প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২১, ০০:০০
বিকেল আর মাঠ নিবিড় বন্ধু। যেন এক আত্মা, দুই দেহ। তাদের এ বন্ধুতা অনেক অনেক দিন আগে হতে। যেদিন এ মাঠে প্রথম সবুজ ঘাস জন্মেছিল সেদিন থেকে বিকেলের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সকালের অরুণ যখন দুপুরের খররোদ পার হয়ে নিস্তেজ হয়ে ওঠে তখন মাঠে নামে বিকেল। বিকেল খুব অল্প সময় থাকে মাঠে। প্রতিদিন সময় করে বিকেল ঠিক মাঠে নামবেই। আর মাঠও পথ চেয়ে থাকে কখন বিকেল নামবে। প্রতিদিন ভোরে ভোরে মাঠে আসে বয়ষ্ক মানুষের দল। তারা এসে ব্যায়াম করে নিজেদের রক্ত থেকে চিনি কমায়। কেউ কেউ আসে রক্ত থেকে চর্বি সরাতে। এদের সবাই সময় থাকতে নিজেদের স্বাস্থ্যকে নিয়ে ভাবেনি। আজ যখন অফিসের কাজ থেকে অবসর মিলেছে তখন তাদের সময় হয়েছে হেঁটে ঘাম ঝরানোর। অথচ কিছুকাল আগেও তারা দু’কদম যেতে গাড়ি চড়েছে। দুপুরের তপ্ত রোদে মাঠে আসে এলাকার ডেকোরেটারের কর্মীরা। তারা ময়লা পর্দা, ঝোলে ভেজা সাদা কাপড়গুলো পুকুরের ময়লা পানিতে ধুয়ে মাঠে ঘাসের বিছানায় মেলে ধরে যাতে কড়কড়ে রোদে শুকিয়ে যায় দ্রুত। দুপুর গড়িয়ে গেলে মাঠে আজকাল আর কেউ আসে না। দ’একজন মাঠে বসে গল্প করতে আসে। কেউ খেলতে আসে না দেখে মাঠের যেমন মন খারাপ হয় তেমনি মন খারাপ হয় বিকেলেরও।
কিছুদিন আগে শ্রাবণের অবিরাম কান্না নিয়ে তুমুল বর্ষা শেষ হয়েছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের মনোরম ভেলা নিয়ে শরৎ এসেছে বেশিদিন হয়নি তেমন। মাঠের মাঠ ঘাসগুলো বর্ষার নবধারা জলে আগের চেয়ে বেশ নাদুস-নুদুস এবং সবুজ হয়ে উঠেছে। এরকম সবুজ গালিচা বিছানো মাঠ বিকেলের খুব পছন্দের। বিকেলের সোনাঝরা নরোম রোদ ঘাসের চাদরে হেসে হেসে লুটোপুটি খেলে। মনে হয় বাবার বাড়ি এসে রোদের নাতিরা ছাড় পেয়েছে। কোন শাসন-বারণ নেই। রোদের কোমল কুসুমেরা ফুটে আছে ঘাসে ছাওয়া মাঠের আদরে। উপরে সাদা মেঘ আর নীল আকাশের আদর আর নীচে তুলতুলে রোদ এবং কোমল ঘাসের মায়াময় বিকেল যেন শরতের কালজয়ী চলচ্চিত্র তৈরি করেছে।
বিকেল ও মাঠ অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু তাদের বনেদীয়ানায় আজ ঘাটতি পড়েছে সবচেয়ে বেশি। মাঠ জিজ্ঞেস করে বিকেলকে, হ্যাঁ রে, কেমন আছিস্? মাঠের প্রশ্নের জবাবে বিকেল বলে, কেমন আর থাকবো বল? আগে আমি মাঠে নামার আগেই মাঠে নেমে যেত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা শিশুদের দল। তারা তক্কে তক্কে থাকতো কখন স্কুল ছুটি হয়। ছুটি হলেই সবাই চলে আসতো দল বেঁধে। তারপর সারাটা বিকেল সন্ধ্যে করে তারা মনের আনন্দে মেতে থাকতো খেলায়। আহা! কী সেই মধুর কলরব। মনে হতো স্বর্গের বাগানের ফুলগুলো ফুটে আছে আমার বুকে। কেউ বল নিয়ে খেলছে, কেউ ব্যাট নিয়ে দৌড়াচ্ছে। কেউ আবার ডাংগুলি নিয়ে এক কোণায় মেতে উঠেছে। রোগা শিশুটিও খেলতে নামলে মাঠ থেকে উঠতে চাইতো না। বৃষ্টির বিকেলেও ভিজতে ভিজতে তারা বল নিয়ে ছুটেছে। খেলতে খেলতে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শৃঙ্খলা। তাদের দম যেতো বেড়ে। সহজে কাউকে ক্লান্ত