প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
সঞ্জুকে ছোট মামা ডেকে পাঠিয়েছেন। একদম যাকে বলে জরুরি তলব। যাবে না যাবে না করেও শেষ পর্যন্ত সঞ্জু গেল নানুর বাসায়। নানু দেখে খুশি হলেন, ফিসফিস করে বললেন, ‘পাগলটা আবার কী নিয়ে মেতেছে, কিছু জানিস? তোকে ডেকেছে কেন?’, ঠোঁট ওলটাল সঞ্জু। মানে সে জানে না। ছোট মামার ঘরে গিয়ে দেখে ছোট মামা যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে তার এয়ারগানের নল পরিষ্কার করছেন। তাকে দেখে আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন।
‘এই তোর আসার সময় হলো?’
‘কেন ডেকেছ মামা?’
‘কেন, গতকালকের পেপার দেখিসনি?’
‘না তো।’
‘আমাদের ছাপুর গ্রামে বাঘ দেখা গেছে।’
‘বলো কী?’
‘হ্যাঁ, এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আমি চুপ করে থাকতে পারি না, নেভার। তাই যাচ্ছি।’
‘বাঘ শিকারে?’
‘হ্যাঁ, তুইও যাচ্ছিস আমার সঙ্গে।’
‘এই পাখি মারার এয়ারগান দিয়ে তুমি বাঘ মারবে?’
মামা এয়ারগানের নল পরিষ্কার করা বন্ধ করে তাকালেন সঞ্জুর দিকে, যেন সে ভয়ানক এক প্রশ্ন করেছে। ‘তুই কোন ক্লাসে এবার?’
‘সেভেনে।’
‘সায়েন্স না আর্টস?’
‘সেভেনের আবার সায়েন্স, আর্টস কী?’
‘বিজ্ঞান আছে তো?’
‘থাকবে না কেন?’
মামা হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন। ‘শোন, ধর, একটা এক টন ওজনের দুই হাজার সিসির জিপ গাড়ি ছুটে আসছে ৮০ মাইল স্পিডে, সেটির দিকে আমি এক কেজি ওজনের একটি তরমুজ ছুড়ে দিলাম, কী হবে বল তো?’
‘কী হবে?’
‘ওই জিপ গাড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে!’
‘আর তরমুজ?’
‘ওটা ফর্দাফাই হয়ে যাবে। ঠিক এই টেকনিকে আমি ওই বাঘের দফারফা করব। ছুটে আসা বাঘের জায়গামতো এই এয়ারগানের একটা ছোট্ট বুলেট এমন কায়দায় ঢুকিয়ে দেব যে বাবাজি ওখানেই শুয়ে পড়বে, ইহজন্মে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। আমার টিপ তো জানিস।’
‘কীভাবে জানব?’
‘কেন? পাড়ার মকবুলকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবি। ওর ৩০টা বেলুনের সবগুলো কেমন ৩ মিনিটে ফুটিয়েছিলাম সেবার। চারিদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নে নে রেডি হয়ে নে।’ সঞ্জু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘কিন্তু আমি গিয়ে কী করব?’
‘আরে কী আশ্চর্য! এ রকম একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি তুলে রাখতে হবে না? ফেসবুকে সেই ছবি দিলে দেখবি লাইকের বন্যা বয়ে যাবে...আর শেয়ার যে কতজন দেবে কে জানে।’
যাহোক, শেষ পর্যন্ত সঞ্জু তার ছোট মামার সঙ্গে রওনা দিল গ্রামের বাড়িতে, বাঘ শিকারে। তার গলায় ঝোলানো মামার ডিএসএলআর ক্যামেরা। মামা শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ছবি তুলতে হবে।
কিন্তু গ্রামে গিয়ে সঞ্জু হতাশ হলো। বাঘের খবরে খুব একটা উত্তেজনা প্রকাশ করল না কেউ। দু–একজন অবশ্য বলল, ‘হ্যাঁ একটা বাঘ নাকি গত পরশু দেখা গেছে।’
‘কী বাঘ? রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার?’ মামা তার এয়ারগানে গুলি ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস করেন। গ্রামের লোকজন এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, যেন বেঙ্গল টাইগারের নাম তারা এই প্রথম শুনল। মামা আরও পরিষ্কার করলেন? ‘বাঘের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ আছে?’
‘না, ফুটকি ফুটকি দাগ।’
‘ওহ্, তাহলে চিতা বাঘ। এ তো আরও ডেঞ্জারাস।’ মামাকে যথেষ্ট উত্তেজিত মনে হলো।
‘শিংও আছে।’
‘শিং আছে? বাঘের শিং?’ মামার উত্তেজনায় কেউ একজন পানি ঢেলে দিল যেন। শেষ পর্যন্ত মামা ফিসফিস করলেন সঞ্জুর কানে কানে ‘গ্রামের লোকজনের কথায় পাত্তা দিলে চলবে না। এরা উল্টাপাল্টা গুজব ছড়াচ্ছে। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। চল আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়ি, বাঘের জন্য ফাঁদ পাততে হবে, হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই আমাদের।’
খুব দ্রুত একটা ছাগলের বাচ্চা কেনা হলো। সেটা নিয়ে সন্ধ্যার আগে গ্রামের ধারের ছোট্ট জঙ্গলটায় ঢুকে পড়ল ওরা, যে জঙ্গলে বাঘ দেখা গিয়েছিল আরকি। গ্রামের কিছু মানুষ আসতে চাইছিল ওদের সঙ্গে। মামা হুঁশিয়ার করে দিলেন—সবাই যেন যার যার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। বাঘ শিকার করে মামা যখন বাঁশিতে হুইসেল বাজাবেন, তখন যেন আসে, তার আগে না। মামা পকেট থেকে একটা বাঁশি বের করে সেটা বাজিয়েও শোনালেন।
শেষ পর্যন্ত একটা বেশ বড়সড় গাছে উঠে পড়লেন মামা আর সঙ্গে সঞ্জু। গাছের নিচে ছাগল বাঁধা। ছাগলের সামনে কিছু কাঁঠালপাতা রাখা হয়েছে। আবার না খেয়ে না মরে ছাগল! বাঘ কখন আসে ঠিক আছে? তবে সঞ্জুর এখন বেশ উত্তেজনা হচ্ছে। সত্যি সত্যি যদি বাঘ আসে তাহলে বেশ হয়, যদিও ছাগলটার জন্য মায়া হচ্ছে। ওকে কি সত্যি খেয়ে ফেলবে বাঘ?
গাছের ওপর একটা জুতসই জায়গায় হেলান দিয়ে বসল সঞ্জু। নিজেকে বেল্ট দিয়ে একটা ডালের সঙ্গে বেঁধে রাখল। মামার মাথায় এখন একটা ফেল্ট ক্যাপ। একটু পরপর একটা বাইনোকুলার দিয়ে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছেন মামা। হাতে এয়ারগান। তাকে দেখে মনে হচ্ছে জিম করবেট; কুমায়নের জঙ্গলে কোনো গাছে চড়ে বসে আছেন ভয়ংকর কোনো নরখাদক বাঘের অপেক্ষায়। নিচে ছাগলটা হচ্ছে জিম করবেটের কুকুর রবিন। তাহলে সঞ্জু কে?... যাহোক, সঞ্জু তখন চিপস বের করে খাওয়া শুরু করেছে। বেশ ভালোই লাগছে গাছে চড়ে চিপস খেতে। মামা চিপস, পাউরুটি, কলা, কোক, পানি সবই এনেছেন সঙ্গে। কারণ, গাছে কত দিন থাকতে হয় বাঘের অপেক্ষায় তার কোনো ঠিক আছে?
‘মামা, যদি বাথরুম পায় তখন কী করব?’
মামা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে তাকালেন সঞ্জুর দিকে। যেন বাঘ শিকারে এসে বাথরুম পাওয়াটা রীতিমতো অপরাধ!
একটু পর আকাশে মস্ত এক চাঁদ উঠল। কী সুন্দর দৃশ্য। ব্যাপারটা মন্দ নয়, গাছের পাশেই নিজের ছোট মামা, আকাশে চাঁদ মামা আর গাছের নিচে বাঘ মামা...মানে যদি দয়া করে আসে আরকি!
কতক্ষণ বসে ছিল সঞ্জুর মনে নেই। একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল বোধ হয়, হঠাৎ ধপ করে একটা শব্দ হলো, চমকে জেগে উঠে দেখে মামা নেই। হায় হায়! তবে কি চিতা বাঘ গাছে উঠে মামাকে নিয়ে গেছে। চিতা বাঘ তো গাছে উঠতে পারে। নিচে তাকিয়ে দেখে ছাগলটা দিব্যি কাঁঠালের পাতা চিবাচ্ছে আয়েশ করে। আর তার পাশে চিত হয়ে পড়ে আছেন ছোট মামা, চিঁ চিঁ করে বলছেন, ‘সঞ্জু! আমি গাছ থেকে পড়ে গেছি রে...!’
ভালোমতো খেয়াল করে সঞ্জু আবিষ্কার করল, ছাগলটা আসলে কাঁঠাল পাত সব আগেই খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। এখন চিবিয়ে খাচ্ছে মামার শার্ট। অর্ধেকের মতো বোধহয় খেয়েও ফেলেছে। ঠিক তখন একজন মানুষের গলা শোনা গেল, ‘ছোট মিয়া, ছোট মিয়া!’
ছোট মামাকে গ্রামের সবাই ছোট মিয়া ডাকে। ‘ছোট মিয়া, বাঘ ধরা পড়ছে...বাঘ ধরা পড়ছে! গাছ থাইকা নাইমা আসেন।’
বাঘ ধরা পড়েছে, সেই উত্তেজনায় গাছ থেকে নেমে এল সঞ্জু। ধরে–বেঁধে মাটিতে পড়ে থাকা মামাকে দাঁড় করানো হলো। ওরা চারজন ( ছাগলসহ) কোনোমতে বের হয়ে এল জঙ্গল থেকে। মামার পা মচকেছে, হাতেও ব্যথা পেয়েছেন, থুতনির কাছে অনেকট ছিলেও গেছে। কোনোমতে মামা বললেন, ‘বাঘ কোথায়? কীভাবে ধরা পড়ল? কী বাঘ?’
‘ফুটকি ফুটকি দাগ।’
‘তাহলে চিতা বাঘ।’
‘ইউনুস মিয়া ধরছে। তার ঘরের পাশের লাউগাছটা খায়া প্রায় শেষ কইরা ফেলছে, এই সময় জাবরায়া ধরছে।’
চিতা বাঘ লাউগাছ খায়? খুবই আশ্চর্য লাগছে সঞ্জুর!
ইউনুসের ঘরে বাঘটাকে দেখল তারা। ফুটকি ফুটকি দাগ, বাঘের আবার সুন্দর ছোট দুটি শিংও আছে...মানে একটা হরিণ আরকি। এই গ্রামের লোকজন আগে হরিণ কখনো সামনাসামনি দেখেনি।
ছোট মামা ওই রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন, ছাপুর গ্রামে আর একমুহূর্ত না। পথে আবার ঝামেলা হলো। টহল পুলিশ ধরল।
‘রাতবিরেতে বন্দুক নিয়ে কোথায় গেছিলেন? লাইসেন্স আছে?’
‘এটা এয়ারগান, লাইসেন্স লাগে না।’
‘লাইসেন্স লাগে কি লাগে না থানায় গিয়ে বলবেন, চলেন। সাথের এই পিচ্চি কে?’
‘ভাগনে।’
সঞ্জু ভাবল ‘মামা-ভাগনে যেখানে, বিপদ নাই সেখানে’ কথাটা মনে হচ্ছে মোটেও ঠিক নয়। পদে পদে বিপদে পড়তে হচ্ছে ওদের। মামা আড়ালে গিয়ে পুলিশকে ফিসফিস করে কীসব বোঝালেন, একবার দেখা গেল পকেটেও হাত দিলেন...তারপর বিমর্ষ মুখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে এলেন। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। মামার শরীরের ঘা কয়টা গুনে দেখতে হবে। এই মুহূর্তে থুতনি, কপাল আর হাতের কনুইয়ে দেখা যাচ্ছে ...
সঞ্জুর বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা। বাবা হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘কিরে, শুনলাম মামার সঙ্গে নাকি বাঘ শিকারে গিয়েছিলি? শিকার কিছু হলো?’ সঞ্জু এমনভাবে মাথা নাড়ল, যাতে হ্যাঁ–না দুটোই হতে পারে। বাবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখছেন, তাঁর প্রিয় চ্যানেল। সেখানে একটা চিতা বাঘ একটা হরিণকে তাড়া করেছে... দুটির গায়েই ফুটকি ফুটকি দাগ!