শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

মা বেড়াল ও মা ইলিশের গল্প

প্রতিদিন এই প্রাণিজগতে অনেক বেড়ালই মা হয়। তেমনি মীনকূলে নদীতে ডিম ছাড়ে অনেক মা ইলিশ। মানুষের সমাজে অনেক নারীও মা হয় সন্তান জন্ম দিয়ে। এদের কেউ পরিচর্যা পায় আর কেউ পায় না। কারও মাতৃত্বকালীন জীবন কাটে শত সংগ্রামে আর কারও পুরো সময়টাই যায় আদরে আদরে। এ রকম তিনজন হবু মায়ের কথা আমরা জানি যারা ভাগ্য বিড়ম্বনায় একসূত্রে গাঁথা কিন্তু পরিণাম ভিন্ন। তাদের কথাই আজ বলছি।

রাস্তার ধারে যে বড় বিলাসবহুল বাড়ি, সে বাড়িতে আজ অনেক লোকের আনাগোণা। অর্থে-বিত্তে বেশ বড়লোক তারা। তাদের পোশাক-আশাক আর চলনে-বলনে ফুটে উঠে অফুরান প্রাচুর্য। প্রায় অনেকদিন পরে এ বাড়িতে নতুন শিশু আসবে। বাড়ির যিনি কর্তা, তার ছোট ছেলের বউয়ের মা হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আজ তার সাধের দিন। এটা একান্তই মেয়েদের অনুষ্ঠান। বিদেশের কালচারে এ অনুষ্ঠানকে বেবি শাওয়ার বলে। এ বাড়িতেও বিদেশিদের আদলে এ অনুষ্ঠানকে বেবি শাওয়ার বলে জানান দেয়া হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে হবু মায়ের পছন্দের সব খাবার তৈরি করা হয়। বাড়ির রান্নাঘরে তাই বিরাট আয়োজন। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে আস্ত বাজারটাই রামভক্ত হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত তুলে আনার মতো তুলে আনা হয়েছে। এখনও সব রান্না সম্পন্ন হয়নি। যিনি হবু মা, তার নাকি সাধ হয়েছে ইলিশ মাছের ডিম খাওয়ার। তাই বাজার থেকে বিরাট এক ডিমওয়ালা ইলিশ আনা হয়েছে। এখন ইলিশ ধরা নিষেধ। তবুও কেমনে জানি গৃহকর্তা এই ডিমওয়ালা মা ইলিশ যোগাড় করেছেন। ডালায় মাছটি লম্বালম্বি করে রাখা হয়েছে। এখনও কাটা হয়নি। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাটা হবে। হবু মায়ের মা এলে তিনিই এটা রাঁধবেন। তাই একটু সময় নিচ্ছে ইলিশের ডিম রান্নার। মা ইলিশের চোখ এখনো জ্বলজ্বল করছে।

যে বাড়িতে হবু মায়ের জন্যে এলাহী আয়োজন, সে বাড়িতে একটা বেড়ালও থাকে। সাদা আর হাল্কা বাদামী রঙের মিশেল। বেড়ালটা মাস ছয়েক আগে কোথা থেকে জানি এসেছে। প্রথম প্রথম দূর দূর করেছিলো বাড়ির সহকারীরা। পরে কী কারণে জানি আর কেউ তাড়ানোর কথা বলেনি। ফেলে দেয়া কাঁটাকুটো খেয়ে তার জীবন চলে। তাদের বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া এই সাদা-বাদামী বেড়ালটিও মা হতে চলেছে। হয়তো বা এ বাড়ির হবু মায়ের আগেই বেড়ালটি মা হয়ে যাবে। ইদানীং বেড়ালটির খুব ঘন ঘন খিদে পায়। পাওয়ারই কথা। হবু মায়েদের খেতে হয় ঢের। সে তুলনায় বেড়ালটা যা উচ্ছিস্ট পায় তা দিয়ে তার একার হওয়ার কথা নয়। হবু মা বেড়াল তাই সবসময় রান্নাঘরে উঁকি-ঝুঁকি মারে। আজ আবার তার সরস নাকে ইলিশের ঘ্রাণ পৌঁছেছে। কাঁচা মাছের ঘ্রাণে বেড়াল মায়ের খিদে বুঝি আরও বেশি করে লাগলো। বেড়াল মা রান্নাঘরে কাউকে না দেখতে পেয়ে সরাসরি মাছের ডালার কাছে চলে গেলো।