হতে দেখিনি। সাঁঝের আঁধার নেমে আসতে না আসতেই তারা ফিরে গেছে যে যার ঘরে। বিকেলের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাঠ। সে বলে, আমার কষ্ট তোর চেয়েও বেশি রে বিকেল। যখন কোন শিশু খেলতে খেলতে আমার বুকে গড়ায় তখন আমার খুব শান্তি লাগে। আমার তো নিজের কোন ছেলেমেয়ে নেই। তাই মানুষের শিশুরা এলে আমার প্রাণ ভরে যায়। তারা কেউ খেলতে খেলতে হাতে-পায়ে আঘাত পেলে আমার প্রাণটা আঁতকে উঠতো। আহারে যাদু আমার! তখন আমার আফসোস যেতো বেড়ে। কেন যে ঘাসগুলো আরও ঘন হলো না। তুই কি জানিস্ বিকেল, একদিন আমার বুকে সেই মানুষটা এসে দাঁড়িয়েছিল এক জনসভায়! কে তিনি? বিকেল প্রশ্ন করে। আরে তিনি, যাঁর তর্জনী জাগানো দেখলেই কেঁপে উঠতো ইয়াহিয়া। ছয়ফুট লম্বা এক বিশাল মানুষ। আকাশের মতো। বিকেল বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেদিনের বিকেলে কোথা থেকে এতো মানুষ এসেছিল কে জানে। তাঁর গায়ে ছিল সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির উপর হাতকাটা কালো কোট। তাতে ছয়টা বোতাম। তার গলা ছিল বজ্রের মতো গমগমে। মাঠ বলে, আহা! আমি যে কতোবার এই মহান মানুষটার পায়ের ধূলো নিয়েছি। তিনি যখন আমার বুকে পা রেখে চলছিলেন, তখন মনে হলো বাবা বুঝি আমাকে আদর করছেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষকে তিনি মুক্ত করে ছাড়বেন। তিনি তা করে দেখিয়েছেন। সেদিন তুইও অনেক সেজেছিলিস্ বিকেল। বিকেল বলে, সাজবো না বল? এমন একজন মানুষ আসলেন, যিনি আমাদের পিতা। তাঁর সামনে কি যে সে হালে যাওয়া যায় বল? মাঠ একটু স্মৃতি ভারাতুর হয়। দুচোখ বন্ধ করে ফিরে যায় সে সব মধুময় দিনে। কোন এক বিকেলে এখানে একদল সাদাকালো আর একদল আকাশি জার্সি পরা খেলোয়াড়দের ফুটবল খেলা হয়েছিল। কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। খেলা ড্র হয়েছিল। অনেকদিন মানুষের চোখে সেই খেলা জীবিত ছিল। মাঠকে চোখ বুঁজে মৌন থাকতে দেখে বিকেল বলে, আচ্ছা মাঠ, বলতো এরকম দুর্দিন আমাদের কেন এলো? সব কপাল রে কপাল। মাঠ বলে, যুগের দোষে আমরা আজ নিঃসঙ্গ। বিকেল উদ্বেগের সাথে বলে, সে কেমন? শুনলাম মানুষের শিশুদের হাতে আজ বাবা-মায়েরা স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছে। আবার ট্যাব না ট্যাবলেট, কী একটা জানি তুলে দিয়েছে। তারা এখন ঐ সবের বোতাম টিপে ফুটবল-ক্রিকেট খেলে। তাদের এখন আর খেলার মাঠ লাগে না। বিকেল বলে, শুনলাম, ওদের বাবা-মায়েরা নাকি জিপিএ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। জিপিএ কী রে? মাঠ শুধায় বিকেলকে। আরে জিপিএ হলো পরীক্ষায় পাশ করার সোনার হরিণ। জিপিএ-পাঁচ মানে হলো সে ছেলে লেখাপড়ায় সেরা। ও! বুঝলাম। মাঠ বলে। তাতে তোর কী অসুবিধা? অসুবিধা মানে! ওরা স্কুল শেষ করেই মাস্টারদের কাছে প্রাইভেট পড়তে দৌড়ায়। এক একজন বাচ্চা চার-পাঁচজন মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে। ওদের আর আমার সাথে দেখা-সাক্ষাতের সময় কই? ওরা কেবল পড়ে পড়েই ক্লান্ত। আমার নরম রোদ কি ওরা দেখে? ওরা এখন ফটোকপি মেশিনের দোকানে নয়ত কোন কোচিং