রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : গৌরবের শতবর্ষ
রহিমা আক্তার মৌ

১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর বয়সে পা দিয়েছে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে মুসলমান সংখ্যা গুরু পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের মানুষের মধ্যে এক নতুন আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচ- বিরোধিতার মুখে এ বিভক্তি রদ করা হয়। ফলে এ অঞ্চলের মুসলমানদের মনে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অতঃপর মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করা হলে বঙ্গভঙ্গ রদের রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অবহেলিত পূর্ববঙ্গে শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারে নবজাগরণের সৃষ্টি করে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায় সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদেরও ফল হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা-দীক্ষা আর অর্থনীতিতে এ অঞ্চল ছিলো পিছিয়ে। বঙ্গভঙ্গের পর অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ স্থানীয় মুসলিম নেতাদের দাবি ছিলো ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ পূববঙ্গ সফরে আসেন ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ওই বছরের ডিসেম্বরেই সেটা অনুমোদন পায়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দেয়।

১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় পাস হয় ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নম্বর-১৩) ১৯২০’। ওই বছরের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল বিলে সম্মতি দেন। আর এই আইনের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্য ও গৌরবের স্মারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্রিটিশ রাজকোষে অর্থাভাব ইত্যাদি প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং ৩টি ছাত্রাবাস নিয়ে পথচলা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান ড. পিজে হার্টস। তিনি এই দায়িত্বে আসার আগে ১৭ বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। শিক্ষকদের মাঝে কলা বিভাগের ২৮ জন, বিজ্ঞান বিভাগের ১৭ জন এবং আইন বিভাগের ১৫ জন শিক্ষক ছিলেন। হলগুলোর মধ্যে ছিলÑঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল ও মুসলিম হল (বর্তমান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল)। প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের কোনো না কোনো আবাসিক হলে থাকতে হতো। প্রথমেই শুরু হয় অনার্স তিন বছরের কোর্স নিয়ে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফসি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জিএইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডাব্লিউ এ জেনকিনস, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, স্যার এএফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিখ্যাত ও খ্যাতনামা ব্যক্তিরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্যেন বোসের কারণে সারাবিশ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি কার্জন হলের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে ১৯২৪ সালে কোয়ান্টাম সংখ্যায়ন আবিস্কার করে বিজ্ঞান জগতে হৈচৈ ফেলে দেন। বিজ্ঞানী কেএস কৃষ্ণান ও সতীশ রঞ্জন খাস্তগীরের কর্মস্থল ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার ৫ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সফরে আসেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তিনি কার্জন হলে দুটি বক্তৃতা করেন। পরক্ষণে সেই বক্তৃতাগুলো কবিগুরুর সেরা বক্তৃতা হয়।

ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যময় রমনা এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবন এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম দিকে মুসলিম শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যা ছিলো নগণ্য। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মুসলিম শিক্ষক ও ছাত্রের সরব উপস্থিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্থক করে তোলে। আমাদের ভাষা, কৃষ্টি আর সংস্কৃতি রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই সর্বপ্রথম মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলে। মাতৃভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র ইতিহাস তুলে ধরে। এভাবে ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। অবশ্য এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কর্মচারীদের কঠিন মূল্য দিতে হয়। তাদের রক্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ লাল হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শ্মশানে পরিণত হয়।

এদেশে শিক্ষা প্রসারে, বিশেষ করে নারী শিক্ষা প্রসারে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষে, মানবসম্পদ উন্নয়নে, মুক্ত বুদ্ধিচর্চায়, সংস্কৃতি বিকাশে, ক্রীড়া চর্চায়, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। জাতির অনেক অর্জন এসেছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো অগ্রগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে ১৯৬১ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খান অর্ডিন্যান্স জারি করে। ষাটের দশক থেকে ওই অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবি শিক্ষকদের। স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ওই অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার ১৯৭৩ জারি করে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান ৯৪ বছরের মাথায় এসে ১৯৭৩ সালের অর্ডার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি অনুষদ, ৫১টি বিভাগ, ৯টি ইনস্টিটিউট এবং ৩৩টি গবেষণা কেন্দ্রসহ ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্যে ২০টি আবাসিক হল ও হোস্টেল রয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি হলেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ২০০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯(২) ধারা বলে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে ভিসি হিসেবে সাময়িক দায়িত্ব দেন। ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম ভিসি।

এই বছরও দিবসটি উপলক্ষে রয়েছে নানা আয়োজন। শোভাযাত্রা-আলোচনা সভাসহ অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বর্ণিল সাজবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এক কথায় যে কোনো বড় আন্দোলনের সূচনা হয় দেশের এই বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির কালো ছায়া শিক্ষার্থীদের জন্যে অনেক সময় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্ররাজনীতি আগেও ছিলো কিন্তু ইদানীং তার মাঝে অপরাজনীতি প্রবেশ করায় আতঙ্ক কাজ করছে। বৃহৎ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অপরাজনীতি বিদায় নেবে সুষ্ঠু রাজনীতির পরিচর্যা হবে এটাই সাধারণ শিক্ষার্থীসহ জনগণের দাবি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়