প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
খোঁজ
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
ঘরের দরজা প্রতিদিন ভোরে খোলেন গৃহকর্তা। তিনি সবার আগে ওঠেন ঘুম থেকে। বছর পঞ্চাশের কাছাকাছি তার বয়স। এ বাড়িতে তিনি ছাড়া থাকে তার পরিবার। মানে তার স্ত্রী যার বয়স প্রায় চল্লিশ বছর হবে। আর আছে এক ছোট ছেলে। তার বয়স নয় বছরের বেশি নয়। প্রতিদিন ভোরে উঠে বাগানের ফুলগাছগুলো পরিচর্যা করার অভ্যেস গৃহকর্তার। বাগানে এখন হেমন্তের ফুলের সমারোহ। তার বাগানে শিউলি, হিমঝুরি, গন্ধরাজ, কামিনী ফুলের যেনো উৎসব। ফুলগুলো হেসে আছে কোমল ও কচি রোদের দিকে চেয়ে। বাগানে প্রতিদিন নিজের হাতেই তিনি পানি দেন বড় একটা রাবারের পাইপ দিয়ে। মাঝে মাঝে মাটিও আলগা করে দেন। আজকের ভোরে তার উঠতে মন চাইছিলো না ঘুম থেকে বিছানা ছেড়ে। কিন্তু তবু অভ্যেস বশে উঠতেই হোলো। দাঁত ব্রাশ করে গায়ে একটা ভারী শার্ট গায়ে দিয়ে তিনি দরজা খুলে বারান্দায় পা দিতে গেলেন। কিন্তু পা দিতে গিয়েই তার চক্ষু চড়কগাছ! ও মা! এ যে দেখছি একটা ছেলে। শুয়ে আছে গুটিশুটি মেরে বারান্দায় পাতা কার্পেটের ওপর। বারান্দায় শুকোতে দেয়া ভারী তোয়ালে মুড়ি দিয়ে সে ঠাণ্ডা নিবারণ করেছে রাতে। গৃহকর্তা চেঁচিয়ে উঠলেন। এ্যাই তুই কে রে! ওঠ্। ওঠ্। ছেলেটির ওপর থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে নিলেন তিনি। গৃহকর্ত্রী দেখলে একটা অনর্থ বাঁধাবে। হঠাৎ গায়ে ঠাণ্ডা লাগতেই ছেলেটা চোখ মেলে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে বসলো। গৃহকর্তা আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তোর নাম কী? ঠিকানা কোথায়? তুই এখানে কীভাবে এলি? চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুনে উঠে এলেন গৃহকর্ত্রী। সাথে শিশুটিও। ওরা তিনজনে মিলে যেনো চিড়িয়াখানার কোনো জন্তু দেখছে, এমনভাবেই তাকে দেখতে লাগলো। ছেলেটার বয়স বারো বছর হবে হয়তো। মুখে মায়া আছে। মাত্র হালকা গোঁফের রেখা তৈরি হয়েছে। কি রে! বল তোর নাম কী, ঠিকানা কোথায়? তুই এখানে এলি কীভাবে? ছেলেটি এবার কিছুটা সাহস ফিরে পায়, তার মতো একটা শিশু দেখতে পেয়ে। যাক, অন্তত গায়ে হাত তুলবে না এরা। সে তার নাম বলে। অপ্রতিম। তার গ্রামের নাম সুবর্ণগাঁও। শহরে এসেছিলো গ্রাম থেকে, মায়ের সাথে। রাতে ট্রেনে চড়ে গ্রামে ফেরার কথা ছিল মা-সহ। কিন্তু রেলস্টেশনে সে ভিড়ের মধ্যে মা-কে হারিয়ে ফেলে। এদিকে ট্রেনটাও ছেড়ে দেয়। শেষমেষ স্টেশনে মাকে অনেকক্ষণ খুঁজে না পেয়ে সে রাত কাটানোর জন্যে এ ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামের নাম শুনে গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী দুজনেরই মনে হলো এ নাম তারা শুনেছে। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে মাথা নাড়লো। হুম। এ গ্রাম তো তাদের বাড়িতে বারো বছর আগে যে কাজ করতো, সেই নারীর গ্রামের নাম। মিনতি। তারা দুজনেই বলে ওঠে, তুই মিনতির ছেলে? ছেলেটা মাথা নাড়ে। তোর মায়ের মোবাইল নম্বর জানিস? জ্বি না। আমার মায়ের কোনো মোবাইল নেই। আচ্ছা, তুই থাক। তোর মাকে আমি খবর দিচ্ছি। এই বলে গৃহকর্তা বললো তার গিন্নিকে, শোনো, ওকে বাসায় রেখে দাও। টুকটাক বাজার-সদাই করবে আর আমাদের বাচ্চাটার সাথে খেলবে। ওর মা খবর পেয়ে আসলে তখন দেখা যাবে। গৃহকর্ত্রী একমত হলেন গৃহকর্তার সাথে। গৃহকর্তার নাম সমীরণ আর গৃহকর্ত্রী সুষমা। তাদের বাচ্চার নাম সপ্রতিভ।
|আরো খবর
