিলি সময় গবেষণার জন্য উত্তম। কারণ গবেষণা হলো শান্ত মস্তিষ্কের একাগ্র চিন্তার প্রতিফলন। তাই গবেষণার উন্নয়নে বাইরের দেশের মতো সন্ধ্যার পরও কাজ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। মালয়েশিয়ায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় দেখলাম সেখানে স্নাতকোত্তর গবেষণা ল্যাবে বিশ্রাম ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে করতে গবেষক যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে সেখানেই বিশ্রাম নিতে পারবেন। খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ আর গরম করার জন্য মাইক্রোওভেন আছে। নিরবচ্ছিন্ন চিন্তার ফলে মাথা ক্লান্ত হয়, দ্রুত ক্ষুধা পায়। গবেষকদের এই বিষয়গুলো বিবেচনা করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

প্রসিদ্ধ জার্নাল ‘ন্যাচারে’ এমআইটির একজন অধ্যাপকের শুধু কৌতূহলবশত একটি চিন্তার অঙ্কীয় বিশ্লেষণে একটি বিশ্বমানের গবেষণা নিবন্ধ হয়েছে; এমনকি ওই জার্নালটির প্রচ্ছদও নির্বাচিত করা হয় ওই গবেষণাকে ঘিরে। গবেষণাটি ছিল অধ্যাপকের পোষা বিড়াল নিয়ে। বিড়ালটি কিভাবে তরল দ্রব্য জিহ্বা দিয়ে পান করেÍএটা নিয়ে তিনি আগ্রহী হলেন এবং উচ্চ গতিসম্পন্ন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন যে তাঁর বিড়ালটির পানীয় দ্রব্য গ্রহণের সময় জিহ্বার ছোঁয়া লাগে না। কিন্তু জিহ্বা দ্রুত নাড়ানোর ফলে যে শক্তির উদ্ভব হয়, তার আকর্ষণেই তরল দ্রব্য জিহ্বার সঙ্গে উঠে আসে। ওই অধ্যাপক ছিলেন জাঁদরেল গণিতবিদ। তিনি এই বিষয়টি অবলোকন করার পর বিড়ালজাতীয় প্রাণীর তরল দ্রব্য গ্রহণের সঙ্গে ওই প্রাণীর ওজনের একটি সম্পর্ক বের করলেন। তিনি গাণিতিকভাবে দেখালেন তরল ওপরে তোলার উদ্ভূত শক্তি প্রাণীর ওজনের সঙ্গে সমানুপাতিক। গল্পটি এ জন্য বললামÍঅঙ্কের অধ্যাপক হয়েও শুধু কৌতূহলবশত একটি প্রবন্ধ তৈরি করলেন এবং তা ন্যাচার জার্নালে মুদ্রিত হলো। কিন্তু আমাদের দেশে একজন অধ্যাপক যদি তাঁর ফিল্ড ছেড়ে অন্য কোনো ফিল্ডে গবেষণার জন্য চিন্তা করেন, তবে তা আমরা ভালো চোখে তো দেখিই না, বরং তাঁর সমালোচনায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠি। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে গবেষণামুখী জাতি। গবেষণামুখী জাতি গড়ার আরো একটি প্রতিবন্ধকতা হলো অঙ্কের গভীর জ্ঞানের অভাব। স্কুল ও কলেজে অঙ্কের জ্ঞানকে শাণিত করা দরকার। অঙ্কের জ্ঞানকে শাণিত করার লক্ষ্যে অনুসরণ করতে হবে সেই সব দেশকে, যারা অঙ্কে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীন, জাপান, কোরিয়া ও রাশিয়ার কথা বলা যেতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধু নয়, যেকোনো ক্ষেত্রে ভালো করার জন্য অঙ্কে গভীর জ্ঞানের বিকল্প নেই। আমেরিকানরা বর্তমান সময়ে উন্নত জাতি হলেও অঙ্কের ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়াকে অনুসরণ করতে একটুও কার্পণ্য করছে না। এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকায় চালু হয়েছে স্টুডিও অব এনগেজিং ম্যাথ, রাশিয়ান স্কুল অব ম্যাথমেটিক্স ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আমেরিকান স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যে ভীষণ সাড়া ফেলেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? গণিতের উৎকর্ষ সাধনের জন্য আমাদেরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতির ভাষা হলো অঙ্ক। এই ভাষাকে অনুধাবন করেই উন্মোচন করতে হবে প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মা-ের রহস্য। তবেই ঘটবে গবেষণার প্রকৃত উন্নয়ন।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়