প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
নাম তার মিতা। খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম হয়েছে। পরিবারটা যে বড় তা নয়। খুব ছোট এক পরিবার। বাবা- মা, মিতা, আর তার ছোট এক ভাই মিঠু। মিতার বয়স ১২বছর। এবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে। মিতার পরিবারটা ছোট হলেও সুখ কম নেই, অনেক সুখিতে দিন পার করছে মিতা। প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনে মিতার বাবা ঘুরতে নিয়ে যায়।মিতা আর মিতার ছোট ভাই মিঠু খুব মজা করে। মিতার পরিবারের দিনগুলো খুব সুন্দরভাবে চলে যাচ্ছিলো। মিতা তার বাবাকে খুব বেশি ভালোবাসে। কারণ মিতার বাবা কখনোই মারে নি মিতাকে, বকা ও দেয়নি কোনদিন। কিন্তু মা দুষ্টুমি করলেই বকা দেয়। তবে মিতা তার বাবাকে খুব ভালোবাসে। বাবাকে ছাড়া একটি মুহূর্ত যেন থাকতে পারতো না। বাবা কাজ শেষ করে এসে রোজ কপালে চুমু খেতো। মিতা খুব যত্নসহকারে তার বাবাকে খাবার খাওয়াতো। সব সময় তার বাবার যত্ন নিতো। বাবার কাছে কখনোই কোন কিছু বায়না ধরতো না। কারণ মিতা জানতো তার বাবার কাছে বায়না করার মতো টাকা নেই। তাই মিতা কখনো তার বাবার কাছে কোনোকিছু বায়না করতো না। মিতা তখন তার পরিবারের সকল সমস্যার কথা বুঝতে শিখে গিয়েছে। তার কোথায় কি করতে হবে, না হবে সবটাই সে জানতো। মিতা সবটা জানলেও কিছু কিছু জিনিস সে জানতো না। তার জানার বাইরেও অনেক কিছু ছিলো যা সে কল্পনাতেও আনে নি। দেখতে দেখতে কিছু মাস কেটে গেলো। মিতার মা আবারো প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো। মিতার আরেকটা বোন হবে। সেই খুশিতে মিতা ও তার ভাই খুব খুশি হলেও তার বাবা যেন খুশি নন। মিতা আর কিছু বলতে পারলো না। মিতা মাথা নেড়ে তার সহমত জানালো সে কাউকে কিছু বলবে না। মিতা খুব ভয় পেয়ে গেলো। মিতার সাথে এতক্ষণ যাবৎ কি হয়েছে তার অর্থ কিছুই জানেনা। এটাকে কি বলে সেটাও জানেনা। তবে এটাই জানে তার সাথে যা হয়েছে খারাপ হয়েছে। এসব খারাপ কাজ।
মিতা এখন আর হাসে না। সে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো। সে স্কুলে ঠিকমতো যেতো না ভয়ে। রাত হলে তার যেনো ভয়টা বেড়ে যেতো। যতই সাবধানে ঘুমাতো না কেন ঠিক গভীর রাতে মিতার সাথে তার বাবার নির্যাতন ঠিকই বেড়ে যেতো। মিতার মা কিছুই জানতো না। মিতার মা এসব কল্পনাতেও আনতো না। মিতার চুপচাপ থাকা, মিতা আগের মতো কারো সাথে না মেশা যেন মিতার মাকে ভাবিয়ে তুললো। মিতার মা এখন মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন। তার মেয়ে হঠাৎ কেন চুপচাপ হয়ে গেলো। মিতাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে এমনি ভালো লাগে না তাই কথা বলি না। মিতার দুঃচিন্তা তো আর কেউ অনুভব করতে পারবেনা। রোজ তার বাবার হাতে ধর্ষিত হচ্ছে। এসব কথা কাকেই বা বলবে।
মিতার মায়ের ডেলিভারি সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই তার মা রাতে ঘুমাতে পারেনা। এক রাতে মিতার বাবা মিতাকে জোর করে নির্যাতন করার সময় মিতার মা সব দেখে ফেলে। মিতার মা যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে সে এ কি দেখছে। মিতার মা মাথা ঘুরে সেখানেই পরে যায়। মিতার বাবা তার পরার শব্দ শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। তবে তার চোখে যেনো ভয় কাজ করছে না। মিতার ছোট্ট একটি বোন হলো অথচ মিতার মায়ের চোখে অনবরত পানি ঝড়ছে। তবে সুখের নয়, দুঃখের। মিতাকেই রক্ষা করতে পারিনি এখন এই মেয়েকে কি করে রক্ষা করবে সে। মিতাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না৷ তবে মিতার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। কি থেকে কি হয়ে গেলো মিতার মা এসব বিশ্বাসই করতে পারতাছে না।
মিতা তার ছোট্ট বোনের সাথে খেলা করতাছে। মিতার মা এসে পাশে বসলো, জিজ্ঞেস করলো? স্কুল যাবে না মা। মিতা মাথা নেড়ে না বললো।
মিতার মা : কেন যাবিনা মা?