অপ্রতিম মা-কে হারিয়ে যখন জানতে পারলো, তার মা এই বাড়িতে আগে কাজ করতো, তখন আর তার মন খারাপ থাকলো না। সমীরণ বাবু বলে দিয়েছেন, তার মাকে তিনি খবর পাঠিয়েছেন সুবর্ণগাঁওয়ের রেলস্টেশনে ফোন করে। সুবর্ণগাঁয়ের স্টেশনমাস্টারও জানালেন তাকে, এ রকম একটা ছেলে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তিনি শুনেছেন এবং মিনতি নামের এক নারী এসে কাঁদতে কাঁদতে তাকে জানিয়ে গেছে খোঁজ পাওয়া যায় কি না তা দেখতে। অপ্রতিম গত দুদিন ধরে সমীরণ বাবুর সাথে বাজারে যায়। বাজারের ব্যাগ সে বহন করে আর সমীরণ বাবু এটা-সেটা কিনে ব্যাগে ঢোকায়। সুষমা দেবীও অপ্রতিমকে কাজের ফরমায়েশ দেয়। ছোটখাট অনেক কাজ সারাদিনে করতে হয়। বিকেল হলে কাছের ছোট মাঠে সপ্রতিভকে নিয়ে সাইকেল চালাতে যেতে হয়। সপ্রতিভ সাইকেল চালায় আর সে দেখে রাখে।
মিনতি যাওয়ার পর সুষমা দেবী কোনো কাজের লোক রাখেনি। না রাখার কারণ সে এক দুঃখের কাহিনী। সুষমা দেবী তার প্রথম সন্তান জন্ম দিতে হাসপাতালে ছিলেন সাতদিন। হাসপাতালে তার একটা মৃত সন্তান জন্ম নেয়। মৃত সন্তান জন্ম নেয়ার দুঃখে সুষমা দেবী পাগল হয়ে যান। শোকার্ত সমীরণ বাবুও সেই মৃত সন্তানের মুখ না দেখে মিনতিকে বলেন, যাতে সে বাচ্চাটাকে সমাহিত করে। মিনতি সেই মৃত সন্তানটি নিজে কোলে করে নিয়ে সমাহিত করার জন্যে সেই যে গেলো, আর এলো না। তার ছয়মাসের বেতনও সে নেয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মিনতিকে পাওয়া যায়নি। এদিকে সুষমা দেবীও ছয়মাস অপ্রকৃতিস্থ থাকার পর সুস্থ হয়ে ওঠে। মৃত ভেবে যে শিশুটিকে সমাহিত করতে গিয়েছিল, তাকে আর সমাহিত করতে পারেনি মিনতি।
মার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়ে অপ্রতিম মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছে সমীরণ বাবুর পরিবারটির সাথে। একজন গৃহভৃত্য যা যা করে, সে-ও তাই-ই করতে লাগলো। মিনতি যে থালায় খাবার খেতো, যে গ্লাসে পানি খেতো, অপ্রতিমকেও সেই একই থালা-গ্লাসে খেতে দেয়া হলো। মিনতির খাটেই অপ্রতিম শোয়। অপ্রতিমের ভালোই লাগে। একটুও অন্যরকম মনে হয় না। সে অবাক হয়, কেনো তার মা মিনতি এই কাজ ছেড়ে তাকে নিয়ে গ্রামে থাকে তা অপ্রতিম ভেবেও কূল পায় না। মিনতিকে খবর পাঠানো হয়েছে আজ পাঁচদিন। অপ্রতিম ভাবে কেনো তার মা আসতে দেরি করছে। হয়তো আসার ভাড়ার টাকা নাই, তাই। এদিকে সুষমা দেবীর অপ্রতিমকে দেখলেই মায়া লাগে। মনে হয় কতদিনের চেনা। সপ্রতিভের সাথে সে যখন খেলে তখন মনে হয় এরা এরকম আগেও খেলতো। অবশ্য মিনতির ছেলে হিসেবে জানার কারণেই কি না তার এমন মনে হচ্ছে, তা সুষমা দেবী ভেবে পায় না। সমীরণ বাবু অবাক হয়ে যায়, ছেলেটার কিছু কিছু অভ্যাস তারই মতো। হাঁটার ভঙ্গিতে দুজনের বেশ মিল। কথাটা তার নয়। বাজারে এক পরিচিত দোকানদার কথাপ্রসঙ্গে বলল গতকাল। এরপর সমীরণ বাবু নিজেও খেয়াল করেছে। আসলেই তাই। দুজনের হাঁটায় মিল আছে দেখতে পেয়ে ভাবলো, বেশ ভালোই তো ছেলেটা তাকে নকল করেছে!
বিকেলের আলো প্রায় নরম হয়ে এসেছে। সোনার কাঁচা রঙের আভা মুখে জুড়ে বসেছে অপ্রতিমের। সে আলোয় তাকে কোনো দেবদূত বলে মনে হচ্ছে। সমীরণ বাবু বৈকালিক চা পানে বসবার আয়োজন করছেন এ মুহূর্তে কুরিয়ার মারফত একটা চিঠি এলো। কুরিয়ারের বাহক এসে সে চিঠি বাড়ি বয়ে দিয়ে গেল। সুষমা দেবী আগ্রহী হয়ে উঠলো চিঠি কে পাঠিয়েছে তা দেখতে। সপ্রতিভ একদিকে টিভিতে কার্টুন দেখছে, অন্যদিকে অপ্রতিম তার সাইকেলটা মুছে রাখছে। সুষমা দেবীর আগ্রহে সমীরণ বাবু দ্রুত চিঠি খোলে। চিঠি পড়তে পড়তে সমীরণ বাবুর চোখের পানি বের হয়ে আসে। সুষমা দেবী অবাক হয়ে চিঠিটা কেড়ে নেয়। সমীরণ বাবু এসে অপ্রতিমকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে থাকে হু হু করে। চিঠি হাতে নিয়ে অর্ধেক পড়তে না পড়তেই সুষমা দেবী অজ্ঞান হয়ে যায়। সমীরণ বাবু আর অপ্রতিম মিলে পানির ছিটা দিতেই চোখ খুললো সুষমা দেবী। অপ্রতিমের মুখটা দেখেই বলে উঠলো, আমার বড় ছেলে তুই বাবা, তুইই আমার বড় ছেলে!