প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
২০০৪ সালের জুলাই মাসের কোনো এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের উপকণ্ঠে তামান নামক এলাকার একটি ছোট্ট নির্জন বাড়ি। বাইরে টাপুর-টুপুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দের সাথে সন্ধি করেই যেন একটি কন্যা শিশুর জন্ম হলো। শিশুটির কান্নার আওয়াজ আর বৃষ্টির রিমিঝিমি ধ্বনি মিলেমিশে একাকার। কিন্তু সব আওয়াজকে ছাড়িয়ে একজন তাগড়া পুরুষের আনন্দঘন কান্নার আওয়াজ বেশি স্পষ্ট হলো। এই সদ্যোজাত ছোট্ট শিশুটি আমি, আর পুরুষ মানুষটি আমার বাবা। আমার নাম রাখা হয়েছিলো শিলা, কিন্তু আমি জানি না সেদিন বাইরে আদৌ শিলাবৃষ্টি হয়েছে কিনা।
বছর পেরিয়ে আমার হাত-পায়ের নখের আকার বড় হয়েছে আমার বাবাকে খামচে ধরার জন্য। ধীরে ধীরে হাঁটা শিখতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই, বাবাও আমার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাওয়ার ভান করেন যেন আমার কষ্ট বেড়ে না যায়। আমার বয়স যখন ছয় বছর, আমি তখনও কথা শিখতে পারিনি। সবাই ভেবেছিল হয়তো আমি বাকশক্তি পাবো না, বোবা হয়ে থাকবো। কিন্তু আমি কথা বলতে না পারলেও আমার অঙ্গভঙ্গি আর মুখের অদ্ভুত সব আওয়াজে আমার বাবা ঠিকই আমার সব অব্যক্ত কথাকে বুঝে নিতেন। বাবার সীমাহীন দোয়া ও মনের অগাধ বিশ্বাসে আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে সাত বছর বয়সে কথা বলার শক্তি দেন। আমি বাবাকে ‘বাপে’ বলে সম্বোধন করা শুরু করি। বাবাও ‘বাপে’ ডাকে খুশি হয়ে যেতেন। একটু একটু করে আমার মুখ থেকে কথার ফুলঝুরি ফুটতে থাকে।
কয়েক বছর পরের কথা। কুয়ালালামপুর একটি কর্মব্যস্ত নগরী। সংসারের ঘানি টানার জন্যে বাবাকে সকাল আটটার সময় কাজে বেরিয়ে পড়তে হতো। আমার কপাল বুলিয়ে চুমু খেয়ে বাবা প্রতিদিন কাজে যেতেন। তখন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতাম। ঘুম ভাঙলেই দেখতাম বাবা বাসায় নেই। বাবাকে বাসায় না পেয়ে আমি কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম। বিকেল পাঁচটায় বাবা বাসায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আমি ‘বাপে’ ‘বাপে’ ডাকতে ডাকতে অস্থির হয়ে যেতাম।
পাঁচটা বাজার আগ মুহুর্তেই আমি আমার টিনটিনে হাত দু’টো জানালার বাইরে বের করে রাখতাম যাতে সবার আগে বাবা আমায় দেখতে পান। বাবা দরজায় পা রাখতেই আমি ‘বাপে’ বলে ডাকা শুরু করতাম। তখন বাবাও ‘আম্মু’ বলে ডেকে আমাকে কোলে তুলে নিতেন। বাবার কোল জুড়ে লেপটে থাকাটাই ছিল আমার নিত্যদিনের আরাধনা।
আমি চলনে বলনে অনেকটাই বাবার মতো হয়েছি। আমার মুখের গড়ন ও দুই পায়ের ধরন উভয়টাই বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। বাবা তাঁর ছোটোবেলায় একটি দুর্ঘটনায় বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। তখন থেকেই হাঁটার সময় তাঁর বাম পা কিছুটা ভেঙে পড়ে। এ কারণে কিছু অপ্রকৃতিস্থ লোক বাবাকে হেয় করে ‘ল্যাংড়া’ বলে মজা করে। প্রথম প্রথম যদিও আমি রাগে খুব ফুঁসে উঠতাম, কিন্তু এখন আমি এসবে কর্ণপাত করি না কারণ তখন আমার মনে পড়ে যায় বাবার শিখানো সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত ‘উত্তম ও অধম’ কবিতার এ কয়েক চরণ ‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়, তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?’ সরলতা, সততা, দৃঢ়তা ও উদারতাসহ বাবার সকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই যেন আমার চরিত্রের মধ্যে নিহিত রয়েছে।
বছর সাতেক আগের কথা। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকার ফ্লাইট ধরেছি। বাবা আমাদের বিদায় জানাতে প্রায় বিমানবন্দরের ইমিগ্রিশন কাউন্টার পার হয়ে এসেছেন। আমি দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। বাবার জোড়া চোখ বর্ষনমুখ। চোখ লাল হয়ে মুখ অনেক ভার হয়ে আছে, যেন গাল বেয়ে অঝোর বৃষ্টি নামবে। কিন্তু বাবার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুও ঝরলো না। অথচ আমি ঠিকই আমার বাবার হৃদয় অন্দরে বয়ে যাওয়া অশ্রু নদী দেখতে পেয়েছি। বাবা লোক চক্ষুর সামনে কাঁদলেন না, কারণ তিনি কান্না শুরু করে দিলে বিমানবন্দরে আমার রোনাজারি শুরু হয়ে যাবে। সেবার বাবা আমাদের অশ্রুসিক্ত নয়নে বিমানবন্দরে বিদায় জানালেন।
আজ আমার নখের আকার, আঙুলের ভাঁজ আর মাথার কেশগুচ্ছ বদলে গিয়েছে। আমার মুখাবয়ব জানান দিচ্ছে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন আমি কিশোরী থেকে একজন পরিণত মেয়ে। অদ্য দোসরা ডিসেম্বর, দুই হাজার বাইশ, রোজ শুক্রবার আমার শুভ পরিণয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। অথচ এমন একটি দিনে বাবা আমার থেকে এয়ার পথে ১৭০০ মাইল দূরের কুয়ালালামপুর শহরে জীবনের প্রয়োজনে শরীরের ঘাম ঝরাচ্ছেন, আমি তা ভাবতেই পারছি না। আমি মুষড়ে পড়ছি, ভেঙে পড়ছি। বাবার রিক্ততায় খানখান হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতর, আমার বাহির। যখন বাবার ভালোবাসায় আমার সিক্ত হবার কথা, সেখানে বাবার অনুপস্থিতি আমার এই মাহেন্দ্রক্ষণকে প্রচণ্ড বিবর্ণ করে দিচ্ছে যেন। আমি বাবাকে বড্ড ভালোবাসি, বাবার স্নেহাস্পর্শ পাওয়ার আশায় ক্ষণ গুণছি অহর্নিশ।