প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মান্না দের চিঠি ও চাঁদপুর ললিতকলা
সংস্কৃতি চর্চার উর্বর ভূমি চাঁদপুর। চাঁদপুরের অনেক শিল্পী রয়েছেন দেশ-বিদেশে। এর মধ্যে কণ্ঠশিল্পীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেশি। গান শিখা বা সঙ্গীত চর্চা এক সময় পাল্লা দিয়ে বা প্রতিযোগিতামূলকভাবে হতো। চাঁদপুর শহরের কয়েকটি সঙ্গীত চর্চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ছিলো চাঁদপুর ললিতকলা। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমি ১৯৯২ সালে হারমোনিয়াম বাজানো ও গান শিখার জন্যে ভর্তি হয়েছিলাম সঙ্গীত একাডেমি ও চাঁদপুর ললিতকলায়। তবে ললিতকলায় দীর্ঘ সময় সঙ্গীত চর্চা করেছি এবং অনেক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছি একক ও কোরাস।
সেই সময় ললিতকলা ছাত্র-ছাত্রীতে পরিপূর্ণ ছিলো। ললিতকলায় জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে সঙ্গীত চর্চা হতো। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস হতো। সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন সঙ্গীতগুরু শীতল ঘোষাল। তিনি গান শিখানোর পাশাপাশি সকলকেই খুব শাসন করতেন। মনে পড়ে সেই দিনগুলো। ভাবলে সত্যিই খুব স্মৃতিকাতর হয়ে যাই।
চাঁদপুর ললিতকলার জন্ম যেভাবে হয়েছিলো, যতোটুকু সম্ভব হয়েছে জানার, তা হলো--চাঁদপুর ললিতকলা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডঃ আঃ মমিন খান মাখন চাঁদপুরের মুক্তিকামী সাংস্কৃতিক ও দেশপ্রেমী ক’জনকে নিয়ে ললিতকলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম দিকে ললিতকলার অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন চাঁদপুর কলেজের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় শৈলেন্দ্র নাথ (এসএন) রায় স্যার।
পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে জমজমাটভাবে অধ্যক্ষ হিসেবে ললিতকলার হাল ধরে রেখেছিলেন শ্রদ্ধেয় সুরকার ও সঙ্গীত গুরু শীতল ঘোষাল। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু শ্রদ্ধেয় কবি, লেখক ও গীতিকার মুখলেসুর রহমান মুকুল। তারাই দুজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চাঁদপুর ললিতকলার কার্যক্রম অনেক এগিয়ে নিয়েছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ সাংস্কৃতিক ভাবধারার গুণীজন সঙ্গীতগুরু শ্রদ্ধেয় শীতল ঘোষাল, গীতিকবি ও লেখক মুখলেসুর রহমান মুকুল আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। আমার খুব কাছ থেকে দেখা ইস্পাত কঠিন বন্ধুত্ব ছিলো শীতল ঘোষাল ও মুখলেসুর রহমান মুকুলের। আমি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধেয় দুজনকে কাকু বলেই ডাকতাম। শাসন-আদর মিলিয়ে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি দুজনার কাছ থেকে।
চাঁদপুর ললিতকলা সঙ্গীত চর্চা শুধু নয়, বরং জাতীয়ভাবে যতগুলো অনুষ্ঠান রয়েছে সকল অনুষ্ঠান উদযাপন করতো। সঙ্গীত চর্চার মধ্যে ছিলো রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, লালন গীতি, পল্লীগীতি, অধুনিক গানসহ সকল পর্যায়ের গান। কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও মৃত্যু দিবস এবং বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান ললিতকলায় অনুষ্ঠিত হতো নিয়মিতভাবে।
চাঁদপুরে প্রশাসনিক উদ্যোগে যতগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হতো তাতে চাঁদপুর ললিতকলার সঙ্গীত শিল্পীদের প্রাধান্য থাকতো। গীতিকার মুখলেসুর রহমান মুকুলের ধারা বর্ণনায় শীতল ঘোষালের পরিচালনায় সকল অনুষ্ঠান উদযাপন করা হতো। সিনিয়র কণ্ঠশিল্পী ও শিক্ষকগণের মাঝে ছিলেন শ্রদ্ধেয় ইতু চক্রবর্তী, রূপালী চম্পক, চম্পক সাহা, কৃষ্ণা সাহা, অনিতা নন্দী প্রমুখ। চাঁদপুরে কোরাস গান পরিবেশনায় চমৎকার ও সেরা ছিলো চাঁদপুর ললিতকলা।
