প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। সমসাময়িক সময় ও বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষিত জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবানুগ, কর্মমুখী ও যুগোপযোগী করে তুলবার সর্বাত্মক সংস্কার তৎপরতা এখন তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে। স্কুলে পড়াকালীন প্রাতিষ্ঠানিক নৈপুণ্যের পাশাপাশি ছিলেন শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক। একজন আবৃত্তিকার হিসেবেও সুনাম রয়েছে তাঁর। পরিশীলিত বাচনভঙ্গি ও বক্তৃতা-বিবৃতির জন্যেও তিনি অনেকের কাছে অনুকরণযোগ্য। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে, সন্ধানীর সম্পাদক হিসেবে, ডাক্তার হিসেবে মানুষকে নিবিড়ভাবে সেবা দেয়ার যে শিক্ষা তিনি অর্জন করেছেন, তার ইতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত হয় মন্ত্রী হিসেবে ডাঃ দীপু মনির প্রশাসনিক কাজ, রাজনৈতিক চর্চা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণে।
মেধাবী দীপু মনি শৈশবেই পেয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের নেতা-কর্মীর ¯েœহ-সান্নিধ্য। পিতার কাছে তিনি যেমন রাজনৈতিক দীক্ষা পেয়েছেন তেমনি পিতার সাহচর্যে আন্দোলন-সংগ্রামও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে বরণ করতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে পিতা এমএ ওয়াদুদের সাথে তিনিও বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই দিনের বর্ণনা করতে গিয়ে ডাঃ দীপু মনি একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘নেত্রী প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রকৃতির কান্নাকে ছাপিয়ে তাঁর কান্নাভেজা বক্তব্য রাখলেন। সারা বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবী যেনো কাঁদছিলো। অঝোর ধারায়।’
২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পর অনেক রাজনীতিক আত্মগোপন করলেও ডাঃ দীপু মনি রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। সে সময়ে তিনি কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুকন্যার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন এবং শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম কা-ারি ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের পাশে থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর স্বামী তৌফিক নাওয়াজ তখন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী। আইনি লড়াইয়ে শেখ হাসিনাকে মুক্তির ক্ষেত্রেও স্বামীর পাশে থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। উল্লেখ্য, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ডাঃ দীপু মনিও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক (২০০৪ সাল থেকে) ছিলেন।
হলি ক্রস স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স এবং লন্ডন ও হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ডাঃ দীপু মনি অসুস্থ স্বামীর সেবা, সংসারের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, রাজনীতি ও মন্ত্রীত্বের বিশাল কাজের মধ্যেও নিয়মিত পড়াশোনা করেন। ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও শিক্ষা নিয়ে নিয়ত ভাবেন। অসহায় ও গরিবদের চিকিৎসার জন্যে ফ্রি ফাইডে ক্লিনিক কর্মসূচিও তিনি বাস্তবায়ন করছেন। নারী উন্নয়ন, মানবাধিকার, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে ‘মাদার তেরেসা’ আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তিনি পেয়েছেন গৌরবজনক স্বীকৃতি ও পুরস্কার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সমুদ্রসীমা জয়ে তাঁর অগ্রগণ্য ভূমিকা রয়েছে। লেখক, শিক্ষক, পরামর্শক, গবেষক ও আন্তজার্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমন্বয়ক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান।
ডাঃ দীপু মনির মা রহিমা খাতুন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এমএ ওয়াদুদ তাঁর পিতা। ভাষাবীর, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক এমএ ওয়াদুদ নীতিবান, আপসহীন, নিঃস্বার্থ ও দেশপ্রেমি রাজনীতিবিদ হিসেবে স্বনামধন্য। তিনি কন্যা দীপু মনিকে উৎসাহ-প্রেরণা দেয়ার পাশাপাশি শিখিয়েছেন মানবিক বাস্তবতার নানাবিধ পাঠ। নিজের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও কন্যাকে প্রথমে রিকশায়, তারপর হেঁটে হেঁটে কলাবাগান থেকে হলি ক্রস স্কুলে যাওয়া-আসার শিক্ষাও দিয়েছেন তিনি। একমাত্র কন্যার তের বছর বয়সে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো, ‘...ও বড় হয়ে ডাক্তার হবে। দীপু মনি যদি আর কারও নাম থেকেও থাকে ডাক্তার দীপু মনি শুধু একজনই হবে। ও রাজনীতি করবে। সবাই ওকে এক নামে চিনবে।’
ডাঃ দীপু মনি পিতার স্বপ্ন পূরণ করেছেন এবং জীবনের সকল স্তরে পিতাকে ধ্রুবতারা হিসেবে লালন করছেন। তাঁর ভাষায়, “ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ। আমার বাবা। আব্বু। আমার প্রতিদিনের পথচলার প্রেরণা। আমার ভাবনা-চিন্তা, ধ্যান-ধারণার গতিপ্রকৃতি গড়ে দিয়েছেন তিনি সেই শৈশব আর কৈশোরে। চেয়েছেন বাঙালির শুদ্ধ জীবনবোধ আর চিরন্তন মূল্যবোধকে আমার চিন্তায়, জীবনবোধে গ্রোথিত করে দিতে। চেয়েছেন ‘দেশসেবা আর জনসেবার মহান ব্রতই রাজনীতি’, রাজনীতিকের জীবন ত্যাগের ও সেবার, ভোগের নয়’এই দীক্ষায় দীক্ষিত করতে। ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন ভালোবাসা গ্রহণ করতে। সাহস, ধৈর্য্য, আদর্শের প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। কতটুকু গ্রহণ করতে, শিখতে, আত্মস্থ করতে পেরেছি জানি না। তবে ‘নয়ন সমুখে’ তিনি না থাকলেও মন আর চিন্তার মধ্যে তাঁর ‘নিত্য আসা যাওয়া’র মধ্য দিয়ে আমাকে পথ দেখান তিনি ধ্রুবতারার মতো নিত্যদিন।”
বর্তমানে ডাঃ দীপু মনিও অনেকের কাছে অনুকরণীয় ধ্রুবতারা। তাঁর বিনয়, সংযম, অনাড়ম্বর জীবন, বিবেচনাবোধ ও উদারতাও আদর্শস্বরূপ। তাঁর মতো বিজ্ঞ, দূরদর্শী ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব যে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী সেটাও আমাদের জন্যে গৌরবের। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী, যিনি শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তনে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং নতুন প্রজন্মকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় যথাযোগ্য করতেÑচতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে স্বপ্ন, কর্ম ও পরিকল্পনার কথা বলছেন। তাঁর কর্মশক্তি, উদ্যোগ ও ভবিষ্যসূচনায় দেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকও আলোকিত প্রজন্মের স্বপ্ন দেখছেন। ১৯৬৫ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ডাঃ দীপু মনির জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ড. মুহম্মদ মনিরুল হক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।