প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
শিশু শেখ রাসেল
সামিয়া তাবাসসুম রাইসা
বাঙালি জাতির অন্দরমহল থেকে যুগে যুগে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য মহান ব্যক্তিত্বের। তাঁদের কাউকে বা আমরা যথাযথ সস্মান দিয়ে চিরকাল মনে রেখেছি। আবার অনেকেই হারিয়ে গেছেন বিস্তৃতির অতল গহ্বরে। তবে বাঙালি জাতি বর্তমানে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে কিছু না কিছু অবদান রয়েছে সে সকল ব্যক্তিদেরই। তাঁরা প্রত্যেকেই হয় তাঁদের জীবন দিয়ে কিংবা তাঁদের কর্ম দিয়ে বাঙালি জাতিকে যুগিয়েছেন মাথা তুলে দাঁড়ানোর রসদ। আমাদের দেশে বাঙালি জাতির প্রধান নেতা বললেই যে মানুষটির নাম মনে আসে সে মানুষটি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে সেনাঅভ্যুত্থানে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর করুণ ও নির্মম পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি।
স্মরণ করি তাঁর বীরপুত্র শেখ কামাল এবং শেখ জামালকে। তবে প্রায়ই যাকে আমরা ভুলে যাই তিনি হলেন ওই পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল। মাত্র ১১ বছর বয়সেই নির্মম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে যাওয়া শেখ রাসেল হয়তো তার কর্মের দ্বারা বাঙালি জাতির ইতিহাস ও উত্থানে দাগ কেটে রেখে যেতে পারেনি। তবে তার কয়েক বছরের জীবন বাঙালি জাতির ইতিহাসকে এতোই প্রভাবিত করেছে যে কখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের সিংহাসন থেকে নেমে এসে আমাদের বন্ধু হয়ে উঠেছেন, তা আমরা বুঝতেই পারিনি।
শেখ রাসেলের জন্ম
শেখ রাসেলের জন্মের ইতিহাস বড়ই সুন্দর। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখ। দেশভরা হেমন্তের গন্ধে। গ্রাম্য সভ্যতাভিত্তিক আমাদের দেশের ঘরে ঘরে তখন নতুন ফসল তোলার আনন্দ। এমনই আনন্দের দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায় জন্মগ্রহণ করলেন শেখ রাসেল। তার জন্ম হয়েছিলো বড় আপার ঘরে। সমগ্র বাড়ি সেদিন আনন্দের জোয়ার। জন্মের কিছুক্ষণ পর শেখ হাসিনা এসে ওরনা দিয়ে তার মাথা পরিষ্কার করে দেন। জন্মের সময় শেখ রাসেল চেহারায় ছিলেন স্বাস্থ্যবান। এ যেনো শুধু বঙ্গবন্ধুর পরিবারেরই নয়, সমগ্র জাতির আনন্দ।
শেখ রাসেলের নামকরণের পেছনেও এক সুন্দর কাহিনি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু বরাবরই ছিলেন বিশ^শান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষবাদী এবং যুদ্ধের ঘোর বিরোধী। এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত নোবেলবিজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের একজন গুণমুদ্ধ ভক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, উল্লেখ করতে হয় বার্ট্রান্ড রাসেল নোবেল বিজয়ী দার্শনিক কিংবা সমাজবিজ্ঞানীই ছিলেন না, ছিলেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের নেতাও। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সমগ্র পৃথিবী যখন সম্ভাব্য একটি পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে আছে, তখন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। এমনই মহান ব্যক্তির ব্যক্তিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন শেখ রাসেল।
শেখ রাসেলের ছেলেবেলা দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতোই বর্ণময়। জন্মের পর খুব বেশি দিন তিনি বাবার সান্নিধ্য পাননি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে ঢাকায় থাকলেও পরে তাঁকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হয়।
শোনা যায় বড় আপা শেখ হাসিনার সঙ্গে কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়ে মাত্র দুই বছরের রাসেল তাঁর আপাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সে বঙ্গবন্ধুকে বাবা বলে ডাকতে পারে কি না। সামান্য কিছুদিনের জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই রাসেল কাটিয়ে ছিলেন তাঁর মা-বোনদের সাথে। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরোটেরি স্কুল ও কলেজে। ১১ বছর বয়সে যখন তাঁর মৃত্যু হয় তখন তিনি সেখানকারই চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
কেনো শেখ রাসেল আমাদের বন্ধু?
