প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
ইলিশেরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে। প্রতি ঝাঁকে আট-দশ টন ইলিশ থাকে। এটাই তাদের চলাফেরার রীতি। একটা মা ইলিশ এরকম একটা ঝাঁকের সাথে সাগর থেকে এসেছিল মেঘনার মিঠা জলে ডিম পাড়তে। এক একটা মা ইলিশ এক এক মৌসুমে কুড়ি-একুশ লাখ ডিম পাড়ে। যে মা ইলিশের কথা আমরা বলছি তার নাম মণিরূপা। অক্টোবর মাসে যে পূর্ণিমা হয় তাকে বলে বড় পূর্ণিমা। মানুষদের কেউ কেউ একে কোজাগরী পূর্ণিমা আর কেউ প্রবারণা পূর্ণিমা বলে। এই পূর্ণিমাতেই হিসেব মতো মণিরূপা ডিম ছাড়ে মেঘনার গভীর জলে। দিন যায়। মণিরূপার ডিমগুলো একসময় খোকা ইলিশ হয়ে যায়। মায়ের চারপাশে খোকারা যখন ভিড় করে তখন মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর ছবি ইলিশ জগতে আর নেই। সারাদিন মা আর খোকা ইলিশেরা ঘোরাঘুরি করে নদীর জলে আর ধরে ধরে প্লাঙ্কটন খায়। প্লাঙ্কটন হলো ক্ষুদ্র প্রাণি যারা ইলিশের খাদ্য। মেঘনার জলে প্রচুর প্লাঙ্কটন আছে। মণিরূপার সব বাচ্চাই দেখতে সুন্দর। মায়ের আদল। মনে হয় এক একটা চাঁদ পানিতে খেলা করে। বাচ্চাদের দেখে মণিরূপার চোখে-মুখে শান্তি আসে। অপার শান্তি। খোকা ইলিশেরা মায়ের কাছে খোকা হলে কী হবে, লোভী জেলেদের কাছে তারা শিকার। মণিরূপা ভাবে, মানুষের জগতে জেলেদের চেয়ে বড় খুনি আর নেই। তারা এক জীবনে কত প্রাণ সংহার করে! বুড়ো থেকে শিশু, মা থেকে ভ্রুণ, সব মাছই তারা নির্বিচারে ধরে আর মারে। তাদের কোন দয়ামায়া নেই। মাছের প্রাণ সংহার করতে পারলে তাদের মুখে হাসি ফোটে। এই মানুষেরা বড়ো আজব জাত। তারা নিজেদের শিশুর জন্মে খুশি হয় আর মাছের শিশু নিধনে উল্লাস করে। ভাবতে ভাবতে মণিরূপার মনে ভয় ধরে যায়। যে কোনদিন তার বাচ্চারাও জল্লাদ জেলেদের যন্ত্রে ধরা পড়বে।
এর মধ্যে মেঘনায় আরো ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসে ডিম পাড়তে। যত ইলিশ সাগর হতে নদীতে আসে তার সব মেঘনায় ঢুকতে পারে না। পারবে কীভাবে! মোহনায় জাল ফেলে ওঁৎ পেতে থাকে ধীবর দস্যুর দল। অনেক মা ইলিশ সেই ফাঁদে বলি হয়ে যায়। মণিরূপা খবর পেয়েছে, তার বোন রূপামণি সে রকম একটা দলের সাথে আসতে গিয়ে ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। মণিরূপার কষ্ট হয়। দিন যত যায় মণিরূপার মনের যাতনা আরো বাড়ে। কারণ দিনকে দিন তার বাচ্চারাও সংখ্যায় কমে আসছে। মণিরূপা বুঝতে পারে, বাচ্চারা হার্মাদ জেলেদের জালে ধরা পড়েছে। প্রতিদিন রাতে মণিরূপা দানোদের কথা বলে। বিভিন্ন জাল সম্পর্কে ট্রেনিং দেয়। কোন্ জালে ছিদ্র বড়, কোনটার ছিদ্র ছোট, কোনটা কারেন্ট জাল ইত্যাদি। জাল না চেনালে তারা সহজে ফাঁদে ধরা পড়বে। কিন্তু মানুষ জাতের বুদ্ধি বেশি। এই অতি বুদ্ধি দিয়েই তারা দুনিয়াটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
