প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
জন্ম আর মৃত্যুর দুটো দ্বার চির শাশ্বত। জন্মের দ্বার দিয়ে যার পৃথিবীর প্রপঞ্চে প্রবেশ, মৃত্যুর দ্বার দিয়ে তার চির প্রস্থান। মাঝখানের অতি ক্ষীণ এই বিস্তারকেই আমরা বলি জীবন। মৃত্যু যখন প্রকৃতই দুয়ারে আসে তখন কোনো চিকিৎসকই তা ঠেকাতে পারে না। তেমনি যে দুহাতে জীবনের সমুদয় আয়োজনে ভরিয়ে তুলেছিলো পার্থিবতাকে, সে দুহাত খালি নিয়ে চলে যেতে হয় মহাপ্রস্থানের নির্মম লগনে। নিকটজনের বেদনার সুরে কিছুকালের জন্যে বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও সময় তাকে প্রশমিত করে দেয় কালের নিত্য যাত্রায়। এই ক্ষণিক নিবাসেও কেউ কেউ আপন ব্যবহার বা কর্মে নিজেকে স্মরণের আভরণে বাঁচিয়ে রাখেন নশ্বর নরকূলে। সদ্য প্রয়াত সুশিক্ষক সুরজিৎ চক্রবর্তী তেমনই এক জীবনের তরী বাওয়া মাঝি।
তিনি পৈতাধারী ব্রাহ্মণ হলেও তাঁর সত্যিকারের ব্রহ্মত্ব ছিলো বিদ্যায়, প্রজ্ঞায় ও সংস্কৃতিতে। তিনি জ্বালিয়ে তুলেছেন অসংখ্য ছাত্রের আঁধার জীবনের দীপ। বাকিলা হতে দ্বারকানাথে এসে তিনি হয়ে ওঠেন আরও শাণিত, আরও নিবেদিত। গণিতের মতো কঠিন বিদ্যাকে তিনি চকের ডগায় এনে গড়ে দিতেন শিক্ষার্থীর জীবন। শিল্পকলাকে নিজের জীবনের সরোবরে পদ্মজ্ঞানে ফুটিয়ে তুলেছেন নান্দনিকভাবে। তিনি ছিলেন বড্ড বনেদী তবল শিল্পী। স্থানীয় বড় বড় শিল্পীদের সাথে তাঁর তবলা সঙ্গত হতো নির্ভুল শুদ্ধতায়। সুদীর্ঘ সময় ধরে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি সাজিয়ে দিয়েছেন অনেকের জীবন। পান মুখে আপন ছন্দে-গতিতে তিনি চলেছেন হেঁটে হেঁটে না ধীরে, না দ্রুত; এ ছবি প্রতিনিয়ত ধরা পড়তো চোখে জেএম সেনগুপ্ত সড়কের ঋজু প্রবাহ ধরে। দুহাজার পনের সালে যন্ত্রসঙ্গীতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা নিয়ে তিনি সম্মানিত করেছেন এর প্রচলনকে।
অন্যের জীবন যিনি গড়ে তুলেছেন চকের ডগায় আর তবলার বোলে, তিনি নিজের জন্যে ছিলেন উদাসীন। কলিযুগে এটাই স্বাভাবিক। যাপিত জীবনের উদরাগ্নির প্রশমন ভাবতে ভাবতেই চিতাগ্নির শিখায় মানুষ হয়ে ওঠে গগনের তারা। তাঁর সাথে আমার পরিচয় পনের বছরের মতো। শিল্পকলা কিংবা বিজয় মেলার মঞ্চ ছাড়াও কখনো কখনো আমার চেম্বারে যাওয়া-আসার পথে তাঁর সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হতো। সুরধ্বনির ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠানে কোনো এক শিশু শিক্ষার্থীর সাথে সঙ্গত করতে করতেই তাঁর সাথে আমার শুরু হয় আলাপের মাধুরী। সেই হাতের কসরত সেদিন জানিয়ে দিয়েছিল, বয়স প্রদর্শনী কেড়ে নিলেও পারঙ্গমতা কাড়তে পারেনি।
দুহাজার কুড়ি সালে আমার বড় ছেলের জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম একজন জাদুকর গণিত শিক্ষক। ছেলেদের স্কুল ইংরেজি ভার্সন হলেও আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম গণিতকে তার কাছে বাংলায় উপাদেয় করে তুলতে। তিনি অবশ্য বেশি সময় পাননি। কোভিডের কারণে নিষেধাজ্ঞা আসায় দুমাসের মতো পড়ানোর পর তাঁকে গৃহে অন্তরীণ হতে হয় সামাজিক ব্যবধান বজায় রাখার শর্তে। তবু এর মধ্যেই তাঁর সাথে আমার আলাপের পথ তৈরি হয়। হঠাৎ করে তাঁর কাশি দিয়ে রক্ত যাওয়া শুরু হলে তখন পরীক্ষায় ধরা পড়ে যক্ষ্মা। আমার চিকিৎসায় যক্ষ্মা ভালো হয়ে গেলেও তিনি অবসরকালীন আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভুগতেন। ফলে অবসরের শান্তি ও স্বস্তি তিনি কিছুই পাননি।
কর্কটব্যাধির প্রকোপ আজকাল আশঙ্কাজনক। গত ক’দিনে অনেক চেনাশোনা মানুষকে শুনেছি এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে। আসলে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হলেও ক্যান্সারকে জয় করার মতো এখনও অবস্থা হয়নি। সুরজিৎদা যক্ষ্মাকে জয় করলেও জয় করতে পারেননি ক্যান্সারকে। ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে আসার পর যেদিন দেখা হলো, সেদিন তিনি তাঁর সাথে থাকা কোলোস্টোমি ব্যাগ দেখিয়ে বলেছিলেন, খুবই হতাশা নিয়ে, এই তো আছি এক রকম। পরে আরো একদিন দেখা হলো পাল বাজার থেকে সব্জি ব্যাগ বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন দেখে কিছুটা আশা জেগেছিলো, দাদা বোধ হয় জীবনের পথে স্বাভাবিক হয়ে আসছেন। কিন্তু কে জানতো! নিভে যাওয়ার আগেই যে সলতে চড়্ চড়্ করে জ্বলে। সাতই নভেম্বর তাঁর সেই দীপ তারা হয়ে গেলো মহাকালের মহাযাত্রায়।
সুরজিৎদা’র এই প্রয়াণ আমাদের আবারও জানিয়ে দিয়ে গেলো, জীবন অনিশ্চিত, জীবন নির্মম। তাঁর প্রয়াণ শিল্পের সৌকর্যে একটু হলেও ধরিয়ে দিয়ে গেছে ঘুণ। দিনশেষে শিল্পীরা সরস্বতীর সেবায় লক্ষ্মীছাড়া হয়েই ত্যাগ করেন পৃথিবী।