শেখ রাসেল আমাদের বন্ধু। কীভাবেই বা তিনি আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলেন? বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে রাসেলের ছেলে বেলার দিনগুলোতে। তার ছেলেবেলার দিনগুলো সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তার অধিকাংশই শিশু বয়সের নিষ্পাপ আত্মভোলা কর্মকা-। শোনা যায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় টমি নামের একটি কুকুর ছিলো। যার সাথে ছোট্ট রাসেল খেলে বেড়াতো। একদিন খেলার সময় কুকুরটি জোরে ডেকে উঠলে ছোট রাসেলের মনে হয় টমি তাকে বকেছে। শিশু রাসেল তার আপা রেহানার কাছে এসে কাঁদতে থাকেন। আরো শোনা যায় রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিলো।
মাছ ধরে আবার সে মাছ সে পুকুরেই ছেড়ে দিতো। এই ছিলো তাঁর মজা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের জন্ম হয়েছিলো রাসেল জয়কে নিয়ে খেলতো সারাদিন। তাঁর স্বভাব ছিল অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির আর এই দুরন্তপনার সঙ্গী সে বাইসাইকেলকে সঙ্গী করে রোজ স্কুলে যেতো রাসেল। রাসেলের শৈশব আখ্যান যেন আমাদের সকলের শৈশবের গল্পব লে দেয়। তাঁর শৈশবের গল্প কথাগুলোর মধ্যে আমরা যেন বরাবর নিজেদেরই খুঁজে পাই। পড়াশোনা, খেলাধুলা, দুরন্তপনা এসব নিয়ে রাসেল আমাদের সকলের কাছেই হয়ে ওঠে শৈশবের এক মূর্তি-প্রতিমূর্তি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই অভিশপ্ত রাতের সঙ্গে পরিচিতি আমাদের সকলেরই রয়েছে। সেই রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মম পরিণতির কথা আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। এক দলতরুণ সেনা কর্মকর্তা সেই রাতে শেখ মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন ট্যাংক দিয়ে গিলে ফেলেন। সেদিন প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু এবং ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত কর্মচারী মহিতুল ইসলামের কথা অনুযায়ী, রাসেল দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেন। জানতে চান সেনারা তাকেও মারবে কি না। এমতাবস্থায় একজন সেনা কর্মকর্তা মহিতুলকে এসে মারলে রাসেল তাকে ছেড়ে দেয়। সে কাঁদতে থাকে তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে সময় একজন ঘাতক রাসেলকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে।
শেখ রাসেল বাঙালি জাতির কাছে এক যুগোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব। বাঙালি জাতি তাঁর মধ্যে খুঁজে পায় রুপকথার মতো নিজেদের ছেলেবেলাকে। শেখ রাসেলের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে আপামর বাঙালির শৈশব। অন্যদিকে আমাদের দেশের করুণ ইতিহাসের কথা সে সমস্ত নৃশংস ক্ষমতালোভী মানুষের কথা যারা কেবল মাত্র ক্ষমতার লোভে ১১ বছরের একটি ছোট্টশিশুকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি।
যে জাতি নিজের ইতিহাস থেকে বিস্মৃত হয়, তারা সভ্যতার ইতিহাসে স্থবির হয়ে পড়ে। শেখ রাসেল বাঙালি জাতির সে ইতিহাসের এক জ¦লন্ত প্রতিমূর্তি। তাঁর স্মৃতিকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে গঠন করা হয়েছে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ। শেখ রাসেলের নামে রাজধানী ঢাকায় নামাঙ্কিত হয়েছে একটি স্কেটিং স্টেডিয়াম। এভাবেই চিরকাল শেখ রাসেল অমর হয়ে থাকবেন বাঙালি জাতির স্মৃতিতে। বাঙালি জাতি শেখ রাসেলের স্মৃতি বুকে নিয়ে তাঁকে বন্ধুর ¯েœহের আসনে বসিয়ে সভ্যতার পথে আরো অগ্রসর হোক, এই কামনা করি।
সামিয়া তাবাসসুম রাইসা, ৫ম শ্রেণি, বিষ্ণুদী আজিমিয়া সপ্রাবি, চাঁদপুর।