মণিরূপার বাচ্চাদের মধ্যে একটার নাম রূপকিশোর। এই খোকাটা বেশ দেখতে। সব সময় মায়ের পাশে পাশে থাকে। রূপকিশোরের গায়ের আঁইশগুলো চকচকে রূপোলি। মনে হয় তাকে জন্মের সাথে সাথে চাঁদের জোছনায় স্নান করানো হয়েছে। সে যখন সাঁতরে যায় অনেকেই তখন তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে। মণিরূপা এই বিষয়গুলো খেয়াল করেছে। তার ছেলে এই ইলিশ ঝাঁকের হিরো। ছেলের লেজটা এখনও তেমন শক্ত হয়নি তাই এখনও সাগরে সাঁতরানোর সময় হয়নি। লেজই ইলিশের সাঁতারের প্রধান অঙ্গ। এখানে যত বেশি কাঁটা তত বেশি তার শক্তি। যাদের লেজ পরিণত তারা সবাই দিনে একটানা সত্তর-একাত্তর কিলোমিটার পর্যন্ত সাঁতরাতে পারে। আর কিছুদিন পরেই রূপকিশোরের দেহে চর্বি লাগতে শুরু করবে। যদি কোন বিপদ না হয় তবে জুন মাস নাগাদ তারা সাগরে ফিরে যাবে। এখনও তার খোকার গায়ের গন্ধে ইলিশ ইলিশ ভাবটা আসেনি। তবে ছেলের স্বভাব-চরিত্র যা তাতে মা হিসেবে মণিরূপার গর্ব হয়।
কিন্তু তার এই গর্ব বেশিদিন নিরাপদ থাকে না। আকাশে সেদিন ছিল কালো মেঘ। কেমন একটা গুমোট আবহাওয়া। জেলেরা জানে, এসময় ইলিশেরা গভীর জল হতে উঠে আসে উপরে। তারা দলবেঁধে জাল ফেলে নদীতে। পুরো নদীজুড়ে কেবল ইলিশা নৌকা আর নৌকা। এই জেলেরা আর কোন কাজ পারে না কেবল ইলিশ মারা ছাড়া। তাই তাদের বাধ্য হয়েই জলে নামতে হয় জাল নিয়ে। আড়তে গদি নিয়ে বসে থাকা মহাজনেরা তাদের আগাম টাকা দাদন দেয়। বোকা জেলেরা দারিদ্র্যে পড়ে সেই টাকা আগেভাগে খেয়ে ফেলে। ফলে ঋণ শোধ করার জন্যে তারা নদীতে জীবনবাজি রাখে। জেলেদের নদীতে সমাবেশ দেখে মণিরূপা সতর্ক হয়ে যায়। আজ এই ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। সে মনে মনে বুদ্ধি আঁটে। ইতোমধ্যেই সে একটা ঝাঁকের নেত্রী হয়ে গেছে। তার ঝাঁকের ইলিশেরা তাকে মান্যি করে খুব। মণিরূপা একটা জরুরি সভায় বসে। এক এক জন এক এক মত প্রকাশ করে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়, দলের একজনও যদি জেলেদের জালের ফাঁদে আটকায় তবে সবাই নিজেরাই ফাঁদে আটকাবে নিজেদের। তারপর যা হয় হবে। দলছুট হবে না কেউ। সভার পর থেকে মণিরূপার ঝাঁকের ইলিশেরা ঝাঁকছুট হয় না। যেখানে যায় ঝাঁক বেঁধে যায়। এরই মধ্যে একটা জালের ফাঁদে তারা প্রায় আটকে গেছিল। কিন্তু কোথা থেকে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে আরেকদল লোক এলো জানিনা। মনে হয় তারা আজ ফেরেশ্তা হয়ে এসেছে। জেলেদের জাল কেড়ে নিয়ে তাদের আটক করে নিয়ে গেলো মেশিনের বোটে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে আজ মণিরূপার দল। ইলিশের অন্য একটা বড় দলের নেত্রী হলো পালভা। সে এসে খবর দিলো, পানির উপরে নাকি উর্দি পরা কয়েকজন লোক তাদের ধরতে আসা জেলেদের কাছ থেকে কাগজের তোড়া নিয়ে তাদের ছেড়ে দিয়েছে। তবে কাগজের তোড়া বিনিময়ের ফাঁকে তারা প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছে। কিন্তু এক ফাঁদ কাটালে আরেক ফাঁদ এসে হাজির হয়। এভাবে বেঁচে থাকার যুদ্ধে মণিরূপা ও তার দল নিরন্তর জীবনবাজি খেলে। কিন্তু সত্যি সত্যিই একসময় ফাঁদ এড়াতে পারে না। চারদিক থেকে যেন জালের ফাঁসগুলি এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনছে জালের বিস্তার। সবাই এড়িয়ে বের হয়ে গেল সে ফাঁদ। কিন্তু