সেন্টারে ভিড় করে। বিকেল মানে তাদের তোতা পাখির মতো সাদা-কালো হরফ গিলে বড় হওয়ার সময়। বিকেল হলো এখন ওদের কাছে সাক্ষাৎ যম। মাঠ এতো দুঃখেও হেসে দেয় বিকেলের কথায়। মাঠ ও বিকেলের কথা শুনে মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ গলা খাকারি দেয়। মাঠ ও বিকেল একসাথে বলে উঠে, কি হে তাল ভাই, কিছু বলবে নাকি? এতো গলা সাধছো? তালগাছ বলে, বলবো বলেই তো তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তা বলে ফেলো যা বলতে চাও। আর ভণিতা কোরো না ভাই। এমনিতেই মন-মেজাজ ভালো নেই। আরে রোসো। খারাপ খবর ধীরে-সুস্থে দিতে হয়। কী খারাপ খবর ভাই? শুনলাম, তোমার ফাঁকা জায়গায় নাকি শপিং মল হবে। ইয়া বড় শপিং মল। কী বল আবোল তাবোল? আরে হ্যাঁ। ঐ যে লোকটা, যে তোমার পিছনের পুকুরটাকে বালি দিয়ে খুন করলো সেদিন, সে ও তার লোকেরা ফন্দি আঁটছে। তারা এই মাঠ আর রাখবে না। তারা বড় রকম টাকা কামানোর জন্যে তোমার মাটিতে পাথরের অট্টালিকা বানাবে। কথা শুনে বিকেল ও মাঠের মন খারাপ হয়ে গেল। এতোদিন তাও বিকেল তার বুকে গড়াগড়ি খেতো। এখন তো সে-ই থাকবে না। তালগাছ আবার ফিসফিস করে মাঠ ও বিকেলকে অনুনয় করে, ভাই আমি যে তোমাদের একথা বললাম তা যেন আবার পাঁচ কান না করো। তাহলে আমার কপালেও শনি নামবে। এমনিতেই তারা নির্বিচারে আমাদের জাতি ভাইকে কেটে সাফ করে দিয়েছে। অবশ্য কম্ম যেমন করেছে তেমন ভুগছেও। বজ্রপাতে মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। মাঠ ও বিকেল তালগাছকে অভয় দিলো। আর যাই হোক, তারা বাক্যবাদী হতে চায় না।
মন খারাপ করা বিকেলটাতে এক সময় একটা মরদেহ নিয়ে একদল মানুষ ঢোকে মাঠে। তারা মৃত মানুষটার শেষ যাত্রার জন্যে সমবেত হয়েছে। লোকগুলো বলাবলি করছে, মানুষটা অকালে মারা গেছে। ডাক্তার বলেছে ব্যায়ামের অভাবেই লোকটা কম বয়সে মারা গেছে। লোকটাকে সামনে রেখে দুচারজন মাইকে কথা বলতে শুরু করলো। সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো, লোকটা কখনো অফিস আর বাড়ির বাইরে খেলার মাঠে আসেনি। তাই তার দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমতে জমতে রক্তনালী বুঁজে গেছে। লোকটা খেলাধুলা করলে এরকম হতো না। সকলের কথা শেষে এ শহরের যিনি প্রধান, তিনি কথা বললেন। তার কথায় জোর ছিল। তিনি বললেন, আজ থেকে প্রতিদিন বিকেলে আমাদের শিশুদের মাঠে পাঠাতে হবে। তাদের খেলার জন্যে যত বল লাগে আমি দিব। যত ব্যাট লাগে আমি দিব। তবু আমাদের শিশুরা মাঠে আসুক। এই মাঠে কোন শপিং মল হবে না। এই মাঠ টাকা কামানোর কোন মেশিন হবে না। এই মাঠ হবে মানুষকে সুস্থ রাখার মেশিন। আমরা আর কম বয়সে কারও মৃত্যু দেখতে চাই না। আমরা স্বাস্থ্যবান জাতি চাই। আমি মরহুমের আত্মার চির শান্তি কামনা করি। শহরের প্রধান ব্যক্তি বক্তব্য দেওয়ার পর সবাই মরদেহ নিয়ে চলে গেল। তালগাছ তার মাথায় চাঁদের গোল সাবান মেখে জোছনায় গোসলের জন্যে তৈরি হল। দিনশেষে পাওয়া প্রশান্তি নিয়ে বিকেল মিলিয়ে গেল সন্ধ্যায়। মাঠ নিজে তপস্যায় মৌন থেকে গুণে চলেছে, এ পর্যন্ত তার বুকে কতোজন যুবকের অকাল মৃত্যুর শেষযাত্রা হলো।