শ্রদ্ধেয় সঙ্গীতগুরু শীতল ঘোষাল, গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল, চম্পক সাহা, মোহাম্মদ জিলানী (যিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন) ও মোঃ মোস্তফা যাঁদের ভাবনা সবসময় ললিতকলা ঘিরেই আবর্তিত হতো।
বহু দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গানের সুর করেছেন শীতল ঘোষাল। আর গানগুলো রচনা করেছেন মুখলেসুর রহমান মুকুল। এসব গানে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জয়ী হয়ে পুরস্কার লাভ করে।
১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে লন্ডন প্রবাসী মোহাম্মদ জিলানী সাহেবের কাছ থেকে ললিতকলার গল্প শুনে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নিজ হাতে লেখা চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন। একদিন গানের ক্লাসে আমি সহ অমিতাভ বসু চপল, আশোক চক্রবর্তী, শংকর সূত্রধর, আঃ মমিন মিতু, আবু সায়েম, মুকবুল, মোঃ হোসেন (নাম মনে পড়ছে না আরো ক'জন) উপস্থিত ছিলাম। সকলকে হাসিমুখে সঙ্গীত গুরু শীতল ঘোষাল জানালেন, শোনো আজ সত্যিই বিরাট ব্যাপার ও আনন্দের সুখবর আছে, আর তা হলো সুদূর লন্ডন থেকে বাই পোস্টে চিঠি লিখে চাঁদপুর ললিতকলার ছাত্র-ছাত্রীসহ আমাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী শ্রদ্ধেয় মান্না দে। পরে চিঠিটা খামের মধ্য থেকে বের করে তিনি আমাদের পড়তে দিলেন। সত্যিই ভীষণ খুশি ও ভালো লাগছিলো। মনে পড়ে, সেইদিন আর আমাদের গানের ক্লাস হয়নি বরং গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল বললেন, শীতল আজ তো আর ক্লাস হলো না। তুই ওদের মান্না দে'র ক'টি গান শুনিয়ে দে। তারপর তিনি তা-ই করলেন। তাৎক্ষণিক মান্না দে'র গাওয়া বিখ্যাত গান শোনালেন।
মান্না দে'র পাঠানো চিঠি পড়ে সেদিন আনন্দে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছিলো সঙ্গীতগুরু শীতল ঘোষালের। অবশ্য শীতল ঘোষাল ভীষণভাবে মান্না দে'র ভক্ত ছিলেন এবং তিনি মান্না দে'র গাওয়া গান বেশি চর্চা করতেন এবং মাঝে মাঝেই আপন মনে গেয়ে শোনাতেন।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকায় সেই সময় কর্মরত সাংবাদিক বড় ভাই বিএম হান্নান চাঁদপুর ললিতকলাকে পাঠানো চিঠি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশিত এই সংবাদের কাটিং যত্ন করে সঙ্গীতগুরু শীতল ঘোষাল বাঁধিয়ে রেখেছিলেন।
সত্যিই ব্যক্তিগতভাবে এখনো গর্ব হয় যে, চাঁদপুর ললিতকলার সঙ্গীত চর্চার ছাত্র ছিলাম এবং কিছু শিখেছি। কিন্তু! এখন খুব মনঃকষ্টে ভোগী যে, আমাদের সঙ্গীত গুরু নেই, ললিতকলার কোনো কার্যক্রমও নেই...সব যেন অজানায় হারিয়ে গেছে!। আজ ললিতকলাই যেন অতীত স্মৃতি হয়ে গেছে। ললিতকলার ঐতিহ্য বহন করার কেউ কি ছিলো না, বরং বিলুপ্ত হয়ে গেল?
এখন যারা সঙ্গীত চর্চা করছে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, তারা তো জানেই না যে, চাঁদপুরে ললিতকলা নামে সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছিলো এবং ধারাবাহিকভাবে সঙ্গীত চর্চা হতো।
সঙ্গীতগুরু শীতল ঘোষালের হঠাৎ মৃত্যুর পর গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল তাঁর জীবদ্দশায় বহুবার চেষ্টা করেছিলেন চাঁদপুর ললিতকলাকে সঙ্গীত চর্চায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু তিনি আর হাল ধরে রাখতে পারেন নি, বরং উত্তরসূরি পেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন বিভিন্ন তথা জ্ঞানপাপী মানুষের মানসিকতার কারণে। তবে চাঁদপুর ললিতকলা স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে চাঁদপুরের ইতিহাসে।