হায়! মণিকিশোর আটকা পড়ে আছে ফাঁদে। সে কাতর হয়ে ডেকে উঠল, মা! বাচাও, মা! মণিরূপা আর তার সঙ্গী ইলিশেরা পিছন ফিরে তাকাতেই তাদের বুক ধক করে উঠল। সবাই সিদ্ধান্ত মোতাবেক নিজেদেরকে ফাঁদে আটকাল। তারপর মণিরূপা নির্দেশ দিলো, মারো টান হেঁইয়ো। টনে টনে ইলিশ পানির নিচের দিকে জালটাকে টেনে নিয়ে চললো লেজের শক্তি দিয়ে। ইলিশেরা টানছে নিচের দিকে আর মানুষ জেলেরা টানছে উপরের দিকে। মণিরূপা তার কর্মীদের হাঁক দেয়, আরো জোরে টানো, আরও জোরে। ঠিক সে সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল ইলিশের আরও একটা বড় ঝাঁক। মণিরূপার দলকে জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে দেখে তারা সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তারাও নিজেদের লেজ জালের ফাঁসে আটকিয়ে পানির নিচের দিকে টান দেয়। দুটো বড় বড় ঝাঁকের ইলিশের সম্মিলিত শক্তির কাছে এক সময় দুর্বল শক্তির ইলিশ-জেলে পরাজিত হয়। জালসহ জেলেরা নদীতে পড়ে যায়। টানের চোটে নৌকা যায় উল্টে। জেলেরা সাঁতরে নৌকা ধরে ভাসতে থাকে। আর পানির নিচে ইলিশেরা ঝাঁক বেঁধে জালটাকে টেনে নিয়ে যায় গভীর পানিতে। তারপর অনেক ঘাম ঝরিয়ে জালের ফাঁস থেকে উদ্ধার করে রূপকিশোরকে। ফাঁসমুক্ত রূপকিশোরকে পেয়ে মা বুক দিয়ে ধরে রাখে। অন্য ইলিশেরা সাঁতার থমকে উল্লাস ধ্বনি করে তাদের ভাষায়। তারা আশ্বস্থ হলো মণিরূপার মতো বুদ্ধিমতী নেত্রী পেয়ে। মণিরূপার নেতৃত্বে তাদের সাহস বেড়ে গেলো। মণিরূপাকে মাঝখানে রেখে তারা আরেকটা জরুরি সভায় বসলো। এই সভাটি হলো আগামী বছরের পরিকল্পনা সভা। তাদের এ সভায় যোগ দিল অন্য দুয়েকটা ঝাঁকের নেত্রীরাও। নেত্রী ইলিশরা সবাই একমত হলো, আগামী মৌসুমে তারা আর ডিম ছাড়ার জন্যে মেঘনায় আসবে না। সিন্ধুমতী নামের ইলিশ বললো, গত দুই মৌসুম ধরে মেঘনায় যত ডিম পেড়ে যাচ্ছি তত কিন্তু ছা হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের চেয়ে এবছর ছা ফুটেছে আরও কম। এমন হলে এখানে আর আসা যাবে না। ইরাবতীও বললো, এখানে একদিকে যেমন পানির মান নষ্ট হয়ে গেছে তেমনি আমাদের নিরাপত্তাও কমে যাচ্ছে। আমরা আমাদের খোকাদের হারাচ্ছি তারা বেড়ে ওঠার আগেই। আমরা আমাদের মা-বোনদের হারাচ্ছি ডিম ছাড়ার আগেই। আমরা এর একটা বিহিত চাই। সকলের কথা শুনে মণিরূপা বেশ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত দিলো, আমরা আগামী মৌসুম থেকে আর মেঘনায় আসবো না। মেঘনা এখন আর আমাদের জন্যে নিরাপদ না। আমরা এখন সাগর থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে যাবো যেখানে এখনও পরিবেশ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ আছে। সকল মা ইলিশ একযোগে সমস্বরে শপথ করলো , আমাদের সন্তানদের আমরা নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র উপহার দিয়ে যাবো। এই শপথের মধ্য দিয়েই মণিরূপাদের সভা শেষ হলো। তার ঝাঁকের ইলিশেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা আর জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। তারা এবার আগেভাগেই ফিরে যাবে সাগরে।