যারা ইলিশ মাছ সম্পর্কে জানে তারা বুঝতে পারে, মা ইলিশ ডিম পাড়ার সময় হলেই সমুদ্র হতে নদীতে আসে। এ সময় সরকারিভাবে ইলিশ মারা মানা। অর্থাৎ মা ইলিশকে ডিম ছাড়তে অবাধে বিচরণের সুযোগ দেয়ার জন্যে এ সময়টায় ইলিশ ধরা, বিক্রি করা ও বহন করা নিষিদ্ধ। তবুও ক্রেতাদেও অদম্য লোভকে পুঁজি করে জেলেরা ইলিশ মারে। গভীর জলের ইলিশকে ডাঙায় উঠালে তা বেশিক্ষণ জীবিত থাকে না। খুব দ্রুত মারা যায়। সর্বোচ্চ তিন মিনিটের মতো জলের ইলিশকে ডাঙায় জীবিত থাকতে দেখা গেছে। মানুষের মধ্যে যেমন ব্যতিক্রম থাকে তেমনি ইলিশের মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে। যে মা ইলিশটি ডিমসহ এই বড় বাড়ির রান্নাঘরে শুয়ে আছে সেটি দুর্বল হয়ে গেছে কিন্তু একেবারে মারা যায়নি এখনো। নিস্তেজ রূপোলি মাছটির চোখ এখনও সজীব। মাছটি বুঝতে পেরেছে আজ তার অন্তিম দিন। তবুও কিছু করার নেই। মা বেড়ালটি প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে ডালার সামনে উপস্থিত। বেড়াল মূলত মাছ খায়। দুধও খায়। তবে মাছের গন্ধ পেলে তাদের আর মাথা ঠিক থাকে না। হবু মা বেড়ালটিও ইলিশের ঘ্রাণে পাগল। মা ইলিশের গায়ে বেড়ালটি যেই কামড়াতে যাবে, অমনি মাছটি ডেকে উঠলো অনুনয়ে। মাছকে কথা বলতে শুনে মা বেড়াল দুই কদম পিছিয়ে আসে। সে ভাবলো বোধ হয় রান্নাঘরে কোনো মানুষ আসছে। কিন্তু কাউকে আসতে না দেখে সে আবার মাছে মুখ দিতে গেলো। এবার স্পষ্ট শুনতে পেলো মা ইলিশ তাকে বলছে, ও আমার বেড়াল সখী, আমাকে খেয়ো না। আমার পেটে আমার বাচ্চারা আছে। তারা এখনও জীবিত। আমি মারা গেলে তখন খেয়ো। কারণ তখন তারাও মারা যাবে। একজন মা হয়ে নিজে মরার আগে বাচ্চাদের মৃত্যু দেখতে পারবো না। মা বেড়াল মা ইলিশের কাতর অনুনয় শুনে থমকে গেলো। কথাটা তো ভাববার বটে। কোন্ মা-ই বা চায় সন্তান তার আগে মারা যাক্। মা বেড়ালের মনে মা ইলিশ ও তার হবু বাচ্চাদের জন্যে মায়া হলো। হবু বেড়ালটি আর মাছে মুখ দিলো না। সে রান্নাঘর থেকে প্রবল ক্ষুধা নিয়েই সরে এলো নিজের ডেরায়। একবেলা না খেয়ে থাকলে কেউ মরে না, নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়ে মা বেড়াল, মা ইলিশের দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে অশ্রুপাত করে। আজ যদি তার এমন হতো তাহলে তো তার যাদুরা দুনিয়া দেখার আগেই মারা যেতো। তার অনাগত সন্তানদের কথা ভেবে মা বেড়ালের চোখে অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গে গেলো।

যিনি ইলিশ মাছটি রাঁধবেন তিনি আসলেন। এ বয়ষ্ক মহিলার মনে বুঝি কোনো মায়া-দয়া নেই। নিজের মেয়ের সাধের আব্দার রাখতে গিয়ে কী অবলীলায় মাছের হবু খোকাদের তেলে ভেজে মারবার আয়োজন করছেন। রান্নাঘরে ঢুকেই তিনি ইয়া বড় এক বটি দিয়ে মাছের মাথাটা আলাদা করে ফেললেন। তারপর পেট ফেঁড়ে ডিম বের করে মাছটার দেহকে টুকরো টুকরো করে মাছ কোটা শেষ করে ফেলেন। তাজা ইলিশের গন্ধে সারা বাড়ি মৌতাতে মেতে উঠেছে। ডুবো তেলে ডিম ভেজে যখন প্লেটে রাখা হলো তখন মনে হলো এ-তো ঘ্রাণ নয় যেন খুন হওয়া ডিমগুলোর অঙ্গার হওয়া দলার পোড়া গন্ধ। ইলিশ মাছ কোটার পর যে বর্জ্য অংশ তৈরি হলো তা মা বেড়ালের সামনে দিয়ে আসে বুয়াটি। মা বেড়াল সেই ইলিশ-বর্জ্যরে ঘ্রাণ নিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় আর রাগে লেজ নাড়াতে থাকে। পেটে তার প্রচণ্ড খিদে, তবু সে নিজের মুখ সম্বরণ করে।

হবু মায়ের সাধ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো। আত্মীয়া নারীরা সবাই সমবেত হয়েছে তাকে ঘিরে। সবার মুখেই খুশি উপচে পড়ছে টইটম্বুর করে। এক একজন এক একটা উপহার দিয়ে আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন হবু মাকে। এতোক্ষণ ধরে যা রান্না করা হচ্ছিলো সে সব খাবার তার সামনে রাখা হলো। থরে থরে খাবার। রেকাবি ভরা। কতো স্বাদের পদ যে শোভা পাচ্ছে বলা বাহুল্য। কত শাড়ি যে তাকে উপহার দেয়া হলো তা গোণার অতীত। হবু মাকে ঘিরে সবাই খুশি আর আশীর্বাদের ডালি নিয়ে বসে আছে। অল্প অল্প করে সব বাটি থেকে হবু মা খাবার মুখে তুলে নিলেন। এবার ইলিশের ভাজা ডিমের প্লেটটি তার সামনে দেয়া হলো। এক টুকরা ডিম যেই উঠিয়ে মুখে দিতে গেলো অমনি মাছের আঁশটে গন্ধে হবু মায়ের ওয়াক্ ধরে গেলো। তারপর তীব্র আওয়াজে নাড়ি উল্টানো বমি শুরু হলো। এতোক্ষণ যা খেয়েছিলো তা সব বের হয়ে গেলো। উপস্থিত অন্য নারীরা হবু মাকে ঘিরে ধরলেন। হবু মায়ের প্রচণ্ড ঘাম দেয়া শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে হাত-পা ঠাণ্ডা আর অবশ হয়ে আসছে। রক্তের চাপ মানে ব্লাড প্রেসারও একদম লো হয়ে গেছে। তার পাল্স পাওয়া যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি গৃহকর্তা হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনালেন। সেই রাতে অতি জরুরি ভিত্তিতে হবু মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ির লোকেরা। প্রথম একঘণ্টা চলে যমে-মানুষে টানাটানি। ডাক্তারের সিদ্ধান্তে মাকে বাঁচানোর তাগিদে সময়ের আগেই হবু মায়ের অস্ত্রোপচার করতে হয়। একটা অপুষ্ট অপরিণত বাচ্চার জন্ম দিয়ে হবু মা অচেতন হয়ে পড়ে আছে পোস্ট অপারেটিভ বেডে। চিকিৎসকদের হাজারো চেষ্টাতেও অপুষ্ট বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেলো না। দিন তিনেক পরে বিধ্বস্ত এক সন্তানহারা মা ফিরে এলো ঘরে। মুখের মধ্যে কে যেনো মেখে দিয়েছে রাজ্যের অনিরাময়যোগ্য কষ্টের সকল ধূসর রঙ।

সন্তানহারা মা ঘরে ফেরার আগের দিনই বাড়িতে মা বেড়াল একই সময়ে চারটা নাদুস-নুদুস বাচ্চার জন্ম দেয়। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে মা বেড়ালটি ঘুরে বেড়ায় সারা ঘরে। ঘরময় মিউ মিউ কোমল ডাকে মৃত্যুপুরীতেও যেনো আজ উৎসব জেগে উঠেছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়