মিতা : আমার ভয় লাগে যেতে।
মিতার মা : কিসের ভয়?
মিতা : ছেলেদের দেখলেই আমার খুব ভয় লাগে।
মিতার মা : (খুব সাহস নিয়ে) আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি?
মিতা : হ্যাঁ বলো।
মিতার মা : তোর বাবা তোর সাথে কি করেছে?
মিতা : খারাপ কাজ করেছে প্রতিরাতে (নিচের দিকে তাকিয়ে)
মিতার মা : কবে থেকে?
মিতা : অনেকদিন আগে থেকে, যখন থেকে শুনেছি আমার বোন হবে তখন থেকে।
মিতার মা : আর করবে না খারাপ কাজ। এখন তো আমি জেনেছি।
মিতা : আচ্ছা মা বাবারা কি এরকমই হয়?
মিতার মা : না।
মিতা : তাহলে আমার বাবা কেন এরকম।
মিতার মা : (চুপ)
তারা কথা বলতে বলতে অনেকটা দুজনের মধ্যে চুপ থাকা থেকে মিতাকে বের করা গেলো। এখন যা হয় মিতা তার মাকে সব জানিয়ে দেয়। মিতার মা মিতাকে তার বাবার সাথে এসব না করতে বারণ করে। তবে তার বাবা যেনো পশু থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে উঠেছিলো। কোনো রাত রাতে তাদের মা মেয়েকে ঘুমাতো দেয়নি। মিতার মা বাধ্য হয়ে মেয়ে ও ছোলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। পুলিশকে সবকিছু জানায়। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। পুলিশগুলোও তাদেরকে কোনোরকম সাহায্য করেনি। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে তার ছেলে-মেয়েদের খাবার খাওয়ায় আর অন্যদিকে মেয়ের সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার জন্য পুলিশের দোরগোড়ায় প্রতিদিন যেতো। আর সেই পুলিশেরা ঘুষের লোভে তার বাবাকে ধরেও ছেড়ে দেয়। আজ টাকার জন্য মিতা ও তার মা সুষ্ঠু বিচার পায়নি।
কতশত সাংবাদিকের কাছেও জানিয়েছে কিন্তু তারাও এই সাধারণ লোকদের সাহায্য করেনি। এটাই হলো আমাদের স্বাধীন সেই সোনার বাংলাদেশ। এই মা দীর্ঘ সাত মাস পুলিশের পিছন পিছন ঘুরেছে নিজের মেয়ের সুষ্ঠু বিচার পাবার আশায়। কিন্তু পায়নি বিচার। এই দেশে সাধারণ মানুষের কোনো মূল্যই নেই কারো কাছে। মিতার মা এই তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আর যায়নি ওই বাড়িতে। রেললাইনের পাশে বিছানা পেতে রাত পার করে। সারাদিন মানুষের কাছে দুটো ভিক্ষার আশায় হাত পেতে থাকে। যেনো তার বাচ্চাগুলো না খেয়ে মারা যায়। মিতা এই সাত মাস ধরে তার মায়ের আক্ষেপ দেখেছে। এখন মিতা ১৩ বছরে পাড় করেছে। তবে এখন মিতা সব বুঝে। সুখণ্ডকষ্ট, হাসি-আনন্দ, ভালো-মন্দ সবটা বুঝে। সে এখন প্রতিনিয়ত সব ছেড়ে চলে যেতে চায়। তার মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না। অভাবের সংসারে যেন যতদিন যাচ্ছে ততই সংসারে অভাব বাড়ছে। হাসি খুশি পরিবারটা আজ কতটা ঘৃণিত হয়ে পড়েছে, সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে। মিঠু আর সায়মাকে দত্তক দিয়ে দিয়েছে। যেন তারা আর যাই হোক মিতার মতো শিকার না হয়। মিতা এখন একা। মিতার এখন মা ছাড়া আর কেউ নেই। মাকে আইলেই তার বেঁচে থাকা। মাকে নিয়েই এখন ভিক্ষা করেই দিন পার করে। কাজ করার মতো কেউ কাজেও নেয় না তাদের। তবে তার অতীত যেন তাকে আকড়ে ধরে আছে। মিতা ভুলতে পারছে না সেসব দিনগুলোর কথা। মিতা ভিক্ষা করতেও এখন ভয় পায়। মাঝে মধ্যে না খেয়ে ও দিন পার করে মিতা। কারন মিতার ভিক্ষা করতে গিয়ে ও ভয়ে কারো থেকে ভিক্ষা চাইতে পারে না। মিতা পুরুষ দেখলেই ভয়ে গুটিয়ে থাকে এখনো। মনে পরে যায় তার সেই অন্ধকারের রাত গুলোর কথা। মনে পড়ে যায় তার জীবনের ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা। যেখানে মিতা সব বাচ্চাদের সাথে স্কুলে যেতো সেখানে আজ সে ধর্ষিতা। আজ মিতা নেই তার জীবনের কলঙ্ক যেন তাকে বেঁচে থেকেও মেরে ফেলছে। তবে এসব কথা আদৌও কারো কানে যাচ্ছে না। মাঝ রাতে মিতার চিৎকার কারো কান পর্যন্ত যায় না। মিতা সম্পূর্ণ একা। মিতার জীবন এখন একদম মরুভূমির মতোন। মিতা এখন ঘুমোতে পারেনা। রাত হলে চাঁদ দেখা যেন মিতার দৈনন্দিন কাজ হয়ে উঠেছে। মিতা কথা বলেনা এখন আর। তার চুপচাপ থাকা দেখলে মনে হয় সে ২৫ বছরের মেয়ে। অথচ সে মাত্র ১৩ বছরের একটু শিশু। রোজ রাতে চাঁদ দেখে বেঁচে আছে সে। ঘন অন্ধকারে রাস্তার ধুলো ছাড়া সবকিছু কালো মনে হয় এমনকি গাছের পাতাও ঘন কালো মনে হয়। একটানা ভয়ঙ্করী যন্তের মতো, ঝিঝির ডাকের মতো শব্দ তার কানে বাজে।
দিন যায় রাত যায়, সময়ের গতিতে সময় যাচ্ছে তবুও অতীত যেনো পিছটান ছাড়ছেই না। অতীত যেন তাকে আঁকড়ে ধরেই আছে।
বিঃ দ্রঃ বাস্তবে এই ঘটনা আমার দেশে আমার শহরে ঘটে যাওয়া এক কাহিনি। যা কাহীনিতে বলে আমি পরিচালিত করেছি। তবে তা মোটেও কল্পনা বা গল্প নয়। এটা সম্পূর্ণ বাস্তব